মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৪:১৪

তেতো মুখের সাতকাহন

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
তেতো মুখের সাতকাহন

মুখের স্বাদ এক অতীব জরুরি বিষয়। মুখ একবার বিস্বাদ হয়ে গেলে আহারে বা ভোজনে তৃপ্তি মেলে না। মুখের এই স্বাদ আমরা পাই জিভের মাধ্যমে। অন্যদিকে, লৌকিক জীবনে কারও মুখের কথা মিষ্টি আবার কারও মুখের কথা তেতো। তবে এই তেতো হওয়াটা স্বাদের কারণে নয়, বরং কথার তির্যক পীড়নের কারণে।

বিভিন্ন কারণে মুখে তেতো স্বাদের উদ্গম হতে পারে। কতিপয় খাবার গ্রহণ, হরমোনজনিত পরিবর্তন এবং মুখগহ্বরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ জিভের অস্বাভাবিক তেতো স্বাদের জন্যে দায়ী। দাঁতের রুগ্ন স্বাস্থ্য, শুষ্ক মুখগহ্বর কিংবা গর্ভাবস্থা স্বাদের অনুভূতিকে প্রভাবিত বা পরিবর্তন করতে পারে। স্বাদ হচ্ছে মানুষের পঞ্চ অনুভূতির একটি। এটি বিবিধ নিয়ামক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জিভে স্বাদ কোরক বা টেইস্ট বাড নামে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গ দেখা যায় যা জিভের উপরিতলের অগ্রভাগ, দুইধার ও পেছনের অংশে সজ্জিত থাকে। এরা টক, ঝাল, মিষ্টি, তেতো ও লবণাক্ত স্বাদের পাশাপাশি রান্না করা মাংশের স্বাদ সনাক্ত করতে পারে। আমাদের জিভে দু থেকে আট হাজার স্বাদ কোরক আছে। প্রতিটি স্বাদ কোরকের জীবনকাল সর্বোচ্চ দশদিন। এরপর তারা নষ্ট হয়ে যায় এবং নতুন স্বাদ কোরক তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা সতের থেকে কুড়ি ভাগ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে জিভে তেতো স্বাদগ্রস্ত হয়ে থাকেন যা আবার পূর্বাবস্থায় উত্তরণযোগ্য।

তেতো জিভের কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ

লালাহীন শুষ্ক মুখ বা জেরোস্টোমিয়া হলো এমন এক অবস্থা যখন মুখে পর্যাপ্ত লালারস তৈরি হয় না। এতে লালার অভাবে মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্টেরিয়া ও অণুজীবের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ফলে মুখে তেতো স্বাদের উদ্ভব হয়। কিছু কিছু ঔষধ সেবন করলে মুখে শুষ্কতা তৈরি হয়। যেমন : বিষণ্নতা দূরীকরণের ঔষধ, মূত্র বর্ধক ঔষধ , মাংশপেশি শিথিলকরণের ঔষধ, হিস্টামিন প্রতিরোধক প্রভৃতি সেবনে মুখে শুষ্কতা তৈরি হয় ও তেতো স্বাদের উদ্ভব হয়।

কতিপয় রোগ ও ব্যাধি যেমন : এইডস্, জোগ্রেন সিন্ড্রোম, লুপাস, থাইরয়েড হরমোনের হ্রাসবৃদ্ধি, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, ক্যান্সার চিকিৎসার ঔষধ গ্রহণ, মুখে নিঃশ্বাস নেওয়া, স্নায়বিক ক্ষয় সাধন প্রভৃতি অবস্থায় মুখে শুষ্কতা ও তেতো স্বাদের উদ্গম হয়।

আবার মাড়ির রোগ ও প্রদাহ, দাঁতে ক্ষয়, মুখ গহ্বরের ক্যান্সার, দাঁতের পরিচর্যাহীনতায় তেতো স্বাদের উপদ্রব হয়। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ ও উপযুক্ত মাউথওয়াশ বা ওরাল সলিউশন দিয়ে গরগরা করলে এ অবস্থা হতে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়।

গর্ভকালীন হবু মা মুখে ধাতব ঘ্রাণ বা স্বাদ অনুভব করেন। এসময় হরমোনের প্রভাবে মায়েদের ঘ্রাণের অনুভূতি পরিবর্তিত হয়। ফলে জিভে তেতো স্বাদের উদ্ভব হয়।

মুখে জ্বালাপোড়া করার এক ধরনের রোগ আছে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ গহ্বর অদ্ভুত এক অনুভূতির শিকার হয়। এসময় কেউ কেউ তেতো স্বাদ অনুভব করতে পারেন। এ অবস্থাকে বার্নিং মাউথ সিন্ড্রোম বলে। এ রোগে আক্রান্ত কেউ কেউ খাবার গ্রহণ ও জলপানে অতিরিক্ত জ্বালাপোড়ায় ভোগেন আর কেউ কেউ এতে উপসর্গ সমূহ প্রশমিত বোধ করেন।

নারীদের রজঃস্রাব নিবৃত্তির কারণেও কেউ কেউ জিভে তেতো স্বাদ অনুভব করেন। কারণ এসময় নারীর রক্তে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায় এবং এর ফলে মুখে দহন বা জ্বালাপোড়া অনুভূতির সৃষ্টি হয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে মুখে শুষ্কতা বজায় থাকলেও জ্বালাপোড়া ভাব হতে পারে।

পরিপাক নালীতে এসিডের রিফ্লাক্স বা উল্টোপথে উছলে পড়ার কারণে জিভে তেতো স্বাদ হয়। এতে অন্ননালী ও জিভে দহনজ্বালা হতে পারে।

মুখে ক্যানডিডা অ্যালবিকানস্ নামের ছত্রাকের সংক্রমণেও স্বাদ কোরক নষ্ট হয়ে গিয়ে তেতো স্বাদ দেখা দেয়।

তীব্র জ্বরে জিভে পাইরোজেনের বৃদ্ধিতে তেতো স্বাদ হয়। এসময় প্রদাহজনিত প্রোটিনের প্রভাবে তেতো ভাব তৈরি হয়। জন্ডিসে বিলিরুবিনের প্রভাবে জিভে তেতো স্বাদ হতে পারে। পাইনের বাদাম খেলে তার বারো থেকে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে জিভে ব্যতিক্রমী তেতো স্বাদ অনুভূত হয়। একে ‘পাইন নাট সিন্ড্রোম’ বলে। এর পরিণামে মুখে তেতো ও ধাতব গন্ধ তৈরি হয়। এ রোগ দু থেকে চার সপ্তাহ্ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়।

অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ শরীরের প্রতিক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে এবং এতে ব্যক্তির স্বাদের ধরন পাল্টে গিয়ে তেতো হয়ে যায়। অতি উদ্বেগে জিভ ও মুখ শুষ্ক হয়ে যায় এবং তিক্ত স্বাদ উদ্গম করে।

কখনও কখনও সংশ্লিষ্ট স্নায়ু বিকল হয়ে গেলে ব্যক্তির স্বাদ কোরকে প্রতিক্রিয়া হয় ও তেতো স্বাদ তৈরি হয়। স্নায়বিক বৈকল্যের নানাবিধ কারণ আছে। তার মধ্যে এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগ, বেলস্ পলসি, ব্রেইন টিউমার, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিক্ষয়, মাল্টিপল্ স্ক্লেরোসিস নামীয় রোগ উল্লেখযোগ্য।

কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, ম্যালেরিয়া উপশমের ঔষধ, হৃদরোগের ঔষধ, তামা-আয়রন-জিঙ্ক সমন্বিত ভিটামিন ও মিনারেল, লিথিয়াম ধাতু সঞ্জাত ঔষধ, জ্বর উপশমের প্যারাসিটামল মুখে তিক্ত স্বাদ তৈরি করে।

কিছু কিছু রোগে প্রদাহ তৈরিকারী প্রোটিনের কারণে মুখের স্বাদ তেতো হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন রোগীর মুখের স্বাদও তেতো হয়ে আসে। কারণ ক্যান্সারের ঔষধ ও রেডিয়েশনে জিভের স্বাদ কোরক নষ্ট হয়ে যায়।

মুখের দীর্ঘমেয়াদী তেতো স্বাদ বা স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে ডিসজিউশিয়া। তেতো স্বাদ হতে মুক্তির উপায় হলো নিয়মিত দাঁতের ও মুখ গহ্বরের যত্ন নেওয়া, জীবাণু বিনাশকারী মাউথওয়াশ ব্যবহার করা, চিনিমুক্ত চুইংগাম চিবানো, পর্যাপ্ত পানি পান করা, অতিরিক্ত তেল-মশলা দেওয়া খাবার পরিহার করা, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন হতে বিরত থাকা ইত্যাদি সু-অভ্যাস গড়ে তোলা।

তথ্যঋণ : অভি ভার্মা, এমডি, এমপিএইচ, জন জনসন, ম্যান্ডি ফ্রেঞ্চ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়