প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
করোনাকালে চিকিৎসা সেবায় ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ পরিবারের ছিল অসামান্য অবদান
মহামারী করোনাকালে চাঁদপুরের সার্বিক চিকিৎসা সেবাকে আকস্মিকভাবে মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় নিয়ে গিয়েছে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ পরিবার। এই পরিবারের দুই স্বনামধন্য সদস্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এই জেলার করোনার চিকিৎসা সেবাকে কাক্সিক্ষত জায়গায় এনে দিয়েছে। যার কারণে করোনার প্রায় দেড় বছরের চলমান সময়কালে এ জেলার মানুষ চিকিৎসা সেবা পেয়ে চলেছে। অতিমারীর এই দুর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা কখনো এ জেলায় ছিল না, সে সুযোগগুলো মানুষ হাতের নাগালে পেয়েছে। যে কারণে করোনার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহতার সময়ও চিকিৎসা সেবা পেতে মানুষকে তেমন একটা বেগ পেতে হয় নি। প্রত্যাশার চেয়েও চিকিৎসার অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়েছে বলে মনে করেন এ জেলার মানুষ। আর এর পেছনে অসামান্য অবদান যে পরিবারটির রয়েছে, সে পরিবারটি হচ্ছে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ পরিবার। এ পরিবারের দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং তাঁর বড় ভাই ডায়াবেটিকে দেশখ্যাত ফুট সার্জারি ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুর করোনা মহামারীকালে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেয়া, মনিটরিং করা এবং চিকিৎসা সেবার কোথাও সংকট দেখা দিলে তাৎক্ষণিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সে সংকট দূর করা। ভাই-বোনের এমন যৌথ প্রচেষ্টাই মূলত চাঁদপুরে করোনা চিকিৎসায় এই সফলতা। আর এর সুফল যে শুধু চাঁদপুর জেলাবাসীই ভোগ করেছে তা নয়। পাশর্র্^বর্তী লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, এমনকি নোয়াখালী জেলার করোনা পজিটিভ এবং সাসপেক্টেড রোগী এসেও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে।
|আরো খবর
ডাঃ দীপু মনি ও ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুর এই কর্মযজ্ঞের শুরুটা ২০২০ সালে করোনার শুরুতে এর প্রাদুর্ভাব চাঁদপুরে বেড়ে যাওয়ার সময় থেকে। শুরুতে আড়াই শ’ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে করোনা পজিটিভ ও সাসপেক্টেড রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়ার জন্যে হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার প্লান্ট স্থাপন করা হয় ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে। একই সাথে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে বেশ কিছু বেডে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থার দ্বারা তখন আইসোলেশন ওয়ার্ডে গুরুতর শ^াসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া যেতো। যার কারণে করোনার শুরুর দিকে প্রচ- শ^াসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীরা যে চাহিদামতো অক্সিজেন সাপোর্ট পেতো না, সেটা দূর হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় কাজটি হয়েছে চাঁদপুরে একটি আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা। কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ এই ল্যাব স্থাপনটি ছিল খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু তখন চাঁদপুরে এই ল্যাবের খুবই প্রয়োজন ছিল। কারণ, এর আগে করোনা শনাক্তকরণের জন্যে চাঁদপুর থেকে করোনার স্যাম্পল যেতো ঢাকা। কিন্তু ঢাকা থেকে রিপোর্ট আসতে ৭-৮ দিন এমনকি ১০-১২ দিনও লেগে যেতো। আর এ সময়ে এই ভাইরাসটি অনেক ছড়িয়ে যেতো, মানুষও একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতো রিপোর্ট কি পজিটিভ না নেগেটিভ। এই সমস্যাটি যখন ডাঃ দীপু মনি এবং ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুর দৃষ্টিতে আনা হলো, তখন তাঁরা চাঁদপুরে একটি আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। তাঁরা চিন্তা করে দেখলেন, সরকারিভাবে এটি করতে গেলে অনেক সময়ের ব্যাপার। প্রথমত জায়গা নির্ধারণ করা, এরপর বরাদ্দ পাস হওয়া। আর এ সব করতে গণপূর্ত বিভাগের বছর পার হয়ে যাবে। এই দীর্ঘসূত্রিতার কথা চিন্তা করে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি ও তাঁর বড় ভাই ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু সিদ্ধান্ত নিলেন শহরের নতুনবাজার কদমতলা এলাকায় পৌর মার্কেটে তাঁর বাবার নামে অর্থাৎ ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে যে ফ্ল্যাটটি নেয়া আছে, সেটাতে যদি আরটি পিসিআর ল্যাবটি স্থাপন করা যায় তাহলে জায়গা নির্ধারণের ঝামেলাও কেটে গেলো, আর রেডি করা ফ্ল্যাটে ল্যাব স্থাপনটা খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়ে যাবে। এই চিন্তা থেকে আর পেছনে তাকালেন না তাঁরা। চাঁদপুরবাসীর সেবার জন্যে বাবার নামে ‘ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ আরটি পিসিআর ল্যাব’ স্থাপনের কাজ শুরু করে দেয়া হলো। কিন্তু অর্থ? কোটি টাকারও উপরে অর্থ ব্যয় হবে। সেটিও স্থির করে ফেললেন ডাঃ দীপু মনি। নিজের সমুদয় সঞ্চিত অর্থ এখানে ব্যয় করবেন। বোনের এমন সিদ্ধান্তে ভাইও এগিয়ে আসলেন। ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুও তাঁর সঞ্চিত অর্থ থেকে এখানে অনুদান দিলেন। ভাই-বোনের অর্থে চাঁদপুরে হয়ে গেলো আরটি পিসিআর ল্যাব তথা কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ ল্যাব। তবে এ ক্ষেত্রে ডাঃ দীপু মনির অনুরোধে সাড়া দিয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন চট্টগ্রাম ভ্যাটেরেনারি ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ। এই ল্যাব চালু করার কাজে তাঁর ইউনিভার্সিটির লোকবলকে তিনি এখানে কাজে লাগালেন। এমনকি এটি চালু হওয়ার পর এক মাস সিভাসুর স্টাফরা এখানে সার্ভিস দিয়েছেন।
২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরে করোনার চিকিৎসা সংক্রান্ত নতুন যা কিছু হয়েছে, সব ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। এ কাজে চাঁদপুরের তথাকথিত কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি বা দানবীর এমনকি নিজ দলের মধ্যে যারা বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তারাও এগিয়ে আসেন নি।
২০২০ সালের আগস্টে চাঁদপুরে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ আরটি পিসিআর ল্যাব উদ্বোধনের পর থেকে চাঁদপুরেই করোনা টেস্ট হয়ে আসছে। এটিকে চাঁদপুরের চিকিৎসা সেক্টরে এক যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে দেখছে এই জেলাবাসী। কারণ এই ল্যাব স্থাপনের জন্যে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদের পরিবারের এই দুই সদস্য যদি এগিয়ে না আসতেন, তাহলে হয়তো এ জেলার মানুষ এখনো ল্যাব চোখে দেখতেন না, ঢাকায়ই তাদের করোনা টেস্ট হতো।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এই বছর যখন শুরু হয়, তখন চাঁদপুরের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। একদিনেই আক্রান্তের সংখ্যা শত শত ছাড়িয়ে যায়। মৃত্যু ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। গ্রামগঞ্জ থেকে এমন খারাপ অবস্থার রোগী চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আসতে থাকে, যারা ভর্তি হওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে মানুষগুলো মারা যাচ্ছিল। হাসপাতালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা পুরোটা আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে নেয়ার পরও রোগী জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। ওয়ার্ডের ভেতরে ফ্লোরে হাটার জায়গায়ও রোগীর ঠাঁই হয় নি। দেয়া হয় বারান্দায় সিট। সেখানেও সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। পরে তৃতীয় তলার পেইং ব্লকও আইসোলেশন ইউনিট করা হয়।
এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় রোগী যখন বাড়তে থাকে, তখন ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ডাঃ দীপু মনি এবং তাঁর বড় ভাই ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু আবুল খায়ের গ্রুপের সাথে কথা বলে হাসপাতালে ফ্রি অক্সিজেন সার্ভিস দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আবুল খায়ের গ্রুপ হাসপাতালের নিচতলায় একটি রুমের পুরোটাই অক্সিজেন সিলিন্ডার প্লান্ট করার জন্য নিয়ে নেয়। বড় বড় সাইজের সিলিন্ডার বোতলে রিফিল করে হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ দিতে থাকে আবুল খায়ের গ্রুপ। তখন পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া গেলেও কিছুদিন পর রোগীর চাপ প্রচ- রকমের বাড়তে থাকে। রোগী দুই-তিন গুণ বেড়ে যায়। তখন অক্সিজেনের চাহিদা কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। হাসপাতালের নিচতলায় অক্সিজেন রিফিল করার রুমের সামনে রোগীর স্বজনদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো একটি সিলিন্ডারের জন্যে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আবারো এগিয়ে আসলেন ডাঃ দীপু মনি ও ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু। ডাঃ দীপু মনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে জোরালোভাবে যোগাযোগ করে চাঁদপুর হাসপাতালে স্থায়ীভাবে একটি অক্সিজেন প্লান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ইউনিসেফের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট নির্মাণ হলো। এই প্লান্ট থেকে দেড়শ’ লাইন টানা হলো হাসপাতালে। এর মধ্যে একশ’ সংযোগ দেয়া হয় আইসোলেশন ওয়ার্ডের বেডে। এই লাইনের দ্বারা রোগীরা তার চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন পেতে থাকে। এই অক্সিজেন প্লান্ট চালু হওয়ার পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। অর্থাৎ আগে যেমন হাসপাতালে রোগী আনার পরও অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যেতো, সে সমস্যাটা দূর হলো। এ ক্ষেত্রেও অবদান ডাঃ দীপু মনি ও ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুর। এছাড়া তাঁরা দুজন চাঁদপুরের সিভিল সার্জন এবং হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও আরএমও’র সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে কোন্ কোন্ জায়গায় সমস্যা আছে তা জেনে নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নিতেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথেও তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন চাঁদপুরের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। করোনার এই ভয়াবহতার সময় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চাঁদপুর না আসলেও তাঁর বড় ভাই ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু সে সময় প্রায়ই চাঁদপুর এসেছেন, মানুষের খোঁজ-খবর নিয়েছেন, সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মানুষের পাশে ছিলেন।
করোনার এই ভয়াবহতায় চাঁদপুরের চিকিৎসা সেবাকে মানুষের চাহিদার কাছাকাছি নিয়ে আসার পেছনে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ পরিবারের অসামান্য অবদান হিসেবে দেখছে এই জেলাবাসী। সে জন্য জেলাবাসী তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।