বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৮

আজ উপকুল দিবস

লক্ষ্মীপুরের মেঘনার পাড়ের মানুষের জীবন : 'আমরা ভালো নাই, ভাত দেন, না হয় বাঁধের ব্যবস্থা করেন'

তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুর।
আজ উপকুল দিবস

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ চারটি উপজেলার প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের বসবাস মেঘনার চরে। এই বিশাল মেঘনা চরের মানুষের প্রধান সমস্যা জমিগুলো বেদখলের পাশাপাশি সুপেয় পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। মানুষের এখন একটাই চিন্তা, একবেলা ভাত না হলে চলে। কিন্তু বাঁধ ভাঙ্গন রোধ করা খুবই দরকার। আকাশে মেঘ এবং নিম্নচাপ হলেই মনের মধ্যে উপকূলীয় মানুষকে জাগিয়ে দেয় পুরানো দিনের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের কথা ‌। তারপরেও নিম্নচাপ যদি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়, তাহলে উপকূলের মানুষ এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ‌। কিন্তু উপকূলীয় মানুষের জন্যে আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন সেন্টার করে দেয়া হলেও বসতবাড়ি ও পশুপাখি ছেড়ে তারা কোথাও যেতে চান না ‌।অপরদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙ্গন যেন একটা চিরাচরিত প্রথা। বাংলাদেশে বর্ষা মানে নদী ভাঙ্গন আর নদী ভাঙ্গন মানেই নদী তীরবর্তী মানুষদের চরম দূর্ভোগ। নদীর ভাঙ্গন ও ভাঙ্গন কবলিত মানুষদের দুর্দশার যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা সত্যিই হৃদয় বিদায়ক ঘটনা।

‘নদীর এ পাড় ভাঙে, ওপাড় গড়ে এইতো নদীর খেলা।’ এটি দেশের একটি গানের লাইন। আর এ বাস্তবতা যেন লক্ষ্মীপুর উপকূলীয় মানুষদের কাছে যেন কখনই পুরাতন হয় না। প্রতিনিয়ত ঘুরে ঘুরে আসে ভাঙ্গনের এ সর্বনাশা খেলা। নদী তীরের লাখো মানুষ প্রায় বছর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের মিছিল হয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম।

গত ক'টি বড়ো ঝড় জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষদের সর্বস্বান্ত হওয়ার চিত্র যেন এখনও বিগত হয়নি মানুষদের কাছে। নদী ভাঙ্গনের শিকার জনগোষ্ঠী সব হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে ছুটে গিয়েছিল শহরের দিকে। এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করেছিল তারা। অনেকে এক মুঠো অন্নের জন্যে বাধ্য হয়েই নানান রকম সমাজবিরোধী কাজেও লিপ্ত হয়েছে। তাদের কাছে যেন মানবিক হয়ে উঠে চিরশত্রু। সুতরাং শহরে এ রকম ছিন্নমূল মানুষদের ব্যাপক প্রবেশে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাও বেড়ে যায়। মানুষগুলো অভিশপ্ত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয় শহরের মানুষের কাছে। এই চিত্র কারো কাম্য নয়।

কিন্তু নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে সেই অতীতের দিনগুলো থেকে আজ অবধি সফল কোনো কর্মসূচি এখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। বাজেটের সিংহভাগ যেন চলে যায় নদী ভাঙ্গনের সাথে। বিভিন্ন মানুষের স্বেচ্ছাচরিতার কারণে নদী ভাঙ্গনের বাস্তব চিত্র সম্বলিত সেই গানটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বরং আরো বেশি করেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুম আসার আগ থেকেই নদী তীরের জনপদগুলোতে এখনো আতংক বিরাজ করে।

কারণ, রাক্ষুসী নদীগুলো দয়ামায়াহীনভাবে গ্রাস করে নেয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা স্মারকসহ সমৃদ্ধ জনপদগুলো। মুহূর্তেই নিভিয়ে দেয় নদী তীরবাসীর সুখ-স্বপ্নের।

রায়পুরের উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ও চরআবাবিল ইউনিয়ন এবং কমলনগর ও রামগতি উপজেলার কয়েকটি এলাকার চিত্র দেখলেই বোঝা যায় এইসব এলাকার মানুষের দূর্দশার কথা। অন্নের চেয়ে যেন বেড়িবাঁধ সংস্কারের চিন্তাটাই তাদের কাছে বেশি। ‘খাই দায় পাখি বনের দিকে চাই’ এই প্রবাদের মতই তারা চেয়ে থাকে বাঁধের দিকে। চরকাছিয়া, চর ইন্দুরীয়া, চরজালিয়া ও চান্দারখাল মেঘনার তীরে ও বেরিবাঁধের দিকে তাকালে বোঝা যায় বসবাস করা মানুষগুলো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু তাদের এই নিরব কান্না শোনার মত নেই যেন কেউ। ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নিয়ে এক বা একাধিকবার মানব বন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে স্থানীয় যুব সংগঠন ও এলাকাবাসী। কিন্ত কোন প্রতিকার পায়নি তারা। সংবাদ মাধ্যমে এখানকার মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশার কথা উপস্থাপনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানান, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বিশাল চরাঞ্চলের জমি নদীতে গ্রাস করার ফলে সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার যে উদ্ভাস্তু হয়ে পড়ে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ফসলের জমি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি হারিয়ে ঐসব মানুষগুলোকে যে কি অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্গতির মধ্যে পতিত হতে হয়, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়েনা। আবার, নদী এদিকে ভেঙ্গে অন্যদিকে চর জেগে উঠলেও তাতে ভাঙ্গন কবলিত অসহায় মানুষদের উপকারে আসছে না। সে চর অধিকাংশ দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এক সময় নদী-শাসনকে অসম্ভব মনে করা হতো। কিন্তু এখন নদীশাসন এবং নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। এখন নদীর ভাঙ্গন রোধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানুষ তা প্রায় একশ বছর আগেই প্রমাণ করেছে। নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে-জনপদ রক্ষা ও বন্যা-নিয়ন্ত্রণের জন্যে নদী-শাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।

রামগতির আলেকজেন্ডারে নদীর বাঁধ দেয়া হলেও দুঃখজনকভাবে রায়পুরের তিনটি ইউনিয়নের নদীর বাঁধ এখনো পর্যন্ত কোনো উল্লেযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্প যেমন হওয়া উচিত বাস্তবভিত্তিক তেমনই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থসম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। মেঘনার চরাঞ্চল এলাকার মানুষের প্রত্যাশা, বিষয়টির গুরুত্ব দিয়ে সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী-ভাঙন প্রতিরোধ করতে নদীশাসন ও সংস্কারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়