প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা? নিজের মায়ের ভাষা (হিন্দি) ভুলতে বসেছে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা। এ ব্যাপারে নেই সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ। কেউ কি মাতৃভাষা ভুলতে পারে? আলাপ করে দেখা গেছে, স্কুলের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা নিজ বাড়িতে সারাক্ষণ হিন্দি ভাষায় কথা বললেও বাইরে ও স্কুলে এ ভাষায় তারা কথা বলছে না। বললেও তারা কথা বলছে হিন্দি-বাংলা মিশ্রণে। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। মনের এ কথা কাউকে বলতেও পারছে না। স্কুলে তাদের ভাষার কোনো টেক্সটবুকও নেই। শহরের একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ৪র্থ ও ৩য় শ্রেণির ছাত্রী সাধনা ও নিমিষা নামের ২ ছাত্রীকে তাদের স্কুলের সহকারী শিক্ষিকার সামনে প্রশ্ন করলে তারা জানায়, তারা বাড়িতে সবসময় হিন্দি ভাষায় কথা বলে, কিন্তু বাড়ির বাইরে বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে (বাংলা ভাষা পরিবেশ ও স্কুল থেকে শিখেছে) কথা বলে। পরীক্ষার খাতায় বাংলায় লিখে। এতে করে তারা নিজেদের হিন্দি ভাষা ভুলতে বসেছে। হিন্দিতে কথ্য ভাষা জানে, কিন্তু হিন্দি লিখিত কোন্ বর্ণ/ হরফ তা তারা চিনে না। সাধনা জানায়, সে মাত্র হিন্দির ২টি বর্ণ/হরফ চিনে। আর কিছু চিনে না। নিমিষা জানায়, সে কোনো হিন্দি বর্ণই চিনে না। শহরের আজিমিয়িা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হরিজন সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীও একই কথা জানায়। তারাও হিন্দি বর্ণ চিনে না। শহরের পুরাণবাজারের আরো কিছু হরিজন ছাত্র-ছাত্রীদেরও একই অবস্থা।
আলাপ করলে জেলা শহরের স্বর্ণখোলা এলাকার হরিজন সম্প্রদায়ের একজন সচেতন প্রতিনিধি বিধান হরিজন (২৪) ও অন্য কজন হরিজন জানান, আমরা বাপ-দাদাসহ পাক আমল থেকেই এখানে বসবাস করছি। কেউ আমাদের দিকে তাকায় না। আমাদের মাতৃভাষা হিন্দি তো কেবল বাড়িতে ব্যবহার করি। চাঁদপুর শহরের নতুনবাজার, পুরানবাজার ও বড় স্টেশন রেলওয়ে হরিজন কলোনী মিলিয়ে প্রায় পাঁচশ’ হরিজন পরিবার এই শহরে আছে। উপজেলাতেও আছে বেশ কিছু পরিবার। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কাজ কাম করতে হয় জীবিকার জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় আলোকিত মানুষ হবার জন্যে। কিন্তু স্কুলগুলোতে আমাদের হিন্দি ভাষায় কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই। তাই আমাদের সন্তানেরা বাড়িতে হিন্দি ভাষায় কথা বললেও হিন্দি বর্ণমালা চিনে না, হিন্দিতে স্বাক্ষর তো দূরের কথা। মাতৃভাষায় কথা বলাতো সাংবিধানিক অধিকার। আমরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
এ ব্যাপারে আলাপ করলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামালসহ বেশ কজন শিক্ষক জানান, এদের জন্যে আলাদা পাঠ্যপুস্তক থাকা দরকার। মাতৃভাষা বলে কথা। পাহাড়ি এলাকায় ভিন্ন ভাষায় পাঠ্যপুস্তক আছে, শিক্ষকও আছে। এদের জন্যেও থাকতে পারে। এটা সরকারের উদ্যোগের ব্যাপার।
একই মতামত ব্যক্ত করেছেন (সদ্য সাবেক) জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ সাহাবউদ্দীন। তিনি বলেন, সারাদেশেই এরা ছড়িয়ে আছে। রাজশাহীতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি । পাহাড়ি ও পার্বত্য জেলায় মারমা, চাকমা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক আছে। সেখানে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ লিখা পাঠ্যপুস্তক আছে। সেভাবে হরিজন সম্প্রদায়ের জন্যও আলাদা পাঠ্যপুস্তকও থাকতে পারে। সরকার এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে পারে। ক’জন সিনিয়র সিটিজেন বলেন, এরাতো এদেশেরই নাগরিক, ভোটারও। দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এরাও শিক্ষায় ও চাকরি-বাকরিতে সমান সুযোগ সুবিধার অংশীদার। এরা বঞ্চিত হতে পারে না। কারণ শিক্ষা হলো ‘অধিকার, প্রিভিলিজ নয়।’