রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪

ক্ষণিক আলোয় দেখা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ক্ষণিক আলোয় দেখা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

চিরজীবনের দেশে চিরসবুজ হয়ে ফিরে গেলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ, আমাদের ধ্রুবতারা বাতিঘর অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ওনার সরাসরি সাহচর্যের সৌভাগ্য আমার বেশি না হলেও দুয়েক দফায় আমি তাঁর মুগ্ধ জ্যোতির্ময়তায় আবিষ্ট ছিলাম। তাঁকে নিয়ে আমার সেই অল্প কতক স্মৃতি আজও সমুজ্জ্বল।

তাঁকে সরাসরি প্রথম দেখি পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার দুহাজার ঊনিশ সালের ফাইনালের পূর্বরাতে। এ প্রতিযোগিতার সাথে আমার বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্টতা। সেই সুবাদে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের নির্দেশে আমি ষোল জুন দুহাজার ঊনিশ তারিখ রাতে হোটেল গ্র্যান্ড হিলশায় যাই আমাদের ফাইনাল পর্বের অতিথিবৃন্দকে স্বাগত জানাতে। প্রতিযোগিতার অন্যতম আয়োজক কামরুল ইসলাম শায়ক ভাই তাঁর অতিথিদের নিয়ে উঠেছিলেন তিন তারকা মানের এই আবাসিক হোটেলে, যা চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত। সেবার অতিথি হিসেবে এসেছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের, কবি মারুফুল ইসলাম ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। তাঁদের স্বাগত জানিয়ে হোটেলের লবিতে চায়ের আড্ডায় আমিও শামিল হয়েছিলাম। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বাচনভঙ্গির পরিমিতিবোধ ও সরস আড্ডার প্রাঞ্জলতা রক্ষার দক্ষতা সেদিন আমাকেও মুগ্ধ করে রেখেছিলো আপন গুণের শক্তিমত্তায়। যদিও আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্য ও বিতর্কশিল্পের প্রতি প্রেম আমার মজ্জাগত। তাই তাঁর লেখা আমার পাঠবিশ্বের সীমায় বেশ ভালো অবস্থানেই ছিলো। মাঝখানে তিনি কেবল প্রথম আলো পত্রিকার লেখক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ থাকায় কিছুটা অভিমানও জমেছিলো। ষোল জুনের প্রাণবন্ত সে আড্ডার পর শায়ক ভাইয়ের নেতৃত্বে তাঁরা চলে গেলেন চাঁদপুর বড় স্টেশনে তাজা ইলিশ গরম গরম ভাজা খাওয়ার পূর্ব নির্ধারিত অভিপ্রায়ে। আমারও যাওয়ার দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু পরদিন ভোরে উঠে প্রতিযোগিতাস্থল চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে হাজির থাকতে হবে বিধায় হোটেলের আড্ডা উপভোগ করে বাসায় ফিরে যাই। স্বল্প সময়ের সে আড্ডায় একটা বিষয় বুঝলাম, স্যার কেবল ভালো বক্তাই নন, একজন উৎকৃষ্ট শ্রোতাও বটে। তিনি আড্ডার প্রতিটা চরিত্রের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী নিজের মন্তব্য ব্যক্ত করেছিলেন।

পরদিন সতের জুন ছিলো পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনাল। আমরা একটানা পাঁচটা ধারা ও শ্রেণিভিত্তিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফাইনাল সম্পন্ন করলাম। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সনাতনী বাংলা , উন্মুক্ত শ্রেণিতে (প্রাথমিক ব্যতীত) সনাতনী ইংরেজি এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদীয় ধারার বিতর্ক। মিলনায়তনে উপস্থিত থেকে স্যার শেষের তিনটা বিতর্ক ফাইনাল উপভোগ করেছিলেন। এরপর তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরণ করেন। প্রতিযোগিতায় আমার বড়ো ছেলে প্রত্ন পীযূষও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, স্টেডিয়াম শাখার পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করে ইংরেজি সনাতনী বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। স্যারের হাত থেকে ছেলে যখন পুরস্কার গ্রহণ করে, তখন তার নামের সাথে পীযূষ যুক্ত আছে দেখে স্যার মন্তব্য করেন, নিশ্চয়ই পীযূষের ছেলে। এর আগে প্রতিযোগিতার বিভিন্ন স্তরে বিচারকার্য সম্পন্নকারী বিচারকদের সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়। আমার পত্নী মুক্তা পীযূষ ফাইনালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিতর্ক মূল্যায়নকারী একজন বিচারক ছিলেন। তিনিও স্যারের কাছ থেকে তার সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। পুরস্কার বিতরণ শেষে পরবর্তী বছরের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় স্লোগান অবমুক্ত করার সময় স্যার দুবার স্লোগানটি পাঠ করেন। জানতে চান কে দিয়েছে। শাহাদাত ভাই জানালেন, পীযূষদা দিয়েছে। স্যার তা শুনে বললেন, ও! পীযূষ দিলে তো এরকমই সুন্দর হবে। অল্প সময়ের সান্নিধ্যে স্যার যে কী সুন্দর আপন করে নিয়েছিলেন আমায়! স্লোগানটি ছিলো, ‘ বিতর্কে আজ নতুন জোয়ার/ যুক্তিতে যুগ খুললো দুয়ার।’

উল্লেখ্য, পরের বছর ছিলো আমাদের এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার যুগপূর্তি। তাই স্লোগানে ‘যুগ’ কথাটির উল্লেখ ছিলো সঙ্গত কারণেই।

স্যারের সাথে পরবর্তী সময়ে দেখা হয় দুহাজার চব্বিশের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঢাকাস্থ সরকারি বাসভবনে। ভারতের লক্ষ্ণৌ থেকে আগত একজন গুণী সংগীতজ্ঞের উচ্চাঙ্গ সংগীতের জলসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচসহ আরও অনেক গণ্যমান্য সংগীত ও সংস্কৃতিপ্রেমী গুণীজন। সেখানেও স্যার স্নেহের হাসি মেখে সেল্ফিতে আবদ্ধ হলেন আমার সাথে।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাদের মন ও মননের এক অনন্য রবিরশ্মি। তাঁর প্রয়াণ আমাদের ব্যথিত করে, বিদীর্ণ করে দেয় হৃদয়। নিয়তিকে মেনে নিয়ে তাঁর প্রস্থান আমাদের স্বকালের আঁধারকে আরও গাঢ় করে দিয়ে গেলো। যেখানে তিনি গেছেন, সেখানেই তাঁর যোগ্য স্থান হোক, শান্তি অটুট থাকুক। অনন্তের কোলে বিলীন হওয়া কালের শিশু ভালো থাকুন চিরজীবনের রথে পরিব্রাজন করতে করতে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়