বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থেকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে?
ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে

বর্তমানে প্রচলিত মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যে সংবাদপত্রের ইতিহাস সবচেয়ে পুরোনো। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে শুরু করে মুদ্রিত এই গণমাধ্যম আজও বিশ্বব্যাপী টিকে আছে। টেলিভিশন কিংবা বেতারের চেয়ে সংবাদপত্রের ইতিহাস বেশ পুরোনো।

বিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি বিশ্ববাজারে বেশ দাপটের সাথে টিকে থেকে মানুষের তথ্য-ক্ষুধা মেটানোর সামাজিক দায়িত্ব পালন করে আসছিল সংবাদপত্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইন্টারনেটের আবির্ভাব মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। এরপর ইন্টারনেটের সুবিধা ব্যবহার করে যেসব নিউজ পোর্টালের আবির্ভাব হয় তাতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা কমতে থাকে।

তথ্য পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠে অনলাইন গণমাধ্যম। ধীরে ধীরে টেলিভিশন ও মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমও অনলাইন ভার্সনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। তবে, অনলাইনে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ বা তথ্য পাওয়ার সুযোগও যেমন সৃষ্টি হয়েছে, অপরদিকে ভুয়া তথ্য, অপতথ্য বা গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যের চাপে বস্তুনিষ্ঠতা ও নির্ভুলতা বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

২০২২ সালে রিউমার স্ক্যানার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ১৪০০ গুজব, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুজব প্রকাশিত হয়েছে ধর্মীয় বিষয়ে।

বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনের অনলাইন ভার্সনে ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত এই সংবাদ তাদের ফেসবুক পেজেও প্রচার করে গণমাধ্যম। প্রায় ২৭ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী সংবাদে রিঅ্যাক্ট দেন, ১ হাজারের বেশি ব্যবহারকারী কমেন্ট করেন, শেয়ার করেন আরও ৩২৬ ব্যবহারকারী।

শুধু ওই অনলাইন ভার্সন নয় দেশের প্রথম সারির দশটিরও অধিক গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনে এই বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। যদিও ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে বিষয়টি ছিল গুজব।

শুধু এমন একটি নয়, ২০২২ সালে রিউমার স্ক্যানার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ১৪০০ গুজব, ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুজব প্রকাশিত হয়েছে ধর্মীয় বিষয়ে। এছাড়া রাজনীতি, জাতীয়, খেলাধুলা ও শিক্ষা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কাতার বিশ্বকাপ নিয়েও ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত হয়েছে। দেখা গেছে, সবচেয়ে বিশ্বস্ত গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনেও ভুল তথ্য সংবলিত খবর বা ভুয়া খবর প্রচার হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সিজন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য সংবাদসূত্রের ব্যবহার এবং ‘ভুয়া খবর’-এর বিস্তার বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সংবাদকর্মীরা। যা সর্বোচ্চসংখ্যক তথা ৩২ শতাংশ সাংবাদিক এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।

এছাড়া সাংবাদিকদের কাজের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের জোগান কম। প্রতি দশজন সাংবাদিকের মধ্যে তিনজন এই চাপ অনুভব করছেন বলে ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।

একটি গবেষণার তথ্য বলছে, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত তথ্যে জনমানুষের আস্থা কম। দেখা গেছে, ১৩৯ জনে ৯৯ জন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইউএসএইডের গবেষণার তথ্য বলছে, প্রকাশিত সংবাদের আধেয় বিশ্লেষণে সংবাদে ভারসাম্য, বস্তুনিষ্ঠতা, সত্যতাণ্ড এই তিনটির উপস্থিতি কম পাওয়া গেছে।

এছাড়া এমআরডিআই-এর ‘ট্রাস্ট বাট ভেরিফাই’ শীর্ষক একটি গবেষণায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে’র কারণে সংবাদ প্রকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে না এই বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, বিষয়টি ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তরে একমত পোষণ করেছে। এছাড়া ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী জোরালোভাবে একমত পোষণ করে উত্তর করেছেন।

অনলাইন সাংবাদিকতার আইনি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সাংবাদিকরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন ও প্রবিধান সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে আইন-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন।

এর থেকে বুঝা যায়, অনলাইন সংবাদের উৎসের সংখ্যা যেভাবে ক্রমাগত বাড়ছে, বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্ভুল সংবাদ প্রচারের চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। এর কারণগুলো হলো, গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য অনলাইন সংবাদ সংস্থাগুলো ও কর্মরত সাংবাদিকের উপর দ্রুত সংবাদ স্টোরি তৈরির চাপ, ‘ক্লিকবেইট’ নিবন্ধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্টের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি, ভার্চুয়াল ইভেন্টগুলোর উপর আরও জোর দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্রমাগত উন্নতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনে অগ্রগতি, তথ্য-নির্ভর সংবাদের চাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

প্রথম তিনটি কারণ প্রতিযোগিতা নির্দেশ করে। উপরের কারণগুলোর জন্যে একজন সাংবাদিককে একই সাথে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা, সূত্রের সুরক্ষা, অনলাইন হয়রানির মোকাবিলা, দ্রুত এবং নির্ভুলতার ভারসাম্য বজায় রাখা, আইনি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী কাজ করা, ভিজ্যুয়াল গল্প বলার চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা, প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে হচ্ছে।

এই প্রতিযোগিতার কারণে তথ্য প্রচারে বেশি ভুল হচ্ছে। যার মাধ্যমে শুধুমাত্র অনলাইন সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতাই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না, এর সাথে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপ তথ্য ছড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। কখনো কখনো চাঞ্চল্যকর শিরোনাম দিতে গিয়ে সামগ্রিকভাবে অনলাইন সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে।

তবে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার জন্যে গণমাধ্যমের কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ব্যবহার করতে পারেন। যেমন, তথ্য যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সাংবাদিকরা বিভিন্ন তথ্য-পরীক্ষার সরঞ্জাম, যেমন ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টুল ব্যবহার করতে পারেন।

এছাড়া সূত্রের সুরক্ষা নিশ্চিতে সংবাদকর্মীরা এনক্রিপশন সরঞ্জাম, যেমন ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন), এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপস এবং এনক্রিপ্ট করা ইমেল পরিষেবা ব্যবহার করতে পারেন যা সংবাদসূত্রের সাথে যোগাযোগ করার সময় তাদের ডিজিটাল পদচিহ্ন থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করতে পারে।

অনলাইন সাংবাদিকতার আইনি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সাংবাদিকরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন ও প্রবিধান সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে আইন-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। ভিজ্যুয়াল গল্প বলার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো এই দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মশালার আয়োজন করতে পারে।

আর প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সাংবাদিকতার নতুন টুলস এবং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারেন। অনলাইন সাংবাদিকতার সর্বশেষ প্রবণতা এবং উদ্ভাবনের সাথে পরিচিত হতে পারেন।

বস্তুনিষ্ঠতার সাথে ঘটনা বা সমস্যা সম্পর্কিত প্রতিবেদন করার দক্ষতা সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই দ্রুততা এবং নির্ভুলতার ভারসাম্য রক্ষার জন্যে সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাইয়ের পদক্ষেপ নেওয়া যায়। অনলাইন সংবাদ সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন পরিসরের দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং চাঞ্চল্যকর বা পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন এড়িয়ে বস্তুনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে পারে।

এছাড়া ভুল তথ্য প্রচারের সম্ভাবনার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য, অনেক অনলাইন সংবাদ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনের নির্ভুল তথ্য নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্ট চেকিং প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেছে। একাধিক উৎস থেকে তথ্য যাচাই করা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া এবং ডেটা ক্রস-চেক করার মাধ্যমে প্রতিবেদনের নির্ভুলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকেন।

আরেকটি সম্ভাব্য দিক হতে পারে ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ বৃদ্ধি। যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের সম্প্রদায়ের ঘটনা এবং সমস্যা সম্পর্কে রিপোর্ট করতে তাদের স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নতুন প্রযুক্তি যেমন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

মহান পেশা হিসেবে সাংবাদিকরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। তারা সত্য প্রকাশে নির্ভীক। এই কাজটি করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে বা ভবিষ্যতে সৃষ্টি হতে পারে, সাংবাদিকদের সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রাযুক্তিক জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়