বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

বৌদ্ধ ধর্ম ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে ‘আমার দেখা নয়া চীন’
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

পৃথিবীজুড়ে এক অনন্য সাধারণ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর মনন ও চেতনায় ধর্ম কখনো মানবিকতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ধর্ম বলতে তাঁর কাছে কেবল পবিত্র গ্রন্থসমূহে বিধৃত আদেশমালা ছিল না, ধর্ম বলতে তাঁর কাছে মন্যুষত্ব বোধের উন্মেষই ছিল প্রধান। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানে যুক্ত করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলিম, বাংলার খৃস্টান আমরা সবাই বাঙালি’। এই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐক্য ও প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার পরে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে তিনি সমতলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের যেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন তেমনি সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন উপজাতীয় বৌদ্ধ সুদীপ্তা দেওয়ানকে। তিনি সরকার প্রধান হিসেবে বিদেশ সফরকালে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন বাসস-এর সাংবাদিক ডি পি বড়ুয়া বা দেবপ্রিয় বড়ুয়াকে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর নজরে ও নৈকট্যে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় সব সময় বিশেষ অবস্থানে ছিল। তা আরো পরিষ্কার বুঝা যায় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের গৃহ শিক্ষক শ্রীমতী গীতালি দাশগুপ্তার স্মৃতিচারণমূলক বর্ণনা থেকে। শেখ রাসেলকে গৃহশিক্ষকরূপে পাঠদান করতে গিয়ে তিনি একদিন মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে আলোকপাত করেন। বুদ্ধের চরিত্র শেখ রাসেলকে এতোটাই ভাবিয়ে তুলেছিল যে, শিশু রাসেল সারারাত তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে নিজের মনের কৌতূহল মেটান। পরদিন গীতালিদি শেখ রাসেলকে পড়াতে গেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বলেন, মাস্টর, তুই করলি কী? তুই তো আমার সর্বনাশ করছস্। তোর ছাত্র তো আমাকে গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। সে আমাকে বলে, আমি কেন গৌতম বুদ্ধ হইলাম না! বঙ্গবন্ধুর বলার সময় তাঁর অভিব্যক্তিতে এতোটাই সমীহ ছিলো যে, বুঝতে অসুবিধা হয় না, গৌতম বুদ্ধের চরিত্র বঙ্গবন্ধুর প্রিয় চরিত্রগুলোর অন্যতম ছিল।

চীন ভ্রমণ বঙ্গবন্ধুকে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে জানতে আরো বেশি সুযোগ তৈরি করে দেয়। প্রথমবার ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে নয়া চীনের বিপ্লবের জয়ন্তীকালে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি চীনে গমন করেন। যাওয়ার পথে তাঁদের যাত্রাবিরতি হয় বার্মায়। তখন বার্মায় ছিলো উ্য ন্যু-এর শাসন। শেখ মুজিব শহর দেখতে বের হলে তাঁর চোখে পড়ে সুদৃশ্য প্যাগোডা। তাঁর ভাষায়, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বানানো প্যাগোডাগুলো দেখতে মনোরম। বার্মা হতে চীনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভুল ধারণা ভাঙানোর চেষ্টায় ছিলেন। তিনি জানতেন, কমিউনিস্ট দেশগুলোতে ধর্ম চর্চায় নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু তিনি স্বচক্ষে দেখেন, সেই লোকমুখে ছড়ানো গুজব নিছকই সব মিথ্যে। তিনি শতকরা আশি ভাগ বৌদ্ধদের নিবাস নয়া চীনে কোন ধর্মীয় কারণে বৈষম্য দেখতে পাননি। চীনে চিয়াং কাইশেকের আমলে যে বৌদ্ধ ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের প্রভাব দেখা যেত তার বর্ণনা আমরা বঙ্গবন্ধুর অনুভূতি থেকে জানতে পাই। আবার তিনিই আমাদের জানাচ্ছেন, নয়া চীনে যোগ্যতার ভিত্তিতে সবকিছুর পরিমাপ হয়, সংখ্যার ভিত্তিতে নয়। তিনি লিখেছেন, আশি ভাগ বৌদ্ধদের দেশে ওই অনুপাতে কর্মের সুবিধা বা নিয়োগ দেয়া হয় না। সবকিছুতেই কে যোগ্য তা চিন্তা করা হয়, ধর্ম নয়। এর পাশাপাশি তিনি তৎকালীন পাকিস্তানে বিদ্যমান ধর্মীয় হানাহানি ও বৈষম্যের তুলনা করে ব্যথিত হন। তিনি জেনে বিস্মিত হন, কেননা সেখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় কালচারাল এসোসিয়েশনের পাশাপাশি মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কালচারাল এসোসিয়েশনেরও অস্তিত্ব আছে। তাঁর মতে চিয়াং কাইশেকের আমলে চীনে বৌদ্ধদের ধর্মীয় কুসংস্কার অত্যন্ত বেশি ছিল, যা নয়া চীনের অক্টোবর বিপ্লবের পরে কমে এসেছে। তিনি আক্ষেপ করেছেন, এক সময় চীনে মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতির চর্চার পরিবর্তে হিংসা ও হিংস্রতা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নয়া চীন তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

তাঁর চীন ভ্রমণকালে তাঁরই সফর সঙ্গী পীর মানকি শরীফরা যখন অন্য কিছু দর্শনে ব্যস্ত ছিলেন তখন শেখ মুজিবুর রহমান চীনের বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলো আগ্রহ নিয়ে দর্শন করেছেন। তাঁর রচনায় চীনের ছোট্ট দ্বীপের হ্রদে নৌকা চালাতে গিয়ে চোখে পড়া প্যাগোডাটিও উঠে এসেছে যথাযথ শ্রদ্ধায়। চীনের উন্নত কৃষি সম্পর্কে জানতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কো-অপারেটিভ ফার্মিং বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। নয়া চীনে পাটের বিশেষ চাষ শুরু হয়েছে। তিনি যখন এই পাট চাষ সম্পর্কে ধারণা নিতে যান তখনও দূরে দেখা বৌদ্ধ প্যাগোডা দর্শন করে আসেন। বহু পুরানো নিদর্শনে ভরা সে প্যাগোডায় বছরে হাজার হাজার পুণ্যার্থী প্রার্থনায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর চীন ভ্রমণের নেটবুকে একজায়গায় বুদ্ধমূর্তি নিয়ে আফসোস ও আক্ষেপ লিপিবদ্ধ ছিল। তিনি দুঃখ ভরে বলেছেন, বিদেশি লুটেরারা এইসব বুদ্ধমূর্তির গা থেকে মূল্যবান পাথর-রত্ন খুলে নিয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থ পাঠ করে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর এই ভ্রমণে দুটো বিষয়ে আগ্রহ ছিল। প্রথমত নয়া চীনের দ্রুত উন্নয়ন ও বিপ্লব এবং দ্বিতীয়ত চীনে অন্যান্য ধর্মসহ বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা পর্যবেক্ষণ। বলা বাহুল্য, তাঁর সেই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ছিল। তিনি কমিউনিস্ট শাসিত নয়া চীনে ধর্মের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা খুঁজে পাননি এবং সংখ্যাগরীষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মেরও কোন বাড়াবাড়ির হদিস পাননি। বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় বুদ্ধের অহিংসা নীতির সফল বাস্তবায়ন নয়া চীনে শান্তিকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দিতে পারে। তিনি অক্টোবর বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে নতুন এক চীনকে আবিষ্কার করে অভিভূত হন এবং সেই ভ্রমণ হতেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রেরণার বীজ নিয়ে আসেন মস্তিষ্কের নিউরনে বয়ে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়