প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩০
ভারতবর্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান
খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র খ্রিস্টান ও ইহুদী সম্প্রদায় যখন অজ্ঞতা ও মুর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তখন পশ্চিমে আন্দুলুসিয়া (স্পেন) থেকে পূর্বে খোরাসান ও গজনী (পাক-ভারত উপমহাদেশ) পর্যন্ত এই বিশাল ভূখণ্ডে মুসলিম গবেষক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন নতুন আবিস্কার এবং গবেষণা দ্বারা সমগ্র বিশ্বে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেন। মুসলিম বিশ্বে এই সময়কালে প্রাচীন মিশরের, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, ভারত, গ্রীক ও রোমানদের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির পণ্ডিতগণ তাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করেনÑযা বিশ্বের ইতিহাস কে জানার জন্য আমাদের সাহায্য করে। তাঁদের সেই অবদানের কারণই আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞান হয়েছে এত সমৃদ্ধ ও প্রসারিত।
প্রত্যেক জাতিরই একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় থাকে। তেমনি মুসলমানরা মধ্য যুগে একটি সোনালি অধ্যায় রচনা করেছিল। মুসলিম গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবীদ, শিল্পী, সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ এবং শিক্ষাবিদগণ শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য-সভ্যতায় অবদান রেখে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল। জন্ম দিয়েছিল আধুনিক বিজ্ঞানের। মধ্যযুগের সেই সমুন্নত মুসলিম সভ্যতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ইতিহাসের পাতায় বিধৃত হয়েছে। এ কথা সূর্যালোকের মতো সত্য যে, তৎকালীন বিশ্বের সর্বোউন্নত সভ্যতা তথা মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসেই ইউরোপীয় সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনা হয়।
প্রাচীন মিশর আরব পারস্য আন্দুলুসিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মুসলিম মনীষী দার্শনিক বিজ্ঞানীগণ চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ভূগোল, অর্থনীতি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভূমিকা রেখে বিজ্ঞানের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনা, আল-ফারাবী, আল-কিন্দ, ইবনে হায়সাম, ইবনে রুশদের মতো বিজ্ঞানীরা জগৎ কাঁপানো আবিস্কারের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রেখেছে। রসায়নশাস্ত্রে জাবির ইবনে হাইয়ান, মুসা আল খাওয়ারিজমী, ইবনে খালদুন। ভূগোল শাস্ত্রে আল-মাসুদী, আল-বিরুনী, ইবনে বতুতা। গণিতশাস্ত্রে মুসা আল খাওয়ারিজমী, ওমর খৈয়াম-এর মতো বিজ্ঞানীরা তাদের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন দিক থেকেই পিছিয়ে ছিল না ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম দার্শনিক ও মনীষীগণ। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম বিজ্ঞানীদের কিছু অবদান নিম্নে তুলে ধরা হলো।
চিকিৎসা বিজ্ঞান : মুসলমানগন ভারতবর্ষে ইউনানী চিকিৎসা নামক নতুন এক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আসেন। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে রোগ নিরাময়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, অতি উন্নত ও বিজ্ঞান নির্ভর ছিল এ পদ্ধতি। ইরাক, ইরান ও তুর্কিস্তান তাদের সমৃদ্ধির যুগে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এখানেই মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসক ও ভেষজ বিজ্ঞানী জন্ম নিয়েছিলেন। ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর শাসকবর্গের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অত্যাগ্রহ ও উদার পৃষ্ঠপোষকতার খবর দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়লে ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী বিজ্ঞানীগণ একের পর এক ভারতে আসতে থাকেন। আগমনের এ ধারাবাহিকতা হিজরী সপ্তম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভারতের এসব অতিথি চিকিৎসক ও তাদের ছাত্রদের অভিজ্ঞতা, মেধা, একাগ্রতা ও মানবসেবার কারণে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি অগ্রগতির তুঙ্গশৃঙ্গে পৌঁছে। ইউনানী পদ্ধতির অগ্রগতির সামনে প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি সমূহ ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলে। ভারতবর্ষের কোন শহর ইউনানী পদ্ধতির চিকিৎসা ছাড়া ছিল না। এ পদ্ধতি ছিল উন্নত, অধিকতর সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং ভারতীয়দের মন-মেজাজ,পরিবেশ ও আবহাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।ফলে অতি দ্রুত ভারতের সর্বত্র এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতীয় জনগণ বিশেষত দরিদ্র শ্রেণীর চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিস্ময়কর অবদান রাখে। ভারতীয় চিকিৎসকগণ তাদের অভিজ্ঞতা ও মেধা দিয়ে এ পদ্ধতিকে আরো গৌরবান্বিত করতে সমর্থ হয়েছেন।মুসলমানদের পতন কালে দিল্লী ছিল ইউনানী চিকিৎসার বিখ্যাত কেন্দ্র। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে এ পদ্ধতি বহুল প্রচলিত ও জনসমর্থিত।
কৃষি ও পোষাক ক্ষেত্রের বিকাশে মুসলমানদের অবদান : ভারতীয় পোশাক ও বুননশিল্পেও মুসলিমদের অনেক বড় অবদান ছিল। মুসলিম আগমনের আগের বেশির ভাগ ভারতীয় মোটা সুতা ও অপরিশোধিত পশমের পোশাক পরিধান করত। গুজরাটের শাসক সুলতান মাহমুদ বিন মুহাম্মদ গুজরাটি (৯১৮ হি.), যিনি মাহমুদ বিকরাহ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি বহু শিল্পের সূচনা করেন। তাঁর হাতে তাঁত, বুটিক, সেলাই, নকশা ও কাটার কাজের বিকাশ ঘটে। এ ছাড়া তার সময়ে হাতির দাঁত, রেশমি কাপড় ও কাগজশিল্পের উন্নতি সাধিত হয়। সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন বড় শিল্পসাধক ও শিল্পানুরাগী শাসক। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিতে বিপ্লব সাধিত হয়, যা সমকালীন আর কোনো শাসকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ভারতীয় ইতিহাসবিদ আল্লামা সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) লেখেন, ‘তাঁর অন্যতম অবদান হলো সমাজ ও দেশ নির্মাণ, মসজিদ-মাদরাসা ও খানকা স্থাপন, কৃষি সম্প্রসারণ, ফলদ বৃক্ষ রোপণ, ফুল-ফলের বাগান সৃষ্টি এবং মানুষকে তাতে উদ্বুদ্ধ করা; তাদের কূপ ও খাল খননে সহযোগিতা করা। এ জন্য তার রাজ্যে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন অনারব অঞ্চল থেকে কারিগর, শিল্পী, নির্মাণাতা ও পেশাজীবীরা সেখানে আগমন করে এবং নিজ নিজ পেশা ও শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখে। তাঁর শাসনামলে কূপ, পানির নালা, হাউস, ফল-ফুলের বাগান, শস্যক্ষেতের সমারোহে গুজরাট সবুজের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়। তখন গুজরাট রূপ নেয় একটি বাণিজ্য নগরীতে, যেখান থেকে অন্যান্য অঞ্চলে উন্নতমানের কাপড় রপ্তানি হতো। এর সবই হয়েছিল গুজরাটের শাসক সুলতান মাহমুদ শাহের আন্তরিকতায়। যা দ্বারা উপকৃত হয়েছিল তাঁর রাজত্ব ও রাজ্য এবং উন্নত জীবন লাভ করেছিল তাঁর জনগণ।’
সম্রাট আকবরও কাপড় তৈরির বড় বড় কারখানা স্থাপন করেন। ভূমি, ফসলি ভূমি ও স্থাবর শ্রেণিবিন্যাস, জরিপ, স্থিতিশীল ভূমি আইন ও করনীতি প্রবর্তনে মুসলিম শাসকদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা অর্থ ও মুদ্রাব্যবস্থাও গড়ে তোলেন। মুসলিম-পূর্ব ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পাওয়া যায় না। বাদশাহ শের শাহ সুরি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও প্রতিভাবান প্রশাসক। উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে তিনি অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। সম্রাট আকবরও ছিলেন তাঁর অনুগামী।
একইভাবে ভারতে পশুপালন, পশু সংগ্রহ, জাত-উন্নয়ন ও পশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইসলামী শাসনের বিশেষ অবদান রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘তুজুকে জাহাঙ্গীরি’ এবং ‘আইনে আকবরি’তে যার বর্ণনা পাওয়া যায়।
সমরাস্ত্র : ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল কালাম আজাদ ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীদের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তার অবদানের জন্য তাকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়। এছাড়াও পাকিস্তানের সমরাস্ত্রের জনক আব্দুল কাদির খান পারমানবিক বোমা আবিস্কারের মাধ্যমে এক অনন্য কৃতিত্ব রাখেন।
চিকিৎসা, সমরাস্ত্র এবং কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোতে ভারতবর্ষের মুসলমানরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে।ডি.এম ফয়সাল : প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।