প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ফরিদগঞ্জে ৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নের বীর নিবাস নির্মাণে ধীরগতি
অন্যের ঘর কিংবা ছাপরা ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অসহায় মুক্তিযোদ্ধাগণ
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নে মোট ৯৭ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার জন্যে সরকারি অর্থায়নে স্বপ্নের বীর নিবাস নির্মাণের কাজ চলছে ধীর গতিতে। ঠিকাদারগণ যথাসময়ে বিল না পাওয়ার অজুহাতে বীর নিবাসের কাজ বন্ধ রেখেছেন, আবার কিছু কাজ চলছে ধীর গতিতে। এ নিয়ে উপকারভোগী ও ঠিকাদারদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করতে দেখা যায়। যথাসময়ে কাজের বিল না পাওয়ায় ঠিকাদারদের মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করতে দেখা যায়।
|আরো খবর
অপরদিকে এই কাজে ঠিকাদারের লস (ক্ষতি) হবে বলে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কৌশলে নানা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা হয়রানি হওয়ার ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ দেয়ার সাহস পাচ্ছে না। যারা টাকা দিতে চাচ্ছে না তাদের কাজ নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে দায়সারাভাবেই চলছে বলে নানা অভিযোগ উঠেছে। আবার কোনো কোনো বীর নিবাসের কিছু অংশ কাজ করে বিল না পাওয়ার অজুহাতে ওই কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় দেয়ালে শেওলা পড়ে আছে।
বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় ৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা নিরূপায় হয়ে এখন কেউ কেউ অন্যের ঘরে আবার কেউবা ছাপরা ঘরে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কবে নাগাদ বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে তা কেউই সুনির্র্দিষ্ট ভাবে বলতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাস নির্মাণের জন্য তালিকা প্রেরণ করেন চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের সাংসদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান। এই তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে ৯৭ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার জন্যে স্বপ্নের বীর নিবাস নির্মাণকল্পে উপজেলা পিআইও অফিসের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। প্রতিটি বীর নিবাসের জন্যে সরকারিভাবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। ১৬ জন ঠিকাদার উক্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার হাতে পেয়ে গত অক্টোবর মাসে কাজ শুরু করেন। গত প্রায় ৩ মাসে ১টি বীর নিবাস নির্মাণ কাজ শেষও করতে পারেনি ঠিকাদার। অনেকেই বলছেন, ঠিকমতো কাজ করলে প্রায় এক মাসের মধ্যেই প্রতিটি বীর নিবাসের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
এদিকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা তাদের পূর্বের টিনশেড ঘর ভেঙ্গে ওই স্থানে বীর নিবাস নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে জায়গা বুঝিয়ে দেন, কাজটি চলমান অবস্থায় সেসব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা কেউ কেউ থাকছেন রান্না ঘরে আবার কেউবা থাকছেন পাশে নির্মাণ করা ছাপরা ঘরে। এক রকম বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ক’জন মুক্তিযোদ্ধা জানান, কাজ শুরু থেকে গত ক’মাস যাবৎ অন্যের ঘরে থাকতে হচ্ছে। কেউবা থাকছেন পাশের ছাপরা ঘরে।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এম ইদ্রিস সিদ্দিকীর স্বাক্ষর ও স্মারক নং সম্বলিত গত ২৫ জানুয়ারির একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঠিকাদার বীর নিবাসের ছাদ ঢালাইয়ের পর নির্মাণ কাজ চলমান রাখলে শতকরা ২৫ শতাংশ বিল পাবেন। এছাড়া ফিটিং ওয়ার্ক কমপ্লিট করে বীর নিবাস সম্পূর্ণ বসবাসের উপযোগী করলে ২য় চলতি বিল ২৫ শতাংশ পাবেন। বীর নিবাসের বাইরের রং, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধার লোগো স্থাপন করে বীর নিবাস মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার লেখাসহ হস্তান্তর যোগ্য হলে ঠিকাদারগণ তৃতীয় চলতি বিল হিসেবে ২৫ শতাংশ বিল পাবেন। মন্ত্রণালয়ের দেয়া এই শর্ত পূরণ করেও বিল না পাওয়ায় ঠিকাদারগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অপরদিকে অসাধু ঠিকাদার উক্ত কাজকে লস প্রজেক্ট দেখিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন। এতে মুক্তিযোদ্ধা ও ঠিকাদারের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়। কাজ ভালো করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক পর্যায়ে কৌশলে মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের টাকাও হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জনৈক মুক্তিযোদ্ধা সাহেবগঞ্জ গ্রামের মুকবুল আহাম্মেদ তাঁর নামে বরাদ্দ হওয়া বীর নিবাস করার জন্য নিম্নমানের ইট দেখে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার রতন পাটওয়ারীকে তার কাজে বাধা দেন। নিরূপায় হয়ে মুক্তিযোদ্ধা মুকবুল আহাম্মেদ এ ঠিকাদারের কাজের বিরুদ্ধে ইউএনও বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। একই অভিযোগ দিয়েছেন ওই এলাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা দুলা মিয়ার ছেলে মিজানুর রহমান।
অপরদিকে ঠিকাদার কাজ করেও সরকারের বেঁধে দেয়া শর্তমতে বিল না পাওয়ায় বেশ ক’টি বীর নিবাসের কাজ বন্ধ রয়েছে। আবার কিছু কিছু কাজ চলছে ধীর গতিতে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা, ঠিকাদার ও পিআইও অফিসে চলছে নানা অস্থিরতা।
বীর নিবাস নির্মাণ কাজের এক ঠিকাদার মামুনুর রশিদ পাঠান বলেন, এই কাজ করতে সরকারেরই নিয়মণ্ডনীতি মোতাবেক আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিল পাচ্ছি না। বিল না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে একাধিকবার মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
আরেক ঠিকাদার বিল্লাল হোসেন বলেন, সরকারি নিয়মণ্ডনীতি মেনে কাজ করেও যদি বিল না পাই তাহলে কীভাবে কাজ করবো? এই কাজের বিল পেতে এতো বিড়ম্বনা পোহাতে হবে তা আগে জানলে একটি কাজেরও টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতাম না।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকতা (ডিআইও) মিল্টন দস্তীদার বীর নিবাস নির্মাণ কাজের ধীর গতির কথা স্বীকার করে বলেন, ঠিকাদারকে বিল দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিল না পেয়ে বেশ ক’জন ঠিকাদারের কাজে ধীর গতি রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, উক্ত কাজ ভালো করার নামে মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে কেউতো লিখিত অভিযোগ দেননি। লিখিত অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।