রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৫, ০৩:৪৬

শুধুই নাটক নয়, বাস্তব!

পুলিশের 'বন্দুকযুদ্ধে' পঙ্গুত্ব বরণকারী ভুক্তভোগীদের মর্মস্পর্শী বর্ণনা!

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন :মো. জাকির হোসেন
শুধুই নাটক নয়, বাস্তব!
ছবি : সংগৃহীত

সাতক্ষীরায় ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে পঙ্গু করার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ: কাঠগড়ায় তৎকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

১৩-১৬ সালের বিভীষিকাময় অধ্যায়; ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভুক্তভোগীরা, তদন্তে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল

২৪ মে ২০২৫: এক দশক আগের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফিরছে সাতক্ষীরার বহু মানুষকে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়, অমানবিক নির্যাতন এবং তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে নিরীহ মানুষকে পঙ্গু করার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। ‘চ্যানেল 24’ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘সার্চলাইট’ এ এসব ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পর ভুক্তভোগীরা এখন ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও এসব অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত শুরু করেছে।

'নী ক্যাপিং' - বিচারবহির্ভূত ভয়াবহতা

অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার এই পদ্ধতিকে ইংরেজিতে ‘নী ক্যাপিং’ বলা হয়। এটি নির্যাতনের একটি চরম সহিংস পদ্ধতি এবং বিচারবহির্ভূত শাস্তি। ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’ না করে আংশিকভাবে অক্ষম করে দেওয়া হয়, যাতে ভুক্তভোগী সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই ‘নী ক্যাপিং’ আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

রউফ ও রিয়াজুলের মর্মস্পর্শী বর্ণনা

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ইউনিয়ন বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রউফ ও তার ভাগনে ছাত্রদল নেতা রিয়াজুল ইসলাম ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আব্দুর রউফ জানান, মধ্যরাতে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সখিপুর কলেজ মাঠে হাঁটুর নিচে গুলি করা হয়। তিনি বলেন, "আগে কোনো মামলা ছিল না, রাজনীতিতে জড়িত থাকায় পরিকল্পিতভাবে গুলি করে।" ভেবেছিলাম আমাকে মেরেই ফেলবে, যখন পায়ে গুলি করা হয় বারবার শুধু সন্তানদের কথা মনে পড়ছিল। হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে তার পা পচে যায় এবং পরবর্তীতে পা কেটে ফেলা হয়।

রিয়াজুল ইসলামও একই পরিস্থিতির শিকার। তিনি জানান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই সাজানো বন্দুকযুদ্ধে তিনি ‘নী ক্যাপিং’ এর শিকার হন এবং তার পা এখন অকেজো।

প্রত্যক্ষদর্শীদের চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি

‘সার্চলাইট’ টিম সখিপুর কলেজ মাঠের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জহুরা খাতুনমাহফুজা খাতুনের সাথে কথা বললে তারা জানান, সেদিন কলেজ মাঠে পুলিশের উপর কোনো হামলা বা নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশি হামলায় আব্দুর রউফ ও রিয়াজুলকে গুলি করার বিষয়টি তারা নিজের চোখে দেখেছেন।

মিথ্যা মামলা ও প্রতারণার আশ্রয়

আব্দুর রউফের ঘটনায় দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই বছির উদ্দীন ছয় জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত এক থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করে একটি মিথ্যা মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। কিন্তু মামলার নিরপেক্ষ সাক্ষীরা জানিয়েছেন, মনগড়া কথা লিখে তাদের সই নেওয়া হয়েছে এবং ঘটনা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। পুলিশ এজাহারে দুজন মারা যাওয়ার কথা বললেও, তদন্ত প্রতিবেদনে হতাহতের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে – যা মামলার অসঙ্গতিকে স্পষ্ট করে।

রুহুল আমীনের করুণ পরিণতি

দেবহাটা উপজেলার গড়ানবাড়িয়া এলাকার রুহুল আমীনও ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামের সাজানো নাটকে তার এক পা হারিয়েছেন। তিনি বলেন, "থানায় নেওয়ার পর অনেক নির্যাতন করে, পরে আমার হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর রাতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।" এক পর্যায়ে সেখানে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে, এরপর পায়ে গুলি করে। তিনিও হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা পাননি এবং পা কেটে ফেলা হয়। রুহুল আমীনের বিরুদ্ধেও তৎকালীন এসআই মনিরুল ইসলাম মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলার সাক্ষীরাও ‘সার্চলাইট’ টিমকে জানিয়েছেন যে, তাদের অজান্তেই সাক্ষী বানানো হয়েছে এবং তারা ঘটনার কিছুই জানেন না।

বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা

সাতক্ষীরায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রায় শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ তথ্য সংগ্রহ করেছে ‘সার্চলাইট’ টিম, যার মধ্যে অন্তত ৫০টি ঘটনায় পা হারানোর অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশি নির্যাতনে পা অবশ করতে বিশেষ স্প্রে ব্যবহার করা হতো এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হতো। তৎকালীন জেলা প্রশাসন এসব ঘটনা জেনেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে, উল্টো উৎসাহ যুগিয়েছে।

ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভুক্তভোগীরা

৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। এরই মধ্যে জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল কবির, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম হাসান, হোসাইন শওকতইকবাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।

আইনি পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল

গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জানিয়েছেন, তৎকালীন জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাতক্ষীরায় এমন ধরপাকড় ও ‘নী ক্যাপিং’ নিয়ে তাদের তদন্ত সংস্থার কাছে অভিযোগ এসেছে এবং অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। শুধু পঙ্গু করার নয়, কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন, বাড়িঘরে আগুন, বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙা এবং ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগগুলোও ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করবে।

মামলার নথিতে বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার ফোন নম্বর না থাকা এবং তৎকালীন কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য না নেওয়া সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্বীকার করেছেন যে, নিজেদের আড়াল করতেই এমন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে সাতক্ষীরার দীর্ঘদিনের চাপা কান্না লাঘব হবে বলে আশা করছেন ভুক্তভোগী ও মানবাধিকার কর্মীরা।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়