প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
আম্মুরে আর তেমন মনে-টনে পড়ে না। শুধু হুট করে বাড়ি ফিরলে নিজের অজান্তে ‘আম্মু বইলা ডাইকা উঠি’। শুধু ওয়ার্ডরোবে কাপড় খুঁজতে গেলে আর কিছুই খুঁজে পাই না। ‘আম্মু আমার শার্টটা কই’ বলতে গিয়ে শুধু থমকে যাই।
নিজে কাপড় কখনও ধুয়ে দিলে আম্মু বলতেন, আমার কাপড় ধোয়ায় নাকি ময়লা যায় না। সব শার্ট যত্ন নিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিতেন আম্মু। এখন তাই সপ্তাহে দুই-তিনবার করে কাপড় ধুই। ময়লা যায় কিনা তা জানি না, কিন্তু কষ্টগুলা আর যায় না।
মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবদের ফোন আসে। ‘হ্যালো আম্মু বলো’ শুনলেই আমার ফোনের দিকে তাকাই। উহু ফোন আসে না। আসবে কেমন করে? নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলে কি আর ফোন আসে?
বছরখানেক পরে আমার দুঃখগুলোও ভোঁতা হয়ে গেছে। বাইরে যখন বৃষ্টি পড়ে, আমি ডাইনিংয়ে বসে তখন ভাতের দিকে তাকায়ে থাকি। আম্মুর হাতের খিচুড়ি খাওয়ার জন্যে তখন ভেতরটা হাহাকার করে। খিচুড়ির কথা মনে পড়ে, কই আম্মুকে তো আর মনে পড়ে না?
এখন বুঝি। বেশ ভালো করেই বুঝি যেই শহরে মা নেই, সেই শহর শুধুই শহর। ‘আমার শহর’ না।
আসলেই আর আম্মুরে মনে-টনে পড়ে না। যেই মানুষটা পুরো অস্তিত্ব জুড়ে, সেই মানুষটাকে আবার আলাদা করে কীভাবে মনে পড়বে? আগে আম্মুরে ধরতে পারতাম, ছুঁইতে পারতাম, কপালে আদর দিতে পারতাম। এখন আম্মু থাকে প্রতিটা হাহাকারে, প্রতিটা কান্নায়, প্রতিটা যন্ত্রণায়, প্রতিটা অসুখে।
এই যে এই ছবিটা। এই ছবিটা আমি প্রায়ই ঘুমানোর আগে দেখি। প্রচণ্ড কষ্টে যখন ঘুম আসে না, কাঁদতে কাঁদতে যখন চোখ জ্বালা শুরু করে তখন এই ছবিটা দেখি আর নিজেরে বুঝ দেই।
‘আম্মু ঘুমাচ্ছে, তুইও ঘুমায় যা’-- ঘুমায় যা!
১৩ আগস্ট ২০২০, আর ক’টি রাতের মতো স্বাভাবিক রাত ছিলো না, সংসারের বড় সন্তান হিসেবে আমাকেই সব কাজে যেমন এগিয়ে থাকতে হয়, এ ক্ষেত্রেও বিপরীত নয়।
মায়ের শাসনের কারণে আজ আমি সামাজের মানুষের সাথে বসতে পারি, ছোটবেলায় প্রাইমারির একমাত্র শিক্ষক হিসেবে মাকেই পেয়েছি। যখন আল আমিন একাডেমীতে পড়তাম তখনও মায়ের শাসন ছিলো কড়া, কখন স্কুল শুরু হলো, কখন স্কুল ছুটি হলো, বাসায় বসেই তিনি হিসেব রাখতেন। কখনও মানুষের কাছ থেকে কিছু চেয়ে নেওয়া শিখাননি বরং দুহাত ভরে মানুষকে দিতে শিখিয়েছেন।
মা হিসেবে তুমি ছিলে যেমন সেরাদের সেরা, গৃহিণী হিসেবেও ছিলে সেরাদের সেরা।
৫ জুন ২০২০-এ গর্ভধারিণী আম্মু যখন প্রথম মাথাব্যথা নিয়ে অসুস্থ হন, মুন হসপিটালে ভর্তি করাই, তখন চিকিৎসক স্বাভাবিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠালেও আম্মুর যখন অবস্থা অপরিবর্তিত, তখন সিটিস্কেন করিয়ে ডাঃ খালেদ মোশাররফ স্যারকে দেখালে তিনি জানান, আম্মুর ব্রেনস্ট্রোক করেছে। আমরা কালক্ষেপণ না করে এক দিনের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা কেন্দ্রে (ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিওরোসাইন্স হসপিটাল) চাঁদপুরবাসীর আস্থা ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু ভাইয়ের সহায়তায় (কেন্দ্রীয় হাসপাতালগুলোতে রেফারেন্স ছাড়া কিছুই হয় না) চিকিৎসা নিয়ে বাসায় আসি। অবস্থার উন্নতিও হয়েছিলো। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ১ মাস পর আবারো ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিওরোসাইন্স হসপিটালে নিয়ে যাই। সেখানে আরও অবস্থার উন্নতি হয়। ভেবেছিলাম আর সব মানুষের মতো আমর আম্মুও শীঘ্রই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। এদিকে আম্মুকে ছাড়া একমাত্র ছোট বোনটি ঘুমাতে পারতো না (যদিও সে অনার্সের একজন ছাত্রী)। যখন আম্মু হসপিটালে থাকতেন তখন ছোটবোনের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হতো-কবে আম্মু বাসায় আসবে, কবে আবার একসাথে ঘুমাবো। বড়ভাই হিসেবে আমার জন্যে যা ছিলো খুবই কষ্টদায়ক।
১ আগস্ট ২০২০ ছিলো ঈদ উল ফিতর (মায়ের সাথে জীবনের শেষ ঈদ)। সবসময় কোরবানির ঈদে আব্বুর সহায়তায় আমরা দুই ভাই আমাদের কোরবানির খাসি জবাই সহ যাবতীয় কাজ সমাপ্ত করলেও এ ঈদে আম্মু কেন জানি বারণ করার পরও আমাদের সকল কাজে (কাটাকুটি) সাহায়তা করেছে, যা কখনও ভোলার মতো না।
১১ আগস্ট আম্মু আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবার যুক্ত হয়েছে শ্বাসকষ্ট। তড়িঘড়ি করে স্থানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে ডাক্তারের পরামর্শে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করানো হয়। তখন তীব্র শ্বাসকষ্ট। আব্বু গিয়েই ওয়ার্ড বয়কে ধরিয়ে দিলো ৫০০ টাকা, যাতে অক্সিজেন সঙ্কটে না পড়তে হয়। করোনা স্যাম্পল দেয়া হলো। ১২ আগস্ট তখন অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিলো।
করোনা রিপোর্ট আসবে আগামীকাল দুপুরে, ততক্ষণে অপেক্ষা করতে হবে। সবকিছু চলছে স্বাভাবিক। রাত ১০টায় ছোটবোন নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। আব্বুর সাথে কথাবার্তা বললো। পরস্পরের কাছে পরস্পর মাফ চাইলেন। অতঃপর সবাইকে বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার পরামর্শ দিয়ে বিদায় দিলেন।
কে জানতো সবকিছু এমন করে হবে!
এদিকে রাত ১১টায় ফুফা (জনাব আলী আশর্^াদ মিয়াজী, সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ)-এর মাধ্যমে জানতে পারলাম, তিনি আরটিপিসিআর ল্যাবে খোঁজ নিয়েছেন, আম্মুর করোনা নেগেটিভ, আলহামদুলিল্লাহ।
রাত তখন ১টা। হঠাৎ করেই আম্মুর আবারও অক্সিজেন সমস্যা শুরু হলো। অক্সিজেন মিটার বাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ করে দিলাম। ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে ৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ করালাম। কর্মরত নার্স আসলেন অক্সিজেন লেবেল মাপা হলো। দেখা গেলো মাত্র ৬৫ আছে। দিগি¦দিক ছুটছি কী করা যায়। ডিউটি ডাক্তার আসলেন। পরামর্শ দিলো ঢাকা রেফার করতে। ততক্ষণে রাত ৩টা। আব্বুকে ফোন দিলাম। আর আমি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি অক্সিজেন লেভেল বাড়ানো যায় কিনা। কমতে কমতে ১৮-তে নেমে গেলো, আবার প্রাণপণ চেষ্টায় ৬৫ পর্যন্ত উঠলো। এদিকে আম্মু বারবার পানি চাইলে, আমি পানি পান করিয়ে দিচ্ছি। ছোট ভাই ছফিউল্লাহ রাত সাড়ে ৪টায় এ হাসপাতালে হাজির। তাকে রেখে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে বাসায় উদ্দেশ্য রওনা দেই আমি। বাসায় রওনা দেয়ার সাথে সাথে আব্বু ফোনে জানান, আমিও হাসপাতালে আসতেছি, তুই বাসায় এসে রেডি হ। তখন বাসায় গিয়ে গোসল করে আবার হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দেই। হাসপাতালের নিচতলায় যেতেই আব্বুর চিৎকার শুনতে পাই। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার প্রাণপ্রিয় গর্ভধারিণী মা আর দুনিয়ায় নাই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। নিচতলা থেকে একদৌড়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
আম্মুরে দেখি না অনেকদিন, হেয়ও আমারে দেখে না। আম্মু কি জানতো না, এতিম হওয়ার কী কষ্ট! বন্ধুরা দরকার পড়লে মাকে কল দেয়, আবদার করে। আমি পারি না!! দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়। এই বাতাস নদীতে পড়লে সব জলজ্যান্ত মাছ কাইন্দা উঠতো। বড়শিতে আটকাইলে তাও নিজেরে দোষারোপ করা যায়; কিন্তু ভাগ্যে আটকাইলে ? মায়ের শূন্যতা প্রতিক্ষণেই অনুভব করি। আর তখনই দোয়া করি ‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানী ছাগীরা’।
রোঃ ওবায়দুর রহমান তালুকদার : শিক্ষক তরপুরচণ্ডী দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, চাঁদপুর ; জয়েন্ট সেক্রেটারী, রোটার্যাক্ট ক্লাব অব চাঁদপুর।