প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

চাঁদপুর জেলায় প্রথম নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য হচ্ছে ‘অঙ্গীকার’। এটি জেলার কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে বিবেচিত। চাঁদপুরের দ্বিতীয় জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম শামসুল আলম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি এ ক্ষেত্রে জাতীয় মান রক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামক বহুল পরিচিত ভাস্কর্যের নির্মাণ শিল্পী (ভাস্কর) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগে কর্মরত প্রফেসর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের শরণাপন্ন হন। জেলা প্রশাসকের পক্ষে তৎকালীন ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনির আহমেদ প্রফেসর খালিদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে 'অঙ্গীকার' নির্মাণে রাজি করান এবং চাঁদপুর নিয়ে আসেন। তিনি চাঁদপুর শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় অবস্থান নেন এবং কয়েক মাসের চেষ্টায় ‘অঙ্গীকার’ নির্মাণ কাজটি সুসম্পন্ন করেন। চাঁদপুর শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান হাসান আলী হাই স্কুল মাঠের সম্মুখে অবস্থিত সুদৃশ্য রেলওয়ে লেকের মাঝামাঝি স্থানে ‘অঙ্গীকার’টি নির্মাণ করা হয়। যার ফলে পানিতে ভরপুর লেকে ‘অঙ্গীকার’কে ভাসমান মনে হয় এবং অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যপট তৈরি হয়। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সশরীরে এসে এই ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। ফলস্বরূপ ভাস্কর্যটি ব্যাপক আলোচনা ও পরিচিতির আওতায় চলে আসে এবং দেশের অন্যতম নান্দনিক ভাস্কর্য হিসেবে সমাদৃত হয়। চাঁদপুর শহর ও জেলার বিভিন্ন স্থানের লোকজন এবং চাঁদপুর ঘুরতে আসা পর্যটক/ভ্রমণকারীদের নিকট বড়ো আকর্ষণে পরিণত হয়। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং বিজয় দিবসসহ অন্যান্য উপলক্ষে এই ‘অঙ্গীকার’ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের প্রধান স্থান তথা কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধের মর্যাদা পায়, যেটি এখনও অক্ষুণ্ন। ‘অঙ্গীকারে’র কারণে জেলা প্রশাসক এসএম শামসুল আলমের অনুরোধে তৎকালীন চাঁদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী তাঁর পরিষদের অনুমোদনে ‘অঙ্গীকার’ সম্মুখস্থ স্টেডিয়াম রোডের নাম পরিবর্তন করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়ক নামকরণ করেন। এছাড়া এই ‘অঙ্গীকারে’র সম্মুখে হাসান আলী হাই স্কুল মাঠে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ বছর যাবত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির স্থানীয় উদ্যোক্তারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা আয়োজন করে, যেটির পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২১ সালে চাঁদপুর আউটার স্টেডিয়ামে স্থানান্তর করা হয়।
‘অঙ্গীকার’ এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও জেলা প্রশাসন এটি নির্মাণের পর এটির রক্ষণাবেক্ষণে কোনো কমিটি করে না দেয়ায় এটি অযত্ন-অবহেলার শিকার হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা কর্তৃপক্ষ মেলা উদ্বোধনের প্রয়োজনে প্রতিবছর নিজস্ব সীমাবদ্ধতায় এটি টুকটাক সংস্কার করলেও সেটা পূর্ণাঙ্গ ছিলো না। সেজন্যে চলছিল অনেক বলাবলি ও লেখালেখি। অবশেষে স্থানীয় সুধীবৃন্দের দাবিতে চাঁদপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল ২০২২ সালের মার্চ মাসে এটির অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজে হাত দেন। তার কিছুদিন পর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বিভাগীয় কমিশনার থেকে ২ লাখ টাকা অনুদান এনে মূল ভাস্কর্যের সংস্কার করেন। তবে শিল্পীর ভুলের কারণে সমালোচিত হন, যদিও উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হন। কিন্তু এ দুটি সংস্কারেও যে ‘অঙ্গীকার’ পূর্ণ সংস্কার হয়নি সেটি অতি সম্প্রতি চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়।
‘ঝুঁকিপূর্ণ ‘অঙ্গীকার’ সংস্কার করছে চাঁদপুর পৌরসভা’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, চাঁদপুর শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আর সেজন্যে এটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে চাঁদপুর পৌরসভা। ২০২২ সালর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এই ‘অঙ্গীকার’ সংস্কারের ফলক লাগিয়েছেন। তখন সংস্কারের নামে এটিকে তুলির আঁচড়ে রং করা হয়েছে মাত্র। এটির ভেতর যে খোলসা হয়ে আছে সেটাকে আর পরখ করে দেখা হয় নি। লেকের পানি অনেক নিচে নামায় ‘অঙ্গীকারে’র এই দুর্দশার ভয়াবহ চিত্র ভেসে ওঠে। সম্প্রতি রেল কর্তৃপক্ষ লেকের দক্ষিণ পাশে গাইডওয়াল নির্মাণ করার জন্যে লেকের পানি সেঁচে কমিয়ে ফেলে। পানি লেকের তলদেশে চলে আসার পর ‘অঙ্গীকারে’র নিচের অংশের দুর্দশার কিছু চিত্র ফুটে ওঠে। এই চিত্র দেখে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মোঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল অঙ্গীকারটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, লেকের পাড় থেকে ‘অঙ্গীকার’ বেদিতে হেঁটে যাওয়ার জন্যে মোজাইক এবং ঢালাইয়ের যে পথটুকু রয়েছে, সে পথের নিচে অনেক অংশের পলেস্তরা খসে পড়ে রড বের হয়ে আছে। চিত্রটি খুবই ভয়াবহ। অবস্থা দেখে বোঝা যায়, এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। মানুষের ভারে হয়তো এটি ধসেও পড়তে পারে। এছাড়া ‘অঙ্গীকারে’র পুরো অবকাঠামোটিতে যে ক’টি পিলার রয়েছে সেগুলোরও বেশ দুরবস্থা। এই চিত্র দেখে মেয়র পুরো অঙ্গীকার সংস্কারের নির্দেশনা দেন। সেমতে কাজ চলে।
মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, অঙ্গীকারটি চাঁদপুর শহরে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি যেমনি আমাদের গৌরবের চিহ্ন, তেমনি লেকের ওপর এমন একটা ভাস্কর্য লেকের সৌন্দর্যকে অনেক বৃদ্ধি করেছে। এখানে মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসসহ নানা জাতীয় দিবসে আমরা শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করি, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এমন ভগ্নদশা থাকতে পারে না। সেজন্যে আমরা চাঁদপুর পৌরসভা থেকে এটিকে পুরোপুরি সংস্কারের উদ্যোগ নেই। আশা করছি আসছে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের পূর্বেই সংস্থার কাজ শেষ করতে পারবো।
‘অঙ্গীকার’ নিঃসন্দেহে জেলা প্রশাসনের স্থাপনা। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য বলে সকলের আবেগের মোক্ষম স্থান। সে কারণে এই স্থাপনার প্রতি নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়রের অনারোপিত দায়িত্ববোধ থাকাটাই যথার্থ। সেই দায়িত্ববোধ থেকে তিনি ২০২২ সালের পর চলতি ২০২৩ সালেও ‘অঙ্গীকার’ সংস্কার কাজ করছেন, যেটি সপ্রশংস অভিব্যক্তিতে অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদযোগ্য বলে আমরা মনে করি।