প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
নিয়তি যখন চিত্রনাট্য রচনা করে তখন তা পাল্টানোর সাধ্য কারও নেই। তাতে আমরা কুশীলব হয়ে যার যার ভূমিকায় অভিনয় ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। বত্রিশ দলের মহারণে অংশ নিয়ে ষোলটি দল পায় নকআউটে দ্বিতীয় পর্বে খেলার সুযোগ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এশিয়ার দল সৌদি আরব যেমন তাদের প্রথম ম্যাচেই ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনাকে ধরাশায়ী করে, তেমনি প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়ে শক্তিধর জার্মানী বুঝিয়ে দিয়েছে, চিত্রনাট্যকার এবার অন্য কিছু লিখে রেখেছে। এই চিত্রনাট্যের মূল রূপ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে শুরু করে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ হতে। অপেক্ষাকৃত বয়সী একটা দল নিয়ে লুকার মড্রিচ যেভাবে ভাগ্যের সহায়তায় টাইব্রেক করে কোটি কোটি সেলেসাও ভক্তদের হার্ট ব্রেক করে দিলো, তাতেই বুঝা গেছে, এবার চিত্রনাট্যকার কী চাইছেন। যে খেলা দিয়ে মড্রিচ গং নেইমার গংকে বাতিল করে দিলো, সেমিফাইনালে চিত্রনাট্যকারের এবারের প্রিয় দলের বিরুদ্ধে সেই খেলার ছিটেফোঁটাও তারা দেখাতে পারলো না। ফলে সকল দর্শকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক হলো, এই মানের একটা দল কীভাবে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে? আসলে সব দিন সবার সমান যায় না। ফলে বাঙালি হৃদয়ের নয়নমণি মেসি ও তার দল ফাইনালে গিয়ে অপেক্ষায় রইল প্রতিপক্ষের। আর ফ্রান্সও কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের হাত থেকে পার পেয়ে উপনীত হলো মরক্কোর বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে। এই সেমিফাইনালটিও কাঙ্ক্ষিত মানের না হওয়ায় রাতজাগা দর্শকদের মনে অতৃপ্তি রয়ে গেলো বরাবরই। আর্জেন্টিনাকে মোকাবেলার জন্যে ফ্রান্স পেয়ে গেলো ফাইনালের ছাড়পত্র। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সাথে মরক্কো পেরে ওঠেনি ঠিকই, তবুও আফ্রিকার মানকে উন্নীত করে দিয়ে গেছে বিশ্বকাপে। এ খেলার উল্লেখযোগ্য দিক একটাই, ক্রোয়েশিয়ার সুদর্শনা সাবেক প্রেসিডেন্ট মেলিন্দার গ্যালারিতে উপস্থিতি। মাত্র চার বছর আগে তিনি এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট রূপে দলের মনোবল বাড়াতে। মিডিয়ায় তাঁর সহাস্য মুখের ঝলক পেয়ে বিগলিত হয়ে গেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু চার বছর পরে ২০২২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দলকে মনোবল যোগাতে মাঠে এলেও তাঁর প্রতি মিডিয়ার মনোযোগ ছিল না মোটেই।
বহুল কাঙ্ক্ষিত ফাইনালে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা নামলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ছিল লিওনেল মেসির নিñিদ্র ঘাঁটি। কোটি জনতার আচরণে মেসি ও আর্জেন্টিনা হয়ে ওঠে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিকল্প। ফ্রান্সের সমর্থক সেই তুলনায় বাংলাদেশে নগণ্য। দুষ্টু ফুটবল আমোদীদের প্রশ্ন ছিল মেসি পেনাল্টিটা কখন পাবেন? প্রথমার্ধে নাকি দ্বিতীয়ার্ধে? এটার কারণ হলো, ফাইনালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোন না কোনভাবে মেসি ও আর্জেন্টিনা একটা পেনাল্টি পেয়ে যায়। এই প্রশ্নকে বৈধতা দিতেই যেন ফাইনালে মেসি ও তার দল প্রথমার্ধে একটা পেনাল্টি গোল থেকে এগিয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে ক্রীড়া পিপাসুদের যে তৃষ্ণা ছিলো ফাইনালকে ঘিরে তাতে সবারই মনের আশা পূরণ হয়েছে বলা যায়। স্মরণকালের মধ্যে এরকম একটা জমজমাট উত্তেজনার ফাইনাল আর দেখা যায়নি। যদিও প্রথমার্ধের ত্রিশ মিনিট ফ্রান্সকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ধীরে ধীরে তারা সংগঠিত হয়। ফাইনাল যদিও দুই দলের মধ্যে, তবুও এটা এক সময় মেসি ও কিলিয়ান এমবাপের দ্বৈরথে পরিণত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা কিলিয়ান এমবাপেকে আটকে রাখতে পেরেছিলো, ততক্ষণ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু ক্ষিপ্র চিতাকে যেমন অনেকক্ষণ আটকে রাখা যায় না, তেমনি এমবাপেকেও তারা বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারেনি। খোলস ছেড়ে বেরিয়েই এমবাপে সন্ত্রস্ত করে তোলে আর্জেন্টাইন প্রতিরক্ষাকে। খেলার আশি মিনিট অব্দি দুইগোলে এগিয়ে থেকে আর্জেন্টাইন শিবির যখন নিরাপদ মনে করে মাঠ থেকে তুলে নেয় অভিজ্ঞ ডি মারিয়াকে, তখনই শুরু হয় হার্টব্রেক করা চমক। গতিমানব কিলিয়ান এমবাপের এক মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোলের সুবাদে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের খেলাতেও ছিল চমকের ঝলকানি। মেসির গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গেলেও এমবাপের গোলে তা আবারও সমতায় চলে আসে। ফলে টাইব্রেকার ছাড়া উপায় থাকে না। এতোক্ষণ খেলায় মেসি আর এমবাপের প্রতিযোগিতা ছিল। মেসির দুই গোল আর এমবাপের তিন গোলে খেলা ছিল সমানে সমান। কিন্তু টাইব্রেকারে নায়ক হয়ে ওঠে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, আর্জেন্টিনার প্রাচীরতুল্য গোলকিপার। প্রতিপক্ষের দুটো শট ঠেকিয়ে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ মেসিকে বানিয়ে দিলেন বিশ্বকাপের মালিক।
এবারের বিশ্বকাপ আর্জেন্টাইনরা যতটা না দেশের জন্যে খেলেছে, তার চেয়ে বেশি খেলেছে মেসির জন্যে। মেসির ছিল এটাই শেষ বিশ্বকাপ। তার শ্রেষ্ঠত্বে কলঙ্ক থেকে যেতো যদি একটা বিশ্বকাপ তার অধরা থেকে যেতো। তবে মেসিকে যে পরিমাপে সেরা ভাবা হয় বিশ্বকাপে তাকে সেই রূপে কখনো দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে তার দুয়েকটা ঝলক বিশ্ববাসী দেখেছে। কিন্তু ক্লাবের খেলায় মেসি যেরকম শিল্পী, বিশ্বকাপের মাঠে তিনি সে রকম ত্রাস হয়ে উঠতে পারেননি প্রতিপক্ষের। মেসির সবচেয়ে বড় পারঙ্গমতা হলো কয়েকটি ব্রিলিয়ান্ট পাস বানিয়ে দেয়া, যেগুলো সত্যিকার অর্থেই নান্দনিক। বিশ্ব ফুটবলে মেসি তার চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন কিছুটা তার নৈপুণ্যে আর অনেকটাই দর্শকের ভালোবাসায়। সেই তুলনায় কাপ এনে দেয়া এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নিষ্প্রভ হয়ে থাকবেন মেসি নামের মহাতারকার জ্যোতিতে। মেসি কাপ জিতলেও ফাইনালের আলোটুকু নিজের করে নিয়েছেন ফরাসী এমবাপে, যার পায়ে বল গেলেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ। এমবাপে যে আগামীদিনের মহাতারকা এটা প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেল এবারের কাতার বিশ্বকাপ। কেবল গোল্ডেন বুটে তার পারদর্শিতা উপযুক্তভাবে প্রকাশিত হয় না। তিনি গোল্ডেন বলেরও সমান দাবিদার। তাকে গোল্ডেন বল হতে বঞ্চিত করাটা আয়োজকদের সীমাবদ্ধতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
কাতার বিশ্বকাপ মানুষের মনে যেমন মেসিকাপ হয়ে থাকবে, তেমনি এটা এমবাপেকেও সমানভাবে মনে করিয়ে দিবে। তবে ইসলামিক আইনকানুনের কারণে এ বিশ্বকাপ মিডিয়ার মন ভরাতে পারেনি। কেননা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে মাঠের চেয়ে গ্যালারির আবেদন বেশি থাকে। রঙবেরঙের গ্যালারি শো না হলে মনেই হয় না বিশ্বকাপ চলছে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা মাত্র আটাশ দিনে শেষ হয়ে যাওয়ায় অতৃপ্তি মনে গেঁথে আছে। আবার চার বছরের প্রতীক্ষায় দিন গুণবে সারাবিশ্ব।