প্রকাশ : ১২ জুন ২০২২, ১২:৩৩
মাস্টার দা সূর্য সেন
মোঘল আমলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে ডিসেম্বর থেকে ব্রিটিশরা সম্রাট শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেবের আমল থেকে বাণিজ্য করার লিখিত অনুমতি পায় এবং পাকাপোক্তভাবে ব্রিটিশ বণিক শ্রেণীতে পরিণত হয়ে যায়। বণিক শ্রেণী থেকে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হওয়ার ফন্দি-ফিকির আঁটতে থাকে। এই বাংলা সূর্যসেন, প্রীতি লতা প্রমুখের যেমন প্রসবিনী, তেমনি মীর জাফর, উমি চাঁদ এবং খন্দকার মোশতাক জাতীয়দেরও প্রসবিনী। ইংরেজরা তাদের ইউরোপীয় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এমনভাবে ঘটিয়েছিল যা বাংলাদেশীয় গতানুগতিক সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিপন্থী।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা বিতাড়িত করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন বাংলার মোনাফেকদের কারণে ইংরেজরা আবার এসে বসলো এবং বণিক শক্তি থেকে রাজ্যাধিকারী শাসক শক্তি অর্জন করে ফেললো।
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশির প্রান্তরের অদূরে গাঙ্গেয় উপত্যকায় যে স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তা উদয়নের অতি প্রত্যুষ কাল ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আর সূর্য উদয়নের পরিপূর্ণ কাল ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ।
বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত পাক-ভারত পরাধীনতার অন্ধকারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য বিপ্লবী দল, বোমা তৈরির কারিগর, বিপ্লবী দল পরিচালনার নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহের জন্য পৃথক দল সৃষ্টি করা, ‘দেশদ্রোহী’ চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান এবং বিশ^াস যোগ্য বিপ্লবী তৈরি করা, দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা বিপ্লবীদের প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
পরাধীনতার শতবর্ষ পরে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে মার্চ ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে বন্দুক কাঁধে টহল অবস্থায় হঠাৎ করে বীর সিপাহী মঙ্গল পান্ডে বিদেশী শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন Ñ এসো ভারতবাসী! যে ফিরিঙ্গিরা আমাদের ধর্মভ্রষ্ট ও জাতিচ্যুত করেছে, তাদেরকে খতম করি এবং দেশকে স্বাধীন করি। ফিরিঙ্গিদের বিচারে ১৮৫৮ সালের ৮ই এপ্রিল এই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়। হিন্দু-মুসলিমের যৌথ এই প্রথম অভ্যুত্থান কে ব্রিটিশরা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করেছে।
এ সময়ে হাবিলদার রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহীরা তিন লক্ষ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে লুট করে নিয়ে স্বাধীনতার বিপ্লবীদের কোষাগারে দিয়ে দেয়। জেলখানার কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে ব্যারাকটি পুড়িয়ে দিয়ে অস্ত্রাগারটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী শ্রেণীর শিক্ষিত ইতিহাস বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে গোপন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার প্রেরণা জুগিয়েছিল বিধায় বাংলায় অসংখ্য কার্যকর বিপ্লবী সংগঠন তৈরি হয়েছিল। বাঙালির অসংখ্য দুঃসাহসিক এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট না হওয়া বিপ্লবী অভিযানগুলো ব্রিটিশকে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সাহসী করেছে। বাঙালি বিপ্লবী এতোই বেপরোয়া স্বাধীনতাকামী হয়েছিল, যা এক সময় ব্রিটিশ ডেপুটি পুলিশ সুপার ভূপেন চাটার্জিকে আসামীদের জেলখানার ডান্ডাবেড়ি দিয়ে কৌশলে আক্রমণ করে হত্যা করে ফেলে। এ হলো তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতাকামীদের কর্ম পদ্ধতি, যা আমাদের অনেক বন্ধুর পথ এগিয়ে দিয়েছে। ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খল পরার অব্যবহিত পরেই পুরো ভারত জুড়ে অসংখ্য বিপ্লবী দল গঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘অনুশীলন’, ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বিহারের সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে মারলেন মিস কেনেডি এবং মিসেস কেনেডিকে। বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় আর প্রফুল্ল চাকী নিজের রিভলভারে আত্মহত্যা করেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে নিয়ে রচিত গান আজও এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায় অতি জনপ্রিয়।
বাংলার মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার আর আল বদর বাহিনী সাধারণ জনগণের উপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচার করে স্বাধীনতা কে ত্বরান্বিত করেছে। ভারতবর্ষে ইংরেজ নিযুক্ত মিলিশিয়া বাহিনী স্থানীয় হাট-বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য পরিশোধ করতো না। ফলে জনমনে মারাত্মক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। যা বিপ্লবীদের জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।
গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের গতিবিধি, বিপ্লবী সূর্যসেনের সহিংস আন্দোলন এবং সুবাস বোসের ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’-এর চলমান গতিবিধি এবং পরিণতি স্বচক্ষে দেখে এবং পর্যালোচনা করে একটি বাক্যই উচ্চারণ করেছিলেন যে, “চট্টগ্রাম সবার আগে” (ঈযরঃঃধমড়হল ঞড় ঞযব ঋড়ৎব!), যাঁকে ঘিরে এ বৃত্তাতিক্রান্ত অলংকারায়ন, তিনি হলেন কর্মবীর সূর্য কুমার সেন (২২-০৩-১৮৯৪-১২-০১-১৯৩৪), পিতাÑরাজ মনি সেন, মাতাÑশশীবালা সেন। তাঁর ডাক নাম ছিল কালু। মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। মাস্টারদারা ছিলেন দুই ভাই-১। সূর্য ২। কমল এবং চার বোন ১। বরদা ২। সাবিত্রী ৩। ভানুমতি ৪। প্রমিলা।
ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য নাকি অস্ত যেতো না, সেই প্রবল শক্তিশালী রাজ্যের সূর্য অস্তাচলে নিয়ে গেলেন চট্টলার বীর সন্তান সূর্য সেন।
যে আটটি ইস্তাহার বাস্তবায়ন করার জন্য ‘ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মিÑ চট্টগ্রাম শাখা’ ‘নামীয় একটি শাখার ব্যানারে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে নেমেছিলেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে যখন প্রমাণিত হলো যে, ভারতমাতার পরাধীন ছাত্র ও যুবক তাদের বজ্র কঠিন সাহস, অম্লান দেশপ্রেম এবং নৈষ্ঠিক আত্মোৎর্গের অটুট সংকল্প নিয়ে সমগ্রদেশে বিচ্ছিন্ন বৈপ্লবিক সফলতা এনে স্বাধীনতার পথের কণ্টক দূর করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বোধ করেছে না, অথবা সামগ্রিক সক্ষম, তখন প্রধান নেতা মাস্টারদা তার অপরাপর সহকর্মীদের মধ্যে নির্মলসেন, লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ এবং অনন্তসিংহ প্রমুখের পরার্মশ ক্রমে বৃটিশ সরকারকে কঠোর আঘাতের সিদ্ধান্ত নিলেন।
এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার সিদ্ধান্ত হয় এবং একটা সৈন্য তালিকা তৈরি করা হয়। শেষ আঘাত হানার লক্ষ্যস্থল নির্ধারিত হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা। বিপ্লবী দলের গৃহীত আটটি ইস্তাহারের প্রথমটি হলো সন্নিহিত টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন অফিস ধ্বংস করা। এই বিপ্লবী দলটির নামাকরণ করেন স্বয়ং দলপিত। যা হলো ‘ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী’ (চট্টগ্রাম শাখা)। কঠোর নিরাপত্তার সাথে দলপতি মাস্টারদা আক্রমণের দিন, তারিখ এবং সময় বিভিন্ন বিপ্লবী পয়েন্ট থেকে নির্ধারণ করে দেন। অত্যন্ত দ্রুততা ও সতর্কতার সাথে কার্যকর করার জন্য অনুরোধ করেন। জেলখানার বিকল্প চাবি তৈরি করে সংশ্লিষ্ট বিপ্লবীর কাছে সরবরাহ করা হয় যেন কয়েদীদেরকে ত্বরিত গতিতে মুক্ত করা যায়। সেই বহুল কাক্সিক্ষত দিনটি হলো ১৮ই এপ্রিল ১৯৩০ শুক্রবার। এই ‘শুক্রবারটি গুড ফ্রাইডে’ হওয়াতে ইউরোপিয়ান ক্লাবটি আক্রমণ করা সম্ভব হয় নি। তা পরবর্তী কালে সুচারুভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে।
একটা জিনিস স্পষ্টতই বুঝা গিয়েছিল যে, আসন্ন অভ্যুত্থানের আভাসে বিপ্লবী কিশোর আর তরুণদের প্রাণে লেগেছে মরণের দোলা। নির্বাচিত তরুণ ও কিশোরদের নামের তালিকা আগের দিন সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র ভারতবাসীর মুক্তির জন্য বৃটিশদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য এবং ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী হতে চলেছে যেসব বিপ্লবী যুবক, সর্বাধিনায়ক সূর্যসেন (৩৫)সহ মোট ৬৩ জন। সর্ব নিম্ন বয়সী নির্মল লালা (১৪)। বিপ্লবী দলকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। রাত ঠিক সাড়ে আটটায় মুক্তি পাগল বিপ্লবীরা যার যার কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ঝটপট করে লেগে যায়। সর্বপ্রথম বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন কেন্দ্রটি হাতুড়ির আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রথম সাফল্য অর্জন করে।
তার কয়েক মিনিট পর বিপ্লবী নেতা নির্মল সেন ও লোকনাথ বল প্রমুখের সফল নেতৃত্বে পাহাড়তলীতে অবস্থিত সরকারি অস্ত্রাগারটি বিপ্লবীরা দখল করে নেয়। জয়োদ্ধত বিপ্লবীরা অস্ত্রাগারে ঢুকে সব সুসজ্জিত শক্তিশালী অস্ত্রের বাক্স সহ সব লুট করে বিপ্লবীদের নেওয়া মোটরযানে করে দ্রুত অস্ত্রাগার ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। অবশিষ্ট গুলো হাতুড়ি দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে অকেজো অবস্থায় রেখে যায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকারী বিপ্লবী দল ফিরে না আসায় সর্বাধিনায়ক সূর্যসেন এবং অনন্ত সিংহ আরো দুটি বিপ্লবী দলকে অকুস্থলে প্রেরণ করেন। তাঁরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিজেরাও তাদের গাড়িতে অস্ত্রভর্তি করে ফিরে আসার সময় অস্ত্রাগারটি পেট্রোল দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়।
তারপর রাতেই বিপ্লবীরা একত্র হয়ে শুরু করলো চট্টগ্রাম রিজার্ভ ফোর্সের ওপর আক্রমণ। এখানে হিন্দি ও উর্দুভাষী সিপাই ছিল বেশি। বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা এ কথা জেনেই বিপ্লবীদেরকে নির্দেশ দিলেন পাহাড়ে বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে স্লোগান হবে “গান্ধী রাজা হো গিয়া, ভাগো” “ইনক্লাব জিন্দাবাদ, বন্দেমাতরম” আর শূন্যে গুলি ছোড়লো বিপ্লবী গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিংহ। পাহাড়ের চূড়ায় উঠেই রিজার্ভ ফোর্সের হাবিলদার এবং সান্ত্রীকে গুলি করার পর অন্যান্য সবাই রাইফেল, গুলি ও অস্ত্রাগার ফেলে ব্যারাক ত্যাগ করে পালিয়ে যায় ।
এক রকম বিনা আয়াসেই অস্ত্রের শেষ সশস্ত্র ঘাঁটি বিপ্লবীদের দখলে এসে গেল। লুট করা রাইফেল নিয়েই বিপ্লবীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেল।
১৮ এপ্রিল থেকে রণক্লান্ত, পথ-শ্রান্ত এবং প্রায় অভুক্ত, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী সৈনিকরা ২২ শে এপ্রিল চট্টগ্রামের অদূরে জালালাবাদ পাহাড়ে বিশ্রামের জন্যে অবতরণ করে। কিন্তু বিধিবাম। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখা গেল নিয়মিত ইংরেজ সেনারা পাহাড়ের দিকেই ছুটে আসছে। বিপ্লবীদের গুলির জবাবে সৈন্যরা ১৫ মিনিট ধরে লুইস গানের গুলি করে এবং পরে পিছু হটে যায়। কিন্তু বিপ্লবী হরিপাল বল শহিদ এবং বার জন তরুণ বিপ্লবী মারাত্মক আহত হন। পলাশীর যুদ্ধের ১৭৩ বছর পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সূর্যসেনের নেতৃত্বে এটাই বাংলার প্রথম বিজয়। যার এক বিরাট ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। যার রেশ ধরে এই বাংলায় পাকহানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল।
এখানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং বিপ্লবী কল্পনা দত্ত সম্পর্কে একটু বলা দরকার। প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত দুজনই চট্টগ্রাম খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেছিলেন। পরে দুজনই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উভয়েই মাস্টার দার বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যান। মাস্টার দার সাথে দেখা করতে আসার পথে পুরুষ বেশে কল্পনা দত্ত বৃটিশ আর্মির হাতে ধরা পড়ে যান। প্রীতিলতার বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহস দেখে মাস্টার দা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের আদেশ দেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালে আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয়। এর আগে পর পর দুইবার এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এবার বিপ্লবী প্রীতিলতা মাস্টারদা’র পরিকল্পনা মাফিক ক্লাবটি আক্রমণ করে ৬৩ জন ইংরেজ নর-নারীকে হতাহত করেন। প্রীতিলতার সহযোগী ছিল আরো ৫ জন বিপ্লবী। পরিকল্পনা সফল হওয়ার পর প্রীতির সাথে থাকা পটাশিয়াম ফেরোসায়ওনাইড বিষপানে তিনি আত্মহত্যা করেন।
১৯৪১ সালে বীরপুরুষ মাস্টার’দা (সূর্যসেন)কে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় ফাঁসির রশি নামমাত্র গলায় স্পর্শ করে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সিংহ পুরুষ, মূল নায়ক, উদীয়মান সূর্যের মূল রূপকার এবং বীর প্রসবিনী চট্টলার সূর্য সন্তান মাস্টারদা ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পটিয়া থানার গৈরলা গ্রামের বিশ^াস বাড়িতে ধরা পড়ে যান। সেই পুরস্কার লোভী মীরজাফরের উত্তরসূরি একই গ্রামের নেত্রসেন। অথচ তার সহোদর অগ্রজ ব্রজেনসেন ছিলেন তেজস্বী বিপ্লবী মাস্টারদার একান্ত অনুগত অনুসারী। বিধির বিধানে এর কিছুদিন পরেই মধ্যাহ্ন ভোজনের আসনেই কোনো এক বিপ্লবী নেত্র সেনের মস্তক দেহ থেকে বিছিন্ন করে বেঈমানির প্রতিশোধ নেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হলো দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে এক কঠিন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নিলো স্বাধীন বাংলাদেশ। যে দেশে জন্মেছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর ভারতবর্ষে স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক এবং চট্টলার বীর সন্তান সূর্যসেন মাস্টারদা। যিনি ব্রিটিশ রাজত্বে সূর্যাস্ত না যাওয়ার ধারণার অলীকতা প্রমাণ করেছেন।
বাংলাদেশের সদাশয় সরকার যেন এসব বিপ্লবী কীর্তিগুলো যুগ-যুগান্তর অটুট রাখার যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নতুবা বীর প্রসবিনী বাংলার বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে না। (সূত্র: পূর্ণেন্দু দস্তিদারের লেখা স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম এবং বীর কন্যা প্রীতিলতা)।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ,চাঁদপুর।