প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেষ বিকেলের অতিথি
আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে।
খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে তার সাথে আমার দূরত্ব বেড়ে যেত। এই যেমন কোনো দিন হয়ত ফেসবুকে মেসেজ দেরিতে রিপ্লাই, আবার কোন দিন হয়ত মেসেঞ্জারে এনাদার কল থাকা, কোনো দিন ক্যাম্পাসে দেরিতে উপস্থিত হওয়া।
জন্মদিনের একটি কথা মনে পড়ে। চন্দ্রা আগেই বলেছিল আমি যেনো যেতে দেরি না করি। সকাল থেকে শুরু করে পুরোটা দিন আমাকে নিয়ে সে ঘুরবে। যেদিকে মন চায় ছুটে যাবে। জেমস ক্যামেরনের বিখ্যাত টাইটানিক মুভির জ্যাক ও রোজ এর চরিত্র হয়ে দুহাত প্রসারিত করবে।
তবে এসব কাল্পনিকতার চেয়ে বাস্তবতায় আমরা রেললাইন দিয়ে দুজন হাত ধরে পথ পাড়ি দিতাম। সেটা ছিল অন্যরকম অনুভূতি।
বেদনার কথা সেদিনও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। যেতে প্রায় পৌনে ১১টা বেজে যায়। পৌঁছানো মাত্রই দেখি চন্দ্রা রেগে বারুদ হয়ে আছে। যেকোনো মুহুর্তে বিষ্ফোরণ ঘটবে। অনেক বুঝিয়েও কোননো লাভ হলো না। জন্মদিনের গিফটা হাতে দিয়েই চলে গেল। তার কড়া কথা অলস মানুষদের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। দু’হাত জোর করে ক্ষমা চেয়েছিলাম কিন্তু ক্ষমা হয়নি সেদিন।
তবে পরদিন মেসেজে সরি-টরি লিখি। মেসেঞ্জার ভয়েসে সরি বলি। পরে ক্ষমা পেয়েছিলাম। আবার আমরা আগের মতো চলতে থাকি। সম্পর্কের টানাপোড়েন না হলে, সেটা ভালোভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। তবে শয়নে বা জাগরণে সব ছিল চন্দ্রা। আমি তাকে পাবার বিভোরতায় হারিয়ে যেতাম। স্বপ্ন মহাসাগরে ডুবে যেতোম। তাকে নিয়ে চলে যেতাম হাজার তারার দেশে। হাতে হাত রেখে দূর অজানায় চলে যেতাম। তবে চন্দ্রাকে নিয়ে ভালোবাসায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হতো দূর কোনো দেশে। যেখানে কেউ থাকবে না শুধু আমি আর চন্দ্রা ছাড়া। সে আমাকে খুবই ভালোবাসত। কিন্তু সেটার বিহঃপ্রকাশ করতো না। এই ভালবাসা আমি বুঝেও ভণিতা ধরে থাকতাম।
সবশেষে তার সাথে আমার যে বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়, যার জন্য সে আমাকে একা রেখে চলে যায়। সে ঘটনাটি ছিল তুচ্ছ।
আমি আর চন্দ্রা মিলে রিকশায় ঘুরছি। হঠাৎ আমার ধুমপানের নেশা উঠে। আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করি। সে সিগারেটটি ফেলে দিতে বলে। আমি না করি। এক পর্যায়ে সে জেদ করে বলে আমি সিগারেট নাকি চন্দ্রা কাকে চাই?
তখন যেনো আমার মাথায় কোনো কিছু কাজ করে না। আমি তাকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ষোল বছরের বন্ধু সিগারেট কে ছাড়তে পারবো না কিন্তু তোমাকে ছাড়তে পারবো। বলতেই চন্দ্রা রিক্সা থেকে লাফ দেয়। আমিতো হতবাক। ওর হাত পা রক্তাক্ত হয়ে যায়। আমি কাছে গিয়ে সরি বলি। জোরে চিৎকার দিয়ে বলল তুমি আমাকে ছোঁবে না, এখান থেকে চলে যাও। আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম চন্দ্রার চলে যাওয়া। পরে অনেক চেষ্টায় ব্যর্থ হই তার সাথে যোগাযোগ করতে। তার কোনো সাড়া মেলেনি। সেই যে গেল আর কোনদিন খবর নিল না। আজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ডাক্তার হাতে সময় বেধে দিয়েছেন। আর হয়ত কিছুদিন পর মারা যাব। যদি সেদিন ছোট্ট এই বিষয়টি মেনে নিতাম, তাহলে হয়ত আমাকে আজ ফুসফুস ক্যান্সারে মরার জন্য প্রহর গুনতে হতো না। এভাবে চন্দ্রাকেও হারাতে হতো না। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বালিশে অশ্রুবিন্দু ঝড়িয়ে শেষ বিকেলের অতিথি হয়ে শুধু চন্দ্রার কথাই এভাবে মনে করতে হতো না।