প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২২, ০০:০০
চাপ ও রক্তচাপ : যতোদিন জীবন আছে ততোদিন বিবিধ চাপও আছে জীবনে। সকল চাপের চাপাচাপিতে মানুষের দেহে যার সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো রক্তচাপ। হৃদপি-ের সংকোচন-প্রসারণের ফলে বিভিন্ন রক্তবাহিকার মাধ্যমে রক্ত প্রবাহকালে রক্তনালীর গাত্রে লম্বালম্বি ভাবে যে চাপ অনুভূত হয় তাকে রক্তচাপ বলে।
স্বাভাবিক ও কাক্সিক্ষত রক্তচাপ : হৃদপি- সংকোচনকালে রক্তনালীতে অনুভূত চাপকে সিস্টোলিক রক্তচাপ বলে এবং হৃদপি- প্রসারণকালে অনুভূত চাপকে ডায়াস্টলিক রক্তচাপ বলে। সিস্টোলিক রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা ১১০-১৪০মিলি মি. পারদ চাপ। ডায়াস্টলিক রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা ৬০-৯০মিলি মি. পারদ চাপ। মানুষের সুস্থতা বজায় রাখার জন্যে সর্বানুকূল আকাক্সিক্ষত রক্তচাপ-এর মান < ১২০/৭৫ মিলি মি রক্ত চাপ।
নারী ও উচ্চ রক্ত চাপ : সারাবিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। নারী হচ্ছে পৃথিবীতে সুন্দরতম সৃষ্টিসমূহের একটি। প্রতিটি নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে। বিবাহ-পরবর্তী জীবনে মাতৃত্বের আকাক্সক্ষায় নারী থাকে উন্মুখ। কিন্তু মাতৃত্বকালীন সময়টুকু একদিকে যেমন নারীকে পরবর্তী প্রজন্মের সুখ-স্বপ্নে বিভোর করে তেমনি বিঘœ-বহুল এই সময়টাতে নারীর দেহকে মোকবিলা করতে হয় অনেক ঝুঁকি। কিছু কিছু ঝুঁকি মাতৃত্বকালীন নারীর জীবন সংশয়ের কারণ হয়। এমনই এক জীবন-সংশয়কারী মাতৃত্বকালীন অবস্থার নাম গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে ও সুপ্রসব নিশ্চিত করতে এ বিষয়ে জানা আজ অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ কী : গর্ভাবস্থায় ২০ সপ্তাহের পরে কোনো নারীর যদি উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় তবে তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলে। এই উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত ধমনীর রক্তে নতুন সৃষ্ট উচ্চ রক্তচাপ এবং এই সময়কার মূত্র নমুনায় প্রোটিনের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য থাকে না।
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের ধরণ ও অবস্থা
ভ্রƒণের বিকাশকালীন উচ্চরক্তচাপ
এ ধরনের উচ্চ রক্তচাপে রক্তচাপের মাত্রা ১৪০/৯০ মিলি মি. পারদ চাপের চেয়ে বেশি হয় এবং ২০ সপ্তাহ বা তার অধিক গর্ভাবস্থা বিরাজ করে। মূত্রে প্রোটিন থাকে না বা প্রোটিনিউরিয়া দেখা যায় না।
প্রি-একলাম্পশিয়া : এ ধরনের অবস্থায় রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর চেয়ে বেশি থাকে এবং মূত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রোটিন বিরাজ করে। সারা দিনের বা ২৪ ঘণ্টার মূত্র-নমুনায় ৩০০ মি.গ্রা.-এর অধিক প্রোটিন পাওয়া যায়।
মারাত্মক প্রি-একলাম্পশিয়া : রক্তচাপের মাত্রা ১৬০/১১০/ মিলি মি. পারদ চাপ এর বেশি হয় এবং মূত্রে প্রোটিনিউরিয়া থাকে। পাশাপাশি কতিপয় উপসর্গ তৈরি হয়। যেমন : পায়ে পানি নামা বা রসভার করা, বমি ভাব, দৃষ্টি ঝাপসা, মাথা ঘুরা, মাথা ব্যথা, ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি।
একলাম্পশিয়া : এ অবস্থায় আক্রান্ত গর্ভিনীর উচ্চ রক্তচাপ ও প্রোটিনিউরিয়ার পাশাপাশি খিঁচুনি দেখা দেয়। খিঁচুনি অতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
ঐঊখখচ সিনড্রোম : অতি মারাত্মক অবস্থা যাতে তিনটি বিশেষ দিক পরিলক্ষিত হয় :-
* হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া বা লোহিত রক্তকণিকা নষ্টজনিত রক্তস্বল্পতা
* লিভারের অনুঘটকসমূহের উচ্চ মান
* অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট সংখ্যা হরাস পাওয়া
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি উপাদান
* প্রি-অ্যাকলাম্পশিয়ার পারিবারিক ইতিহাস
* গর্ভের পূর্ব সময়ের উচ্চ রক্ত চাপ
* ডায়াবেটিস
* দেহস্থুলতা বা মেদস্থূলতা
* গর্ভফুলের অস্বাভাবিকতা
১. কোরিওনিক ভিলাই-এর অতি-উন্মুক্ততা
২. গর্ভফুলের রক্তস্বল্পতা/অক্সিজেনস্বল্পতা
৩. একাধিক গর্ভ-যমজ বা ত্রিযমজ ইত্যাদি
৩৫ বছর বা তার অধিক বয়সে গর্ভধারণ
* নবীন মাতৃত্ব
* আফ্রিকান আমেরিকান বর্ণ (অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান রেইস)
* অনুচক্রিকা প্রীতি বা থ্রম্বোফিলিয়া বা অনুচক্রিকার সংখ্যাবৃদ্ধি
* ধূমপান
* অ্যালকোহল সেবন
* অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ
* অধিক মেদবহুল খাদ্য গ্রহণ
* পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়ামের ঘাটতি
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা
কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। কেবল নিবিড় নজরদারি রাখতে হবে যাতে প্রি-একলাম্পশিয়া বা জীবন সংশয়কারী জটিলতাগুলো দ্রুত আমলে নেয়া য়ায়।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী বেশিরভাগ ঔষধই ভ্রণের জন্যে ক্ষতিকর বিধায় অতি সীমিতসংখ্যক পছন্দ হতে ঔষধ নির্বাচন করতে হয়। মিথাইল ডোপা, হাইড্রালাজিন ও ল্যাবিটালল জাতীয়-ঔষধ গর্ভজনিত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি : গর্ভস্থ শিশু মায়ের উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-একলাম্পশিয়ার কারণে জীবন ঝুঁকিতে থাকে। শিশুর ফুসফুস অপূর্ণতায় ভোগে। শিশু মায়ের গর্ভে একটি নিদিষ্ট সময় অতিবাহিত করার পর অপূর্ণ থাকলেও মা ও শিশু উভয়ের জীবনের খাতিরে আগাম জন্ম দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং উপযুক্ত হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
পরামর্শ :
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে নারীকে তথা হবু মা-কে নিরাপদ রাখতে হলে মাকে নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি নি¤েœাক্ত পরামর্শ মানতে হবে।
* ধূমপান ও অ্যালকোহল হতে বিরত থাকা।
* অধিক লবণ গ্রহণ হতে বিরত থাকা।
* শিশু জন্ম বা গর্ভধারণের আগে মেদস্থূলতা থাকলে তা কমানোর ব্যবস্থা করা।
* নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা। আলস্যপূর্ণ জীবন পরিহার করা।
* অতিরিক্ত মেদ ও চর্বি-সম্বলিত খাবার বর্জন করা
* মানসিক চাপ মুক্ত থাকা। হাসি-খুশিতে জীবনাচরণ সম্পন্ন করা জরুরি।
* বিশ বছর হতে ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথম গর্ভধারণ করা
* চিকিৎসকের পরামর্র্শে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিয়মিত গ্রহণ করা।