বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

জীবন-স্মৃতি

সরকার আবদুল মান্নান
জীবন-স্মৃতি

ইংরেজি পড়ানো জন্য আরেকজন শিক্ষক এসেছিলেন তোলারাম কলেজে। তাঁর নাম কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। উজ্জ্বল শ্যামলা মাঝারি গড়নের এই স্যারের সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় ছিল তাঁর ঘনবদ্ধ গোঁফ। ওই গোঁফ হিটলারের মতো টুথব্রাশ গোঁফ নয়, এঙ্গেলসের মতো সিন্ধুঘোটক টাইপ গোঁফও নয় কিংবা সালভাদার দালির গোঁফের ধারে কাছেও নয়। এমনকি ফু মঞ্জু, অশ্বখুর, সাম্রাজ্যিক, মেক্সিকান স্টাইলের গোঁফও নয়। একদম অন্যরকম। বলা যায় ওয়ালরাস টাইপের গোঁফ যা নাকের নিচ থেকে ঘনবদ্ধ হয়ে মুখকে অতিক্রম করে চলে এসেছে, এমন।

স্যার যখন কথা বলতেন তখন ওই ঘনবদ্ধ গোঁফ অতিক্রম করে কথাগুলোর বেরিয়ে আসতে খুব কষ্ট হতো। ফলে অনেক সময় মনে হতো, স্যার বুঝি নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু একটি বিষয় আমরা সবাই অনুধাবন করছিলাম যে, শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য স্যারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আরেকটি বিষয় আমাদের ভীষণ ভালো লাগত, আর সেটি হলো স্যারের সহজ-সুন্দর আচরণ। তিনি ঢাকা থেকে কলেজ করতেন, কিন্তু ক্লাসে কখনো বিলম্বে প্রবেশ করেননি। বরং অনেক সময় আমারই অগোছালো অবস্থায় থাকতাম এবং স্যারের সামনে নিজেদের সামলে নিতাম, যার যার সিটে গিয়ে বসতাম কিংবা হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে ঢুকে দ্রুত প্রস্তুত হতাম।

কলেজ-জীবনে কাজল স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কখনোই আমার পরিচয় হয়নি। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জানলম যে, তাঁর ছোট বোন কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজিতে পড়ে। আমরা একই ইয়ারে। এবং সেই থেকে কল্যাণী আমার বন্ধু। আর কাজল স্যারের আরেক ভাই অমলকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। অনিবার্যভাবেই কাজল স্যারের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয় এবং আজ অবধি ওই সম্পর্ক অটুট আছে।

এই সম্পর্কের মূলে আছে আদর্শগত ঐকতান এবং লেখালেখির জগৎ। আদর্শের দিক থেকে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে আস্থাশীল এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক। আমি যতটুকু জানি তাতে বলতে পারি যে, তাঁর পুরো পরিবারটিই এই মূল্যবোধের পরিতোষক।

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার কবি, প্রবন্ধিক ও অনুবাদক। পিএইচডি ডিগ্রির জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছেন নাইজিরিয়ান নাট্যকার ও নোবেল বিজয়ী ওলে সোয়িংকার সাহিত্য নিয়ে। আফ্রিকার সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বহুদিনের। আফ্রিকার সাহিত্য আমারও খুব প্রিয় বিষয়।

তাঁর গবেষণা, কবিতা সৃষ্টি, প্রবন্ধ রচনা এবং অনুবাদ সাহিত্য সর্বত্রই তিনি মেহনতি মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িক জীবনাকাঙ্ক্ষার পক্ষে। আর তাঁর আদর্শগত শত্রুপক্ষ হলো ঔপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জঙ্গিবাদ।

আমার এই প্রিয় শিক্ষক ও প্রিয় মানুষটির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হলো কাঙাল দীর্ঘকাল (১৯৮৫), দগ্ধ ধূলিকণা (১৯৮৬), পৃথিবীর গৃহকোণ (১৯৮৮), উত্থানের মন্ত্র নেই (১৯৮৯), হেসে ওঠে অশ্রুজল (১৯৯৮) ঊনস্বাদ উচ্চারণ, ফুলও উন্মত্ত রঙিন ইত্যাদি।

প্রবন্ধগ্রন্থ : স্বপ্ন (১৯৮৫), সাম্রাজ্যবাদ : অন্য উন্মোচন (১৯৮৬), কথা কালান্তরের, প্রগতির (২০০৯), প্রগতি সাহিত্য : কতিপয় তত্ত্ববিচার (২০১১), রবীন্দ্রনাথ : ধর্মভাবনা (২০১২), ঋবসধষব ঢ়ড়বিৎ ধহফ ঝড়সব ওনংবহ চষধুং (২০১২) ।

অনুবাদ গ্রন্থ : স্যমবেন উসমান রচিত অভিশাপ (২০১৫), এমে সেজারের ঔপনিবেশিকতার মুখোশ উন্মোচন (২০১৪), পাবলো নেরুদার তুচ্ছের পদাবলী (২০১৪), ফিডরিখ এঙ্গেলস-এর অ্যান্টিডুরিং (সমাজতত্ত্ব) (২০০৭), উশ্রী সেনগুপ্তের পাভলভীয় মনুষ্যত্বের প্রাথমিক পরিচয় (২০০৫), অ্যাগনিস অ্যালেন-এর ইউরোপের চিত্রকলা (১৯৯২) এবং বরিস গোরিজন্তভ এর পুঁজিবাদ ও পরিবেশ বিনাশ (১৯৮৮) ইত্যাদি। এছাড়া তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন । সম্ভবত ১৯৯৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এখনো ওই পেশায় নিয়োজিত আছেন।

কাজল ব্যানার্জি স্যার ব্যক্তিগত জীবনে খুবই নিরহঙ্কারী, বিনম্র, নির্জনতাপ্রিয়, নির্লোভ ও প্রতিবাদী চেতনার মানুষ। এই মনোগড়নের জন্য স্যারকে আমার ভালো লাগে এবং আজ অবধি তাঁর সঙ্গে আমার নিবিড় একটি সম্পর্ক আছে। আমি স্যারের কল্যাণময় সুস্থ-সুন্দর দীর্ঘায়ু কামনা করি।

তোলারাম কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন বুলবুল স্যার এবং শাহাদাত স্যার। কিন্তু ক্লাসরুমের বাইরে তাদের সঙ্গে আমার কখনোই কথা হয়নি। এমনকি ক্লাস চলাকালেও কোনো কথা হয়নি। ফলে তাঁদের স্মৃতি খুবই ম্লান হয়ে গিয়েছে। তবে শিক্ষকতার পেশায় আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম বুলবুল স্যারের ক্লাসে। বুলবুল স্যার কবিতা পড়াতেন এবং তাঁর পড়ানোর ভঙ্গিটা ছিল প্রবলভাবে চিত্তাকর্ষক ও তথ্যসমৃদ্ধ। তিনি পাঠকে (পড়হঃবহঃ) আশ্রয় করে পাঠ- সংশ্লিষ্ট জগতে (পড়হঃবীঃ) এমন স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতেন যে আমরা রীতিমতো বিস্মিত হতাম।

এমনই একদিন কোনো একটি কবিতা পড়াতে গিয়ে তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘আটবছর আগের একদিন’ শীর্ষক কবিতাটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছিলেন এবং আমি কবিতা সংক্রান্ত পাঠের একটি নতুন জগৎ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেদিন মনের অজান্তেই আমি বুলবুল স্যারের মতো শিক্ষক হওয়ার প্রার্থনা করেছিলাম, আর মহান স্রষ্টা সেই বিমুগ্ধ মুহূর্তে হৃদয়ের কোন গোপন প্রদেশে অঙ্কুরিত আকাঙ্ক্ষা কবুল করে ফেলেছিলেন। বুলবুল স্যারের মতো যোগ্য শিক্ষক হয়তো হতে পারিনি, কিন্তু শিক্ষক যে হয়েছি তার জন্য এই জীবনের কাছে সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার কিশোর হৃদয়ে ওই পরিশুদ্ধ আকাঙ্ক্ষাটুকু সৃষ্টির জন্য আমি বুলবুল স্যারের কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ।

এতদিন পরে যতটা মনে পড়ে, আলাউদ্দিন স্যার এবং ভবেশ স্যার আমাদের পদার্থবিজ্ঞান পড়তেন, হালিম স্যার এবং বাশার স্যার পড়াতেন রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা পড়াতেন হাবিব স্যার এবং নজরুল স্যার পড়াতেন উদ্ভিদবিদ্যা। কিন্তু উচ্চতর গণিত কে পড়াতেন এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। এর কারণও আছে।

ছাত্র-জীবনে গণিতে আমি কখনোই ভাল ছিলাম না। "ভালো ছিলাম না" বললে ঠিক বলা হয় না। বরং আমি মনেও করতে পারিনা যে, হাই স্কুলে এসে কখনো আমি গণিতে পাস করেছিলাম কি না। কারণ অধিকাংশ সময় গণিতে আমার নম্বর থাকত তেত্রিশ। সাধারণ তখন ছাব্বিশ-সাতাশ যারা পেত, সদাশয় শিক্ষকগণ তাদের কিছু নম্বর গ্রেজ দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন। সুতরাং যখন আমি তেত্রিশ পেতাম তখনই দূর থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতাম। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষায় যখন আমি অনেকগুলো পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি মুখস্থ করে পঞ্চাশের কাছাকাছি নম্বর পেয়ে গেলাম তখন আমরা মনে হয়েছিল আমি তো গণিতে খুবই ভালো। এবং নিজের উপরে বিশ্বাস এতটাই বেড়ে গেল যে, এইচএসসি-তে উচ্চতর গণিত নিয়ে নিলাম। কিন্তু জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক ছিলাম। উচ্চতর গণিত নিয়েছিলাম ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। দুএকদিন ক্লাসে গিয়ে বুঝলাম, ওই জিনিস এই জীবনে বুঝা হবে না, সম্ভবও নয়। ফলে ক্লাস করা আর হলো না। এবং ফাইনাল পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে শূন্য পেয়েছিলাম। সুতরাং যে শিক্ষকগণ এই সাবজেক্ট পড়তেন তাদেরও বেমালুম ভুলে গেছি।

ছাত্র-জীবনে কলেজ হলো খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের বিদ্যায়তন। সব মিলিয়ে বছরখানেক ক্লাস হয় কি না সন্দেহ। এর মধ্যে তোলারাম কলেজে বাইরে থেকে আগত আমাদের মতো কিছু শিক্ষার্থী ছিল যারা অনেকটাই আগন্তুক। না শিক্ষকদের সঙ্গে, না সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ বা সময় কোনোটাই আমাদের ছিল না। ফলে পুরো সময়টা বিচ্ছিন্নই ছিলামণ্ড কোনো কিছুর সঙ্গেই তেমন কোনো বন্ধন তৈরি হয়নি।

অধিকাংশ শিক্ষক, বিশেষ করে যারা বিজ্ঞান পড়াতেন- কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের ব্যস্ততা, গল্পস্বল্প, আড্ডা লক্ষ করতাম। অনেক পরে বুঝেছি, এই শিক্ষার্থীরা ওইসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে। আমরা যারা আগন্তুকের মতো এবং নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সঙ্কটে থাকতাম, তাদের একটু কুশলাদি জানার সময় বা সুযোগ আমার কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক কোনোদিন পাননি। ফলে অধিকাংশ শিক্ষকদের নিয়ে কোনো স্মৃতি নেই।

ফিজিক্স প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা। কে কোন বিষয়ে পরীক্ষা দেবে তার জন্য লটারির আয়োজন করেছেন ভবেশ স্যার। কিন্তু খুবই অবাক কাণ্ড, আমি একবার দুই বার নাকি তিন বার কাগজ তুললাম, দেখি অপ্রচলিত বিষয়। ভবেশ স্যার বললেন, "এই ছেলে, তোমার পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নাই। যাও তুমি।"

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনির। ইতঃপূর্বে ওদের বাসার কথা উল্লেখ করেছি। মনিরের পরীক্ষা ছিল বিকেলে। সকালে ও কেন কলেজে গিয়েছিল জানিনা। ও ভবেশ স্যারকে বলল, ‘স্যার, মান্নান এখন পরীক্ষা না দিক। ও বিকালে আমাদের সঙ্গে পরীক্ষা দিলে কোনো সমস্যা আছে?’

ভবেশ স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি বিকালে পরীক্ষা দিও। এখন যাও।’

আমি মনিরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে মনির বলল, ‘কমন বিষয় সব তো স্যার তাঁর প্রাইভেট ছাত্রদের দিয়ে দিছেন। তোরা পাবি কোথ্থেকে?’

মনিরের কথা শুনে আমি মনে করতে পারছিলাম, স্যার কিছু শিক্ষার্থীর হাতে কাগজ দিয়ে দিয়ে প্রাক্টিক্যাল করতে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। দুপুরে মনিরের বাসায় খেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম। মনির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু মুখের ব্রণ ইনফেকশন হয়ে মনির মারা যায়। এই সহজ সুন্দর বিনম্র ও নির্জনতাপ্রিয় বন্ধুটিকে আমি কোনো দিন ভুলতে পারিনি।

আর একটি খুব ছোট স্মৃতি আমি সারাজীবন মনে রেখেছি। কেমিস্ট্রি পড়াতেন হালিম স্যার। প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। হালিম স্যার আমার কাছে এলেন। আমাকে বললেন, ‘দেখিত বাবা কী করেছ।’

আমি জায়গাটা ছেড়ে দিলাম। স্যার বললেন, “খুব ভালো হয়েছে।” এবং কিছু কিছু বিষয় চিহ্নিত করে আবার একটু দেখতে বললেন। কলেজ থেকে প্রায় সেই বিদায়লগ্নে কোনো শিক্ষক আমাকে "বাবা" বলে সম্বোধন করলেন। এই জীবনে হালিম স্যারকে আমি কোনো দিন ভুলতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি ঘটনা বলি।

বিখ্যাত কথাসাহিত্য মাহমুদুল হক। ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সালের ২১শে জুলাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আমি মাঝেমধ্যে তাঁর জিগাতলার বাসায় যেতাম। আমার প্রিয় কথাসাহিত্যককে নিয়ে আমি অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা কথাসাহিত্য : আধুনিকতার কুশীলব’ শীর্ষক আমার প্রবন্ধগ্রন্থে এই কথাসাহিত্যিককে নিয়ে পাঁচটি প্রবন্ধ আছে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলো হলো অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, জীবন আমার বোন, কালো বরফ, অশরীরী, পাতালপুরী, খেলাঘর, মাটির জাহাজ এবং গল্পের বই প্রতিদিন একটি রুমাল। মাহমুদুল হক বটু ভাই নামেই বিপুলভাবে পরিচিতি ছিলেন। ২০০৮ সালে উনি মারা যাওয়ার পর উত্তরাতে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বটু ভাইকে নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রণ পেতাম। উত্তরা গিয়ে দেখি যার বাড়িতে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তিনি আমার কলেজের কেমিস্ট্রির সেই হালিম স্যার। আমি তো বিস্মিত এবং বিমুগ্ধ। বটু ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হালিম স্যার। তিনিই বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার প্রেরণা থেকে ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক হাসনাত ভাই থেকে শুরু করে অনেক গুণীজন ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্যারকে আমি সব কথা স্মরণ করিয়ে দিই। এবং তাঁর পাশে বসে অনেকক্ষণ কথা বলি। তিনি আমার আলোচনা শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং অনেক প্রশংসা করেছিলেন।

প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হয়। কিন্তু শুধু উচ্চমাধ্যমিকটুকু পড়ার জন্য কলেজে অবস্থানের বছরখানেক সময় কারো জীবনেই খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না। তারপর যদি কলেজের কাছেপিঠের শিক্ষার্থী না হয় এবং অনেকটা উদ্বাস্তুর মতো কোনো রকমে কলেজ জীবনটা পার করে দেওয়ার তাড়া থাকে, তা হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে আপন করে নেওয়ার সুযোগ আর থাকে না বললেই চলে। তোলারাম কলেজও আমার কাছে ওইরকমই- না আপন, না পর গোছের একটি প্রতিষ্ঠান। তদুপরি শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তো তৈরি হয়ইনি এমনকি সহপাঠীদের সঙ্গেও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। অধিকাংশ সময় চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে ক্লাস চলত। দুএকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষক অসহায়ের মতো কিছুটা সময় ক্লাসে ব্যয় করে চলে যেতেন। একসম ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গিয়েছিল।

ওই ক্লাসে কয়েকজন ছাত্রী ছিল। তারা যখনই আসুক, সামনের দুতিনটি বেঞ্চ তাদের জন্য রিজার্ভ ছিল। আমার কখনোই মনে হয়নি তারা এই গ্রহের মানুষ। এই মর্ত্যে, এই ধূলিমলিন পৃথিবীতে তারা জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমার কখনোই মনে হতো না। তাদের দেহগড়ন, পোশাকপরিচ্ছদ, সাজগোজ, কথা বলার ধরন এবং হাবভাব দেখে মনে হতো পঙ্খিরাজের ঘোড়ায় চড়ে দয়া করে তারা এই ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন এবং ছাত্রদের থেকে গা বাঁচিয়ে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন। খালেদ হোসাইন কিছুদিন আগে আমাকে বলেছেন এদের নাম নাকি বেবি, কাকলি, জেবিন, গুলশান ইত্যাদি। কিন্তু এদের কারো সঙ্গে কখনোই আমার কথা হয়নি, পরিচয় হয়নি। কখনো কখনো দেখেছি আমাদের কোনো বিরল সৌভাগ্যবান সহপাঠী ওই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছে, হাসিঠাট্টা করছে। তখন আমি অবাক হতাম। ভাবতাম, "আশ্চর্য! এও কি সম্ভব!" এরা প্রত্যেকেই ছিল নারায়ণগঞ্জের অধিবাসী।

বন্দরে আমার একজন বন্ধু ছিল। নাম বাবু। বাবু উজ্জ্বল শ্যামলা, গড়ন হালকাণ্ডপাতলা । পোশাপ-পরিচ্ছদে একদম ভদ্রলোক। পরিশীলিত ও মিষ্টি ব্যবহার। ঢাকাতে আমার এক ভাইকে ফোন করার জন্য প্রথম আমি ওদের বাড়িতে যাই। লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ওদের বাড়িটি দেখে আমি মুগ্ধ হই। শত-সহস্র গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ বিশাল বাড়িটি একদম নির্জন। কোথাও কেউ যেন নেই। সেই ছিল আমার প্রথম ফোন করা। কিন্তু যত সহজে বললাম, ফোনটা কিন্তু তত সহজে করতে পারিনি। অনেক দিকদারি। রিসিভার উঠিয়ে ডায়াল করতে হবে নাকি উঠাতে হবে না, একটি ডিজিট কতটুকু ঘুরাব, ঘুরিয়ে ছেড়ে দেব নাকি ধরে রাখব, ছেড়ে দিলে পরের ডিজিট কখন ঘুরাব। কম ঝামেলা! শেষপর্যন্ত ফোনটা করতে পেরেছিলাম। ওই ঘটনার পর বাবুকে কি করে ভুলি!

কলেজ জীবনে অল্প কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। এরা হলো বাবু (বন্দর), খালেদ, শামীম, নেপাল কর্মকার, মনির, লিটন, জামাল, বাবলা, খোকন, বকুল এবং নারায়ণগঞ্জের বাবু। তোলারাম কলেজের ওই ব্যাচের আমরা দুজন মাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম এবং কাকতালীয়ভাব দুজনই বাংলা বিভাগে- আমি এবং খালেদ। খালেদ হোসাইন এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি কবি ও প্রাবন্ধিক। শামীম রামপুরা থাকেন। তিনি সাহিত্য চর্চা করেন- কবি ও শিশুসাহিত্যিক। নেপাল কর্মকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, বাবু যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক। জামান ও লিটন ব্যবসায়ী। কিন্তু সত্যিকার অর্থে খালেদ, শামীম ও নেপাল ছাড়া আর কারো সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই। এবং এই হলো জীবনের ব্যাকরণ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়