প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২১, ০০:০০
জেলে অনাথ দাস ১৮ বছর পূর্বে নিজের চাচাতো ভাই সুবল দাসের কাছ থেকে ৩ শতক জমি কিনেন। ক্রয়কৃত সেই জমি তিনি শেষ পর্যন্ত বুঝে পাননি। কিন্তু জমির দখলস্বত্ব বুঝে পেতে বছরের পর পর সালিস-বৈঠকসহ সকল কিছুই করেছেন। ত্রিশ হাজার টাকা জমির জন্যে খরচ করেছেন লাখ টাকা। শিকার হয়েছের মারধরের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই জমির জন্যেই তাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হলো। নিখোঁজের সাতদিন পর তার অর্ধগলিত দেহ উদ্ধারের পর ছায়াতদন্তে নামা পিবিআই হত্যাকা-ের রহস্যজাল ভেদ করলো।
পুলিশ সূত্র মতে, জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ভাড়াটে খুনির হাতেই খুন হতে হয় অনাথ দাসকে। এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িত কড়ৈতলী বাবুর বাড়ির পাশে থাকা সেকান্দর গাইন ওরফে শেখার ছোট ছেলে সোহাগকে পুলিশ আটকের পর সে হত্যার কথা স্বীকার করে। সোহাগের কাছ থেকে অনাথ দাসের মুঠোফোনটি উদ্ধার করে। এই হত্যাকা-ের সাথে জমি-সংক্রান্ত বিরোধের মূল হোতা সুবল দাসসহ ৪ জন জড়িত বলে জানা গেছে।
কে এই সোহাগ
নানার বাড়ির প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর থাকে সেকান্তর গাইনের দুই সন্তান। দক্ষিণ কড়ৈতলী গ্রামের লদ বাড়ির পাশেই তথা বাবুর বাড়ির পাশেই তাদের বাসস্থান। সোহাগ মূলত এলাকায় গাছী হিসেবে পরিচিত। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে সে গাছ কাটার সাথে সাথে দিনমজুরের কাজ করতো। সম্প্রতি সে এবং জনৈক টিটু লদ বাড়ির একটি পুকুর ইজারা নিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে নাম লেখায়।
সরেজমিন গেলে সোহাগের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আমেনা বেগম চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, তিনি ৬ বছরের ছেলে আরাফাতকে নিয়ে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। দুদিন পূর্বে সমিতির লোক পরিচয় দিয়ে কিস্তির বিষয়ে কথা বলতে এসেছে বলে তাদের ঘরের সামনে কয়েকজন লোক আসে। পরে তারা সোহাগের খোঁজ করে। এ সময় আমেনা বেগম, তার স্বামী সোহাগকে ফোন দেয়। যদিও তারা কোনো সমিতি থেকে ঋণ নেয়নি বলে জানায়। কিন্তু আমেনা বেগমকে দিয়ে সোহাগকে ফোন করিয়ে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সোহাগকে আটক করে পিবিআই। আমনো বেগম জানায়, তার নিজের মোবাইল ফোন ছাড়াও সোহাগের কাছে পাওয়া আরও একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তারা।
স্থানীয় বিভিন্ন লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোহাগ নেশার সাথে জড়িত। দিনমজুর হিসেবে কাজ করতো সে। তবে তার বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ নেই।
সরেজমিন এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, পিবিআই সোহাগকে আটকের পর বুধবার দুপুরে সোহাগের মামাতো ভাই কামরুল ও টিটু নামে দুজনকে আটক করে।
স্থানীয় লোকজন জানান, গত ১৯ জুলাই সোমবার সকালে তিনি কড়ৈতলীর পার্শ্ববর্তী শাহী বাজারে মাছ বিক্রি করতে যান। মাছ বিক্রি করে তিনিসহ লোকজন এসে কড়ৈতলী বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে চা খান। পরে সেখানেই তার কাছে একটি ফোন আসে। এরপর তার সঙ্গীদের কাছে তার কাজ আছে বলে চলে যান তিনি। এরপর থেকে তার আর খোঁজ মিলেনি।
ঘটনাস্থল
পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের দক্ষিণ কড়ৈতলী গ্রাম ও সাহাপুর গ্রামকে পৃথক করা ডাকাতিয়া নদীর শাখা খালের মধ্যে অনাথ দাসের লাশ পাওয়া যায়। লাশ প্রাপ্তির স্থান থেকে ঘাতক সোহাগের বাড়ি কয়েকশ’ গজ দূরে। খালের এক পাশে সাহাপুর গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির ধানক্ষেত এবং বিভিন্ন আবাদি ফসল। রয়েছে ঝোঁপ ঝাড়। অন্যদিকে বিপরীত দিকে রাস্তার পাশে পুকুর লদ বাড়িসহ আশপাশে বাড়িঘর রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, নানা সময়ে এই খালে বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহের গন্ধ ছড়াতো। এইসময় তারাও মনে করেছিলেন একই ধরনের কিছু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনাথ দাসের মৃত দেহই উঠে আসলো।
এলাকাবাসী জানায়, অনাথ দাস দীর্ঘদিন যাবৎ মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু কখনো তিনি মজুমদার বাড়ির সংলগ্ন ব্রিজের পাশ দিয়ে যাওয়া খালপাড়ের রাস্তায় চলাফেরা করতেন না। তিনি শাহী বাজার, কড়ৈতলী বাজারে মাছ বিক্রি করতেন।
নিহত অনাথ দাসের ভাই রঘুনাথ দাসের স্ত্রী স্বপ্না দাস চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, তার ভাসুর গত কয়েক মাস ধরেই তার স্বামী তথা ভাইয়ের সাথে তাদের ঘরে রাতযাপন করতেন। প্রতিদিন মাছ বিক্রির জন্যে বের হতেন এবং রাতে ফিরে আসতেন।
গত ১৯ জুলাই সোমবার সকালে তিনি কড়ৈতলীর পার্শ্ববর্তী শাহী বাজারে মাছ বিক্রি করতে যান। এর থেকে তার হদিস নেই। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ ছিলো। অনাথের দুই পুত্র বিকাশের স্ত্রী শিপ্রা দাস ও নয়নের স্ত্রী সুমী দাস চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, নিখোঁজের পর থেকে তার শ্বশুরের খোঁজে তারা এতোদিন বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি মাঝেমধ্যে তার বোন শেফালীর বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার পাইকদি গ্রামে না বলেই বেড়াতে যেতেন। পরে দুই/তিন দিন পর ফিরে আসতেন। এবারো হয়তোবা বোনের বাড়িতে বা অন্য কোথায় বেড়াতে গিয়েছেন। প্রথম ক’দিন এ চিন্তা করেছেন। তাছাড়া মোবাইল ফোনের চার্জার ঘরে থাকায় হয়তো মোবাইলে চার্জ নেই। কিন্তু গত রোববার দুপুরে লদ বাড়ির পাশের খালে লাশ পাওয়ার খবরে আমাদের লোকজন ছুটে গিয়ে আমাদের শ্বশুরের লাশ চিহ্নিত করে।
অনাথ দাসের ভাই রঘুনাথ দাসের স্ত্রী স্বপ্না দাস চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, ১৮ বছর পূর্বে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা সম্পত্তির জন্যে বছরের পর বছর ধরে নানা ঘটনা ঘটেছে। তার ভাসুর অনাথ দাস নিখোঁজ হওয়ার সপ্তাহ পূর্বে এই সম্পত্তি নিয়ে মারামারি হয় সুবল দাসের পরিবারে সাথে। সেই সময় অনাথ দাসকে হুমকি দেয়া হয়।