প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:২০
নূতন সংগঠন ‘বাঙালমেল’ এবং জাতীয় নেতৃত্বে চাঁদপুরের আবির বাঙালি
একটি মানবিক ও বৈষম্যহীন সমাজ বিকাশের জন্যে বাংলাদেশের জনসমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সিলসিলা ধারণ করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে ‘বাঙালমেল’-এর জাতীয়মেল গঠিত হয়েছে। বাঙালমেল-এর কেন্দ্রীয় কমিটিস্বরূপ ১৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয়মেল-এ ফয়েজ আলম (ঢাকা : কবি, প্রাবন্ধিক)কে একমাত্র উপদেষ্টা এবং বাকি ১৬ জনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। এক নম্বর সদস্য হচ্ছেন আবির বাঙালি (ঢাকা : কবি, আবৃত্তিকার, সংস্কৃতিকর্মী), যাকে সংগঠনটির মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অন্য সদস্যবৃন্দ হচ্ছেন : মালেকুল হক (সিলেট : কবি, সম্পাদক, প্রকাশক : নাগরী প্রকাশন), সাকী আনোয়ার (ময়মনসিংহ), জোহরা পারুল (ঢাকা : কথা সাহিত্যিক), সুফি সুফিয়ান (সিলেট : নাট্যকার, কথা সাহিত্যিক, নাগরী প্রকাশন), ওয়াহিদ রুকন (কবি, সাহিত্য সমালোচক), মনির ইউসুফ (ঢাকা : কবি, সম্পাদক, সংগঠন, কবিতার রাজপথ), মাহদী আনাম (ঢাকা : প্রকাশক, ঘাসফুল প্রকাশনী), মামুন আজাদ (যশোহর : কবি, সম্পাদক), জিয়াউর রহমান (হবিগঞ্জ : সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী), নাহিদ বাদশাহ (ঢাকা : প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ বুকওয়ার্ম), আলমগীর হোসেন পলাশ, পূরবী সম্মানিত (নেত্রকোনা : অধ্যাপক, লেখক), আবদুস সালাম (নেত্রকোনা : কবি, সংস্কৃতকর্মী), খোবাইব হামদান (চট্টগ্রাম : কবি, সাংবাদিক) ও এসএম নিয়াজ মোর্শেদ (সংস্কৃতি কর্মী, এক্টিভিস্ট)।
বাঙালমেল ইশতেহার
‘বাঙালমেল’ শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনসমাজের ঐতিহ্য ও জীবনঘনিষ্ঠ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার মেল। এ দেশের জনসমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সিলসিলা ধারণ করে মানবিক, বৈষ্যমহীন, জনমুখি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞানের চর্চা সংগঠনটির লক্ষ্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় এবং আরো বড় অর্থে জগতের বিরাট জায়গায় ভিন্ জাতি/সংস্কৃতি/ধর্মের মিলমিশের মধ্যে বসবাস এবং স্বাভাবিক লেনদেনে সকল সংস্কৃতির বিকাশ ও মানবিক উন্নয়ন ঘটে বলে সংগঠনটি বিশ্বাস করে। একটি জনগোষ্ঠী ও সভ্যতা হিসাবে হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের বিকাশের ঐতিহ্যিক অর্জনের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বমানুষের বৃহত্তর মেলের মানবিক উন্নয়নের সফরে শামিল হওয়া 'বাঙালমেল'-এর অঙ্গীকার ।
(১) বাংলাদেশের জনসমাজ প্রধানত বাঙালি জাতিত্ব ও সাংস্কৃতিক উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, যার শুরু, বিস্তার ও বেড়ে ওঠা আজকের বাংলাদেশ নামক দেশটির ভূগোলের সীমানায়, যার রয়েছে নির্দিষ্ট ভূগোল, ভূমিরূপ, পরিবেশ, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। চৌদ্দ শতকে স্বাধীন সুলতানী আমলে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পার হয়ে যায় এবং তখন থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আমাদের বাঙালি পরিচয়ে এসে শামিল হয়। ঊনিশ শতকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির মোসাহেবী মারফত সুযোগ পেয়ে কলিকাতাকেন্দ্রিক একদল বুদ্ধিজীবী বাঙালি জাতি পরিচয়ের এই আদত ইতিহাসকে চাপা দিয়ে পত্তন করে এক বানোয়াট ইতিহাসের, যেখানে ওরা নিজেদেরকেই প্রকৃত বাঙালি হিসাবে প্রচার করে। সেইসঙ্গে বহু বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী আচারপ্রথাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া হয়। মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতি অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসমাজের সংস্কৃতিকে ঠেলে দেয়া হয় প্রান্তে। এর পর থেকে দেড় শ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের ইতিহাসের লেখা, বইপত্র, স্কুল-কলেজের পাঠ্য সব জায়গায় এই বানোয়াট বয়ানই জারি থাকে। অন্যদিকে জনসমাজের সাংস্কৃতিক চর্চায় টিকে থাকে আমাদের আদত সাংস্কৃতিক সিলসিলা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবার আকাঙ্ক্ষা ছিলো কলিকাতাকেন্দ্রিক বানোয়াট ইতিহাস বাতিল করে এদেশের জনমানুষের হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলা। তা না করে বরং কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের দেড়শ বছরের মিথ্যাচারকেই আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বলে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বয়ানকে আরো পোক্ত করা হয়েছে পনর বছরব্যাপী স্বৈরাচারী শাসনকালে, বরং সংস্কৃতির নামে যোগ করা হয়েছে আরো কিছু সাম্প্রদায়িক আচারপ্রথা। আর এই কাজে অংশ নিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে এদেশেরই একদল দেশপ্রেমহীন, মেরুদণ্ডহীন লেখক-বুদ্ধিজীবী- সংস্কৃতিকর্মী। আমরা দেড়শো বছরে এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে চাই।
বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি :
দেড়শ বছরের বানোয়াট সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর কর্মকাণ্ড টিকে থেকেছে মূলত আমাদের নাগরিক মধ্যবিত্তর কেন্দ্রগুলোর মুষ্ঠিমেয় একদল বিভ্রান্ত, মেরুদণ্ডহীন কলিকাতামুখি লেখক-বুদ্ধিজীবীদের লেখাজোকা আর চর্চায়। গত পনর বছরের দুঃশাসনে যা আরো বেড়েছে। অন্যদিকে, এই সাংস্কৃতিক দুঃসময়েও, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মানুষ এবং গোটা জনসমাজে নিরবে জারি থেকেছে আমাদের মূল সাংস্কৃতিক সিলসিলা। ফ্যাসিবাদী শাসনে কলিকাতামুখি সাংস্কৃতিক প্রবণতার সমালোচনা করা যায়নি। কেউ কথা বললেই তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক কেউ যখনই কলিকাতামুখি সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বদলে জনসমাজের সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে চেয়েছে, তখনই তারা তার বিরুদ্ধে লেগেছে, কোণঠাসা করেছে। অর্থাৎ যে কোনো বাংলাদেশপন্থী দেশপ্রেমিক মানুষকেই তারা ‘মৌলবাদী’, ‘পাকিস্তানপন্থী’, ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দিয়ে নানাভাবে নির্যাতন করে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির উত্থানকে ঠেকিয়ে রেখেছে। সন্দেহ নেই এরাই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির শত্রু।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন কথা বলতে পারে, তার মতামত জানাতে পারে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এ যাবত উপেক্ষিত জনসমাজের মানুষদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শত শত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া স্বাধীনতাকে সফল করার জন্য প্রয়োজন একটি যথার্থ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। আর তার ভিত্তি হতে হবে অবশ্যই জনমানুষের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। অবশ্যম্ভাবী এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে মধ্যযুগে রচিত জনসাহিত্য, এদেশের জনসমাজের সাংস্কৃতিক চর্চা এবং তাদের জীবনযাপনে ধরে রাখা হাজার বছরের সিলসিলা থেকে আমরা বয়ান করতে চাই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির রূপ।
এখানে এসে মিশেছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যিক গড়ানের ধারা। এখানে বসবাসকারী মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় ৯৯.৫০% মানুষ একই ভাষা একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। আবার, বহু শত বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, ধর্মের মানুষসহ বাংলাদেশের সকল মানুষ একই সাথে মিলমিশের বসবাসের ঐতিহ্য এই দেশের জনসমাজের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাই সকল ধর্ম, জাতিত্ব, সংস্কৃতির সমান নাগরিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও বিকাশে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।
(২) বাংলাদেশ নামক ভুখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের সমান মানবিক অধিকার রয়েছে। তার কথা বলার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। যে কোনো ধর্ম ও রাজনৈতিক মতবাদকে সমর্থন করার অধিকার আছে তার। প্রতিটি বাংলাদেশী সকল রাষ্ট্রীয় সুবিধার সম অংশীদার।
বাংলাদশের জনসমাজের জাতিগত সিলসিলা :
এ দেশের জনসমাজ প্রধানত বাঙালির মেল, বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি-এর আত্মা। জাতি হিসাবে আমরা হাজার হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সিলসিলা বহন করে আসছি। এ অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপনকারী অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীই বাঙালির আদি পূর্বপুরুষ। ইতিহাসে দেড় হাজার বছর আগে থেকে ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল’ নামে জাতি হিসাবে আমাদের ক্রমবিকাশের প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন আজকের বাংলাদেশের কেবল মাঝখানের বড়ো একটা অংশ বঙ্গ হিসাবে পরিচিত ছিলো এবং তার অধিবাসীদেরকে বঙ্গাল বা বাঙ্গাল নামে ডাকা হতো। সময়ের সাথে সাথে সারা বাংলাদেশের মানুষ একই পরিচয়ে একসাথে হয়। ধর্মের নিরিখে তারা ছিল প্রধানত বৌদ্ধ, জৈন, প্রকৃতিধর্ম ও কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের অনুসারী। এই জনগোষ্ঠীর ভাষাই আদি বাংলা ভাষা হিসাবে পরিচিত, যার নমুনা ‘চর্যাপদ’। জানা ইতিহাসের সময় থেকে তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিলো একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র, গোপাল ধর্মপাল রামপাল নামে ইতিহাসখ্যাত বৌদ্ধ রাজাদের মাতৃভূমি।
১১২৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে বাংলা তার স্বাধীনতা হারিয়ে কর্নাটকের সেন রাজাদের দখলে চলে যায়। আবার ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কী বখতিয়ার খিলজি বাংলা দখল করে নিলে বাংলাদেশে মুসলিম শাসন আরম্ভ হয়। তখন থেকে মধ্যএশীয়, আরবীয়, ইরানী, তুর্কীসহ ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মানুষ দেশান্তরী হয়ে এখানে এসে বসত করে। সেই সময়ের বাংলাদেশে শাসকদের ভাষা ছিলো ফারসি। আর এদেশে নয়া বসতকারী জনমানুষের ভাষা ছিলো ফারসি, আরবী, তুর্কি ইত্যাদি। আগত দেশান্তরী মানুষদের সাথে বাংলাদেশের আদি বাসিন্দাদের মিশামিশির মধ্য দিয়ে একদিকে আমাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পুষ্ট হয়ে পরিষ্কার ধরণ লাভ করে, অন্য দিকে বাংলা ভাষার আদি রূপের সাথে আগত দেশান্তরীদের মুখের বুলি আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার মিশ্রণের ফলে দেখা দেয় মধ্যযুগের শক্তিশালী ভাষা বাংলার রূপ। তখনো বাংলা রাজনৈতিকভাবে ছিলো দিল্লীর অধীন।
এই চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যেই ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালির কারমানি গোত্রের মানুষ ফখরুদ্দিন মোবারক শাহর নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানী রাষ্ট্রের সূচনা হয়। বাংলাদেশ আবার প্রায় সোয়া দুইশ বছর পর তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পায়। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণবঙ্গ থেকে এসে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ শাসন ভার গ্রহণের পর বর্তমানে ভারতের শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গসহ আরো কিছু এলাকা তার শাসনে নিয়ে এসে গোটা রাজ্যের নাম দেন ‘বাঙ্গালা’, তার অধিবাসীদের পরিচিত করেন ‘বাঙালি’ নামে, নিজে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালী’ উপাধি নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। এভাবেই স্বাধীন সুলতানী আমলে পশ্চিবঙ্গের মানুষও আমাদের সাথে মিশে গিয়ে বাঙালি পরিচয়ে শামিল হয়। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ও শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহই বাংলাদেশে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
এই দীর্ঘ সময়ে বাংলার মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ নির্বিশেষে জনমানুষের মুখে পুষ্টি পেয়ে এবং কবি সাহিত্যিকদের লেখার সৌকর্যে বাংলা ভাষা অত্যন্ত শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়। আমরা জনমানুষের জীবন ও সংস্কৃতির হাজার হাজার বছরের এই সিলসিলা ধারণ করতে চাই আমাদের মননে ও সাংস্কৃতিক চর্চায়।
অন্যদিকে, তিব্বত ও বার্মা থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী দেশান্তরী হয়ে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে আসছে। এরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত। বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে আমরা তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল এবং বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় তার প্রকাশও অনিবার্য বলে মানি।
বৃটিশ আমলে উপনিবেশি ষড়যন্ত্র ও প্রশ্রয়ে শুরু হওয়া তথাকথিত হিন্দু পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে সমাজের উপরতলায় চলে আসা বৃটিশ মোসাহেবদের একটা অংশ নয়া শহর কলিকাতায় বুদ্ধিজীবীর জায়গা দখল করে নেয়। এদের সচেতন চেষ্টায় বাঙালির ইতিহাস, ভাষা বিকৃত করে লেখা হয় নতুন সাম্প্রদায়িক ইতিহাস, জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় ধর্মনির্ভর নানান সাংস্কৃতিক উপাদান এবং মানুষে মানুষে বৈষম্যমূলক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বাংলাদেশের উদার মনোভাবের অসাম্প্রদায়িক জনসমাজে প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয় সাম্প্রদায়িক বিষ। এর আগে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এই বানোয়াট ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে আরো দেড়শ বছরের বেশি সময় পার করে এসেছে বাংলাদেশের জনসমাজ। সে দেড়শ বছরের সময়পর্বে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যা কিছু রচনা করেছে তার বেশিরভাগের মূলে আছে ঐ ভুল ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি। ফলে তার বহু অর্জনের মধ্যে রয়ে গেছে ঐ সব বানোয়াট ইতিহাসের বয়ান, বর্ণবাদী-সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির চিন।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, গত পনর বছরের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার চালক ও সমর্থকরা মুখে মুখে মুক্তির চেতনা ও স্বাধীনতার কথা বললেও কার্যত প্রচারমাধ্যম, পাঠ্যবই, অন্যান্য বইপত্র, নানান সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে ঊনিশ শতকের কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের বানোয়াট ইতিহাস-সংস্কৃতির বয়ানই নতুন করে চাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের উপর। আর তাদের দোসর লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি অংশ নিয়েছে সেসব কর্মকাণ্ডে। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র দখল করে এইসব বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ইতিহাস-সংস্কৃতি-সাহিত্যের সাফাই গেয়ে গেছে। সেই দেড় দশক বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার কোনো সুযোগ ছিলো না, বাক স্বাধীনতা ছিলো না। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গেলেও নেমে আসতো নানা রকম নির্যাতন।
এই বানোয়াট ও সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক জ্ঞানতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে যে শিশুটি বেড়ে উঠবে সে নিজের অজান্তেই নানা রকম ভাবগত আধিপত্যের শিকার হবে। জাতিগত আত্মমর্যাদা ও খাঁটি দেশপ্রেম তার মধ্যে তৈরি হবে না। নিজের দেশ-জাতি সম্পর্কে প্রচলিত নানা রকম নেতিবাচক বানোয়াট ধারণাগুলোকেই সে বিশ্বাস করবে। ফলে একটি মানবিক, আত্মমর্যাদশীল, স্বয়ংসম্পূর্ণ, উন্নত জাতি গঠনের চেষ্টা শুরুতেই বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান মানুষের বাকস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন স্বাধীনভাবে ভাবতে পারি এবং সে ভাবনা প্রকাশও করতে পারি। বৃটিশ উপনিবেশি প্রভাব এবং উনিশ শতকের কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক বানোয়াট বয়ানের প্রভাব থেকে এদেশের মানুষের মনোজগতকে মুক্ত করার দুর্লভ সুযোগ এনে দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। এ সুযোগ নষ্ট হতে দেয়া চলবে না।
এ জন্য প্রথমেই দরকার বাংলাদেশের জনসমাজের জাতিগত ও রাজনৈতিক বিকাশের সঠিক ইতিহাস রচনা। বাংলা ভাষার সূচনা ও পরিপুষ্টির ইতিহাস এবং জনসমাজের সাংস্কৃতিক সিলসিলাও চিহ্নিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বানোয়াট বয়ানের টেক্সট চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর অসারতা তুলে ধরাও বাঙালমেল-এর জরুরি কাজ। এভাবে যে পটভূমি রচিত হবে, তার ভিত্তিতে যাচাই করে নিতে হবে আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যান্য প্রচলিত অর্জনগুলোও।
এ ছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবে আদি ও মধ্যযুগের রাজনৈতিক কারণে এ যাবত চলে এসেছে বৈষম্যের নানা রূপ। ধর্মের বৈষম্যমূলক বিষয়গুলো সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা হিসাবে সমাজে প্রচলিত করে দেয়া হয়েছে। এদেশের মানুষের জ্ঞানজগত, সাংস্কৃতিক পরিসর ও জনমানসে শত বছর ধরে চাপিয়ে দেয়া এসব বিপুল ময়লাছয়লা সাফ করতে হলে দরকার একটি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তার অংশ হিসাবে :
(ক) প্রথমেই আমাদের জাতিগত বিকাশের আদত ইতিহাস রচনা করতে হবে। পুনর্লিখন করতে হবে প্রচলিত ইতিহাসের। একই সাথে অবশ্যম্ভাবী এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভিত্তি হিসাবে মধ্যযুগে রচিত জনসাহিত্য, এদেশের জনসমাজের সাংস্কৃতিক চর্চা এবং তাদের জীবনযাপনে ধরা রাখা হাজার বছরের সিলসিলা থেকে ছেঁকে তুলতে হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির রূপ। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের বিষয়টিও চিহ্নিত করতে হবে।
(খ) ভাষাকে মুক্ত করতে হবে বৃটিশ আমলের উপনিবেশি প্রভাব থেকে, যা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ঊনিশ শতকের ফোর্ট উইলিয়ামের কলেজের তৎপরতায় এবং ঊনিশ শতকের কলিকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায়। সে সময় স্কুল-কলেজে জোরপূর্বক পাঠ্য করে, এ ভাষায় বইপত্র ছাপিয়ে, পত্রিকা প্রকাশ করে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাধ্য করা হয়েছে নতুন দুরূহ সাম্প্রদায়িক বাংলা ভাষা মেনে নিতে। তারই উত্তরাধিকার লেখ্যভাষা। এ লেখার ভাষা এদেশের নব্বই ভাগ মানুষেরই বোধগম্য নয়। আশার কথা, সে ভাষা আমাদের লেখায় জনমানুষের সাহিত্য ও তাদের প্রতিদিনের মুখের ভাষায় রয়ে গেছে বাংলা ভাষার বিকশিত মূলরূপ। এর থেকে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ও কথিত একটি কমন কথ্য ভাষা। এই কথ্য ভাষার ভিত্তিতে গুছিয়ে নিতে হবে আমাদের লেখ্যভাষাকে।
(গ) আমরা বিশ্বাস করি মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের ৯৯.৫০% মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি এক। আবার, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোরও রয়েছে নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বহু শত বছরের একসাথে বসবাসের ফলে বাংলাদেশের সকল মানুষের মেল অর্থাৎ জনসমাজের একটি একীভূত সাংস্কৃতিক রূপও তৈয়ার হয়েছে। প্রকৃত জনমুখি শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় তার প্রকাশ অনিবার্য।
(ঘ) বাঙালি সমাজে প্রচলিত ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন। এই জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে বৃটিশ আমলে, নগরকেন্দ্রিক শিল্প-সাহিত্য-ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে। আমরা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা জনমানুষের অভিজ্ঞতা, জীবন যাপন ও স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে পরিণত করতে চাই। এভাবে সাহিত্য সংস্কৃতিকে সংখ্যাল্প নাগিরক মানুষের উপভোগের বিষয়ে সীমিত না রেখে নিয়ে যেতে চাই মূলস্রোতে জনমানুষের জীবন যাপনের মাঝখানে।
(ঙ) আমরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে সকল বৈষম্য-ব্যবধান-ছুতমার্গীয় প্রবণতা ছুড়ে ফেলতে চাই।
(চ) গত প্রায় শ খানেক বছরের ইতিহাসে আমাদের শিল্পসাহিত্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন এক গোষ্ঠীর দ্বারা, যাদেরকে বলা যায় ক্ষমতার মোসাহেব গোষ্ঠী। এরা পুরস্কার-পদপদবীর আশায় সবসময় পদলেহন করে, ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার নানা কর্মকাণ্ডের গুণগান করে ফ্যাসিজমের বৈধতা দেয়, ব্যক্তির গুণগান গেয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রকৃত চেহারা জনগণের কাছ থেকে আড়াল রেখে সহনীয় মাত্রায় উপস্থাপনে সহায়তা করে। এভাবে, এরা প্রচার মাধ্যমের একশ্রেণির
মানুষের সহায়তায় একদিকে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা টিকে থাকতে মদদ যোগায়, অন্যদিকে প্রকৃত মেধাবীদের সুযোগবঞ্চিত করে শিল্পসাহিত্য বিকাশের পথে ব্যাপক বাধা তৈরি করে। জাতীয় শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য বিকাশের স্বার্থে যে কোনো উপায়েই হোক এ অবস্থার পুনরাভিনয় দূর করতে হবে, এ শ্রেণিটিকেও শিল্প চর্চার স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে বিশ্বাস করেন এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন বা থাকতে চান এমন যে কেউ বাঙালমেল-এ যুক্ত হতে পারেন। কেউ যদি এমন কোনো সংগঠনে যুক্ত থাকেন যার আদর্শ উদ্দেশ্য ‘বাঙালমেল’-এর আদর্শউদ্দেশ্য-এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তাহলে তিনিও বাঙালমেল-এ শামিল থাকতে পারবেন। বাঙালমেল-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে এমন একটি মানবিক, ইনসাফের সমাজ কায়েম করা, যেখানে প্রতিটি মানুষের স্বীকৃত নাগরিক অধিকার থাকবে, একটি আদর্শ পরিবেশ তৈয়ার হবে ব্যক্তির প্রকৃত মানবিক বিকাশের।