রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত ৩ : এলাকায় আতঙ্ক
  •   শিক্ষা খাতে নজিরবিহীন রদবদল: একযোগে চার বোর্ড চেয়ারম্যানকে ওএসডি
  •   মধ্যরাতের আতঙ্ক
  •   চীনা সেনাদের ভারতের অরুণাচলে অনুপ্রবেশ: বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে
  •   আপনার টাকা কোথায় গেল?

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

সমীরণ দত্ত : ‘মনবাগানে’ মনের মাধুরি মিশিয়ে করেন তাবৎ শিল্পকর্ম

মিজানুর রহমান ॥
সমীরণ দত্ত : ‘মনবাগানে’ মনের মাধুরি মিশিয়ে করেন তাবৎ শিল্পকর্ম

গতানুগতিকতার বাইরের একজন মানুষ সমীরণ দত্ত। ব্যতিক্রম তাঁর কাজ। শাহরাস্তি পৌর এলাকার ৪নং ওয়ার্ডের ঘুঘুশাল গ্রামে ‘মনবাগানে’ মনের মাধুরি মিশিয়ে করেন তাঁর তাবৎ শিল্পকর্ম। গাছের পরিত্যক্ত শিকড় বাকড়ে কারুকার্যের মাধ্যমে শিল্পচর্চা করেন তিনি। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি পেশাদার কোনো শিল্পী নন।

২০১৮ সাল থেকে একটি বনজ নার্সারি ভাড়া নিয়ে তিনি এই শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এমন উদ্যোগ সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে যা ফেলনা, সমীরণ দত্তের কাছে তা-ই মূল্যবান।

সমীরণ দত্তের ব্যতিক্রম ও বিরল কর্মকাণ্ড দেখতে প্রায়শই চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন মানুষ 'মনবাগানে' ছুটে আসেন। স্বপ্নচারী সমীরণ দত্তের এই প্রদর্শনীর কোনো সময়সীমা বা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই যে কেউ সামান্য টাকার টিকিট কেটেই সকাল-বিকাল এই শিল্পকর্ম দেখতে 'মনবাগানে' ভিড় জমাচ্ছেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মনবাগানে আলাদা আলাদা স্থানে গাছের পরিত্যক্ত শিকড় বাকড় ও কাঠের টুকরো এবং গুঁড়ি দিয়ে তৈরিকৃত সমীরণ দত্তের কারুকার্যময় শৈল্পিক আসবাবপত্রগুলো সাজানো রয়েছে। এর মধ্যে কোনোগুলো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দৈনন্দিন ব্যবহার্য আসবাবপত্র, আবার কোনোগুলো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাখিসহ অন্যান্য জীবজন্তুর প্রতিচ্ছবি।

‘মনবাগনে’ গিয়ে আরো দেখা যায়, এর ভেতরে রয়েছে 'প্রিয় ভাষিনী আর্ট গ্যালারি মনবাগান আর্ট পার্ক'। ওই গ্যালারীতে প্রদর্শনী হিসেবে ব্যবহার্য আসবাবপত্র রাখা হয়েছে। সেখানে বড়ো সোফা, গাছের গুঁড়ি দিয়ে ব্যতিক্রমী খাট, শোপিচ স্ট্যান্ড, চেয়ার ও পোডিয়ামসহ অন্যান্য ২শ' শিল্পকর্ম রয়েছে। আর দামী আসবাবপত্রের মধ্যে প্রজাপতি, ঘোড়া, পাখি, টি-টেবিল আলাদা করে রাখা রয়েছে।

এই প্রতিবেদকের মুখোমুখি হন শিল্পী সমীরণ দত্ত। তিনি জানান, শিকড় বাকড় দিয়ে ছোট যেই ছাউনি তলে আমি কাজ করছি, ওই স্থানের নাম ‘আদি’। আর গাছপালাসহ পুরো সীমানাটার নাম হচ্ছে ‘মনবাগান’। সামনের একটু জলাশয়ের জায়গাসহ পুরো জায়গাটায় ৪৭ শতাংশ জমি রয়েছে।

‘কবে থেকে এই শিল্পচর্চা শুরু করেছেন’ জানতে চাইলে সমীরণ দত্ত বলেন, আমি এই পেশায় ১৯৯৯ সাল থেকে এসেছি। কেন এসেছি, কীভাবে এসেছি, কী পেলামণ্ড-এগুলো আমি নিজেও জানি না। এই শিল্প চর্চার ওপর আমার কোনো ডিগ্রি, এমনকি প্রশিক্ষণও নেই। ১৯৯৯ সালে এক বন্ধুর সাথে চট্টগ্রামে অক্সিজেন এলাকার রৌফাবাদে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি পরিত্যক্ত গাছের শিকড় আমার নজর কাড়ে। তা আমি তুলে এনে ছাল বাকল উঠিয়ে এর একটা অবয়ব তৈরি করি। এরপর সেটা নিয়ে যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক মনসুরুল করিম স্যারের কাছে। যা দেখে স্যার বললেন ‘সমীরণ তুমি শেষ’। এই শিল্পকর্মে যে একবার ঢুকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না, তুমিও পারবে না। আর শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। এখন প্রকৃতির গাছের শিকড় বাকড় যেটাই দেখি, সেটাতেই কিছু না কিছু অবয়ব খুঁজতে থাকি। আর এভাবেই এটিকে পেশাগত কাজ ধরে জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছি।

‘এই শেকড় সংগ্রহ করার মাধ্যম কী’ এমন প্রশ্নের জবাবে সমীরণ দত্ত বলেন, বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা সুন্দর শিকড় দেখে আমাকে খবর দেয়। আমি দেখতে যাই, কিনে আনি। কোনোটা কাজে না আসলে ফেলে আসি।

‘সবচেয়ে বেশি দামে আপনার বানানো আসবাবপত্র কী ছিলো?’--জবাবে সমীরণ দত্ত বলেন, এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টাকা দামে একটি ড্রয়িং টেবিল বিক্রি করেছি। যা লিচু গাছের শেকড় দিয়ে বানানো হয়েছিলো। এর সাথে মেহগনির শিকড় দিয়ে বানানো ৮টি চেয়ার ছিলো। যা বানাতে প্রায় ১৪ মাস সময় লেগেছে। আমাকে অজয় সূত্রধর নামে এক সহকর্মী পেশাগত এই কাজে সহযোগিতা করে থাকেন।

‘শিকড়ের বানানো এই শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো মেলা বা প্রদশর্নী করেছেন?’--জবাবে সমীরণ দত্ত বলেন, চীন মৈত্রী অর্থাৎ ঢাকা বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে ৩টি মেলায় অংশ নেই। এছাড়াও চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে ৭টি একক প্রদর্শনীসহ মোট ১০ বার এখন পর্যন্ত এগুলোর প্রদর্শনী করেছি। মূলত সৌখিন প্রকৃতির মানুষই এগুলো ক্রয় করেন।

‘ঘুঘুশালে আসার পূর্বে এই শিল্পচর্চা কোথায় কোথায় করেছেন?’-- জবাবে বলেন, ২০০৪ সালের দিকে ঢাকার গাজীপুরে একটি পোড়াবাড়িতে এই শিল্পচর্চা শুরু করি। তবে শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় পর্যাপ্ত জায়গা ওখানে না থাকায় অন্য স্থানে যাই। পরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়েও কিছুদিন এ কাজ করলেও বড়ো জায়গা এবং আর্থিক সঙ্কটে ওখানেও বেশিদিন টিকতে পারিনি। পরে সব নিয়ে শিল্পচর্চার অস্তিত্বের প্রশ্নে আপোষহীনভাবে নিজ গ্রামে এসেই এ কাজ পুরোদমে শুরু করেছি। ২০০৬ সালে ঢাকার গ্যালারি চিত্রে আমার এই শিকড় বাকড়ের প্রদর্শনী ১ম হয়েছিলো।

‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন কোথায়' জানতে চাইলে সমীরণ দত্ত বলেন, ফেনী ফাজিলের ঘাট হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণী থেকেই ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় পড়ালেখা করি। ওখান থেকে এসএসসি দেই। উত্তীর্ণ হয়ে পরে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে ১৯৮৬-৮৭ ব্যাচে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাস্টার্স শেষ করেছি।

'এ পেশায় পারিবারিক সাপোর্ট আছে কিনা' এমন প্রশ্নে সমীরণ দত্ত বলেন, বিয়ের আগে পড়াশুনা শেষে বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি নেই। বছর দেড়েক পরে স্বেচ্ছায় তা ছেড়ে দিয়েছি। পরিবার কখনোই আমার এ পেশা খারাপ চোখে দেখেনি। বিয়ের পর সন্তানদের বাবা হলাম। তখনও এগুলো নিয়ে পারিবারিক কলহ হয়নি। এখন এই শিল্পকর্মগুলো সংরক্ষণ করে ভালো অবস্থায় দেখতে পাওয়াটাই হচ্ছে আমার পরিকল্পনা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়