প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
হুমায়ূন আহমেদের ফ্যান্টাসি
হুমায়ূন আহমেদের কোন ধরনের রচনা আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করে, সাধারণ পাঠকের দিকে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিলে একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম উত্তর আসবে। ছোটগল্প, সামাজিক উপন্যাস, হিমু সিরিজ, মিসির আলি সিরিজ, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক উপন্যাস এমনকি শিশুতোষ রচনা অথবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও বিভিন্ন বয়সের পাঠকের কাছে দারুণভাবে নন্দিত, সমাদৃত। হুমায়ূন আহমেদের রচনার এই অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানে অনেকেই আত্মনিবেশ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আগামীতে আরো বেশি গবেষণার জীব্য হয়ে উঠবে হুমায়ূনের সৃষ্টিসমূহ। কী এমন জাদু আছে তার রচনায়? এ সাহিত্যিক সম্পর্কে সবচেয়ে যুতসই বাক্য বোধহয় এটিই, তিনি মূলত আনন্দের ভাষা দিয়ে বেদনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার গল্পে বিচিত্র কাহিনি, নানারূপের মানুষ, জীবনবোধ, গভীর অনুভূতি উঠে এসেছে। একজন উল্লেখযোগ্য আধুনিক গল্পকারের লেখায় এমন সব বিষয়ের উপস্থিতি তিনি কতটা শক্তিমান তা প্রমাণ করে। তার গল্প বলার কৌশল অতি সাধারণ এবং রসালে, কিছুটা রহস্যময়ও কি নয়! আটপৌরে শব্দ, সরলরৈখিক বর্ণনার ফাঁদ পেতে তিনি মূলত পাঠককে গল্পে প্রবেশ করান। এরপর পাঠকের আর কিছুই করার থাকে না। অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরে সে কাহিনি। পাঠক তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কিংবা নিজে থেকেই বের হতে চায় না। হুমায়ূনের কল্পনা আর চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে এক অজানা বিন্দুতে পৌঁছে যায় পাঠকরা।
প্রত্যেক লেখকেরই কিছু সহজাত ব্যাপার থাকে, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। কারো গল্পে ঢুকতে কষ্ট হয়, তবে ঢুকে গেলে ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। তার বেশির ভাগ গল্প শুরু হয় খুবই আটপৌরে ঢঙে। কিন্তু খুব বেশি সময় তা আর আটপৌরে থাকে না। আমাদের একটু একটু করে টেনে নেয় জটিল, নিষ্ঠুর বা রহস্যময় কোনো জগতে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্যোতনায় কিংবা বেদনায় আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়, চোখ হয় বড় বড়। শেষে মনে হয় এটা বুঝি জাদুময় বাস্তব! কোনোমতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আবার অবিশ্বাসেরও কোনো উপায় নেই! এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে সম্ভাবনাময় স্বপ্নের যে জগৎ তৈরি হয় সেটাই মূলত ফ্যান্টাসি। ফ্যান্টাসি হুমায়ূনের নিজস্ব কুশলতার এলাকা। জীবনাচরণের ভাঁজে ভাঁজে পাঠককে প্রায় বুঝতে না দিয়ে ফ্যান্টাস্টিক উপাদানে ডুবিয়ে দেওয়া বা পুরো লেখাটিকে দৈনন্দিনতার ছলে ফ্যান্টাসি বানিয়ে ফেলা তার সহজাত ক্ষমতার অংশ। তবে আলাদা করে ফ্যান্টাসি বলা যায়, এমন রচনার সংখ্যাও তার প্রচুর। বলা যায়, ফ্যান্টাসিকেও হুমায়ূন নিজের ছাঁচে ফেলে ভেজেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ফ্যান্টাসি নির্মাণের কায়দাটা অভিনব। ঢাকঢোল না পিটিয়েই বিয়ের কাজ সারার মতো তিনি পাঠককে বুঝতে না দিয়েই আলাদা জগতে নিয়ে গেছেন। ফ্যান্টাসির মধ্যেই কখনো আবার দৈনন্দিন বাস্তবতার বিচিত্র আয়োজন। পাঠক ফ্যান্টাসি পছন্দ করে। কারণ তাদের মনের আনাচে-কানাচে বিদ্যমান ফ্যান্টাসিকে তারা লেখায় দেখতে চায়, লেখার সঙ্গে নিজের ফ্যান্টাসি মেলাতে চায় এবং ফ্যান্টাসির নতুন উপাদান খুঁজে পেয়ে তাতে বুঁদ হয়। হুমায়ূনের ফ্যান্টাসিগুলো জীবনঘেঁষা হওয়ায় সেগুলো গ্রহণ করতে কষ্ট হয় না। তিনি জীবনের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে তার অনুকূলে ফ্যান্টাসি রচনা করেছেন। সাহিত্যিক হিসেবে সেই রহস্যগাঁথার দিয়েছেন নতুন কাঠামো। তার মধ্যে হিউমার, উইট, স্যাটায়ার ঢুকিয়ে রসাল করেছেন। তাতে গল্প বৈচিত্র্য পেয়েছে। ফ্যান্টাসিগুলো আরো বেশি করে হুমায়ূনীয় হয়ে উঠেছে। শার্লক হোমসের লেখক আর্থার কেনান ডয়েল আনকোরা ছক নিয়ে এসে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তার অনুকরণে সত্যজিৎ রায় ফেলুদা বানিয়ে অমর হয়েছেন। হুমায়ূনও গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নতুন রূপকল্প নির্মাণে। তার অমরত্বের হয়তো এটাও একটা অনুষঙ্গ হবে।
হুমায়ূন আহমেদের ফ্যান্টাসির মধ্যে ‘নি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যান্টাসির ছলে এখানে আসলে প্রেম-ধারণার এক অতি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পরীক্ষা করেছেন লেখক। ‘নি’ উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ূন লিখেছেন, ‘নি’ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়, ফ্যান্টাসি ধরনের রচনা। এই সাবধানবাণী তাকে উচ্চারণ করতে হয়েছে, কারণ এ বইকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে পাঠ করার কিছুটা প্রণোদনা খোদ বইটির ভেতরেই আছে। বলা হয়েছে, ‘নি’ এক ধরনের মানব-প্রজাতি, যাদের ক্রমোজমের সংখ্যা বেশি। অন্যদের যেখানে ৪৬টি ক্রমোজম থাকে, সেখানে নি-গোত্রভুক্তদের থাকে ৪৭টি। এই বাড়তি ক্রমোজম তাদের অভাবনীয় ক্ষমতার উৎস। নিজেদের কল্পনার জগৎকে বাস্তব রূপ দেওয়ার অসাধারণ সামর্থ্য আছে তাদের এবং নতুন দুনিয়া সৃজনের ক্ষমতার দিক থেকে তারা স্রষ্টার পর্যায়ভুক্ত। স্পষ্টতই এ কল্পনার ভিত্তি বৈজ্ঞানিক বা কল্প-বৈজ্ঞানিক উপাত্ত। ফলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির সঙ্গে একে মিলিয়ে পাঠ করার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু লেখক একে পড়াতে চান ফ্যান্টাসি হিসেবে। তার মতে, ফ্যান্টাসি হিসেবেই রচনাটির অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ পাঠ সম্ভব। বাস্তবকে ছাড়িয়ে যাওয়াই উভয়ের নিয়তি, ফলে যতদূর যাওয়া যায় ততই ভালো। হুমায়ূনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলো প্রমাণ করে, কল্পনায় বহুদূর চলে যাওয়ার এবং নিয়ে যাওয়ার একটা সহজাত প্রতিভা তার ছিল। বিকল্প বা কল্পিত জগৎ নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন; কল্পনা করেছেন এমন সময় এবং জগৎ নিয়ে যা আমাদের চেনা দুনিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে না। শিশুদের কল্পনার জগৎকে কিংবা নানা ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কল্পদুনিয়ার অঙ্গীভূত করে নেওয়ার কুশলতা তার রচনায় ঢের পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিখ্যাত ফ্যান্টাসিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে রোমান্সের উপাদানের ছড়াছড়ি। চাইলে হুমায়ূনও সে পথে হাঁটতে পারতেন। কিন্তু তিনি প্রথাগত পথ অনুসরণ করেননি। যা করেছেন, তার প্রায় সবগুলোরই একটা হুমায়ূনীয় ঢং আছে। ফ্যান্টাসির মাত্রাকে কমিয়ে, বাস্তবের সীমানাকে খানিকটা বাড়িয়ে তিনি রচনা করেছেন এক ভিন্ন ধরনের ফ্যান্টাসি, যার মধ্যে ফ্যান্টাসির সীমানায় বাস্তবের উপাদানগুলোই ঘোরাফেরা করে।
‘পিঁপড়া’ গল্পে ডাক্তার নূরুল আফসারের কাছে আসা রোগী মোহাম্মদ মকবুল হোসেন ভূঁইয়ার এক অস্বাভাবিক রোগের বিবরণে আমরা বিস্মিত-ব্যথিত হই। একটা মানুষ যেখানেই যায় পিঁপড়া থেকে তার রেহাই নেই। পিঁপড়ারা এসে তাকে কামড়াতে শুরু করে। এ অবিশ্বাস্য গল্পটা ডাক্তারেরও বিশ্বাস হয় না। তার কাছে এ বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু দেখা যায় ব্যাপারটা ডাক্তারের সামনেই ঘটছে! লেখকের বর্ণনায়, ‘তিনি দেখলেন, টেবিলের ওপর রাখা মকবুলের ডান হাতের দিকে একসারি লাল পিঁপড়া এগোচ্ছে। পিঁপড়ারা সচরাচর এক লাইনে চলে, এরা তিনটি লাইন করে এগোচ্ছে।’ ঘটনা এরকমই। কিন্তু এ ঘটনার নেপথ্যে যে কাহিনি তা শুনে গা শিউরে ওঠে। মনে হয় কী ভয়ংকর! গল্প শেষে রেশ রয়ে যায়, কেবলই মনে হয় পিঁপড়ারা দল বেধে এই বুঝি হাতের ওপর চলতে আরম্ভ করবে। গল্পের পাশবিকতা সহজে মাথা থেকে নামে না। আমাদের চিন্তার জগৎটাকে এলোমেলো করে দেয়। ফ্যান্টাসি লেখকের সাফল্য বোধহয় এখানেই।
হুমায়ূন আহমেদের ফ্যান্টাসির বড় ঘুঁটি হিমু। হিমু কোনো অস্বাভাবিক চরিত্র না। অসংসারী মানুষের প্রতি সংসারী মানুষের স্মরণাতীতকাল থেকে যে আকর্ষণ, হিমুর জন্য আমরা তাই অনুভব করি। হিমুর প্রধান গুণ তার আসক্তিহীনতা। সামাজিক জীবনযাপনের সব লজিককে হিমু বিপর্যস্ত করে দেয়। মধ্যবিত্তের যাপনকে করে হাস্যকর। সংসারের মায়া এড়িয়ে, জাগতিক প্রয়োজন তুচ্ছ করে খালি পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে পৌঁছানো বোধ করি ব্যক্তি হুমায়ূনেরও স্বপ্ন ছিল। তিনি তা করতে না পারলেও হিমুকে দিয়ে করিয়েছেন। মহাপুরুষ হওয়ার যে বাসনা আমরা অজান্তেই লালন করি, হিমু তা ব্যাকরণের মতো করে চর্চা করে দেখায়। বাবার ডায়েরি তার গাইডলাইন। নিজের কিছুই নেই অথচ ভবিষ্যৎ দেখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা (হিমুর ভাষায় যেটা সব সময় কাজ করে না) আছে তার। হিমু অনেকের অপ্রিয় কিন্তু অচ্ছুৎ নয়। তার মায়া আছে আবার মায়া কাটার যন্ত্রও আছে। তবে হিমু জাগতিক ব্যাপারে নিরাসক্ত হলেও উদাসীন নয়। হিমু চরিত্রকে সমাজের ও রাষ্ট্রের নানা অনাচারের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে ভয়াবহ বাস্তবতার মূলে আলো ফেলেছেন। হিমু প্রতিবাদী না হয়েও খুলে দিয়েছে একের পর এক গোমর। গরিব ও নৈরাজ্যের এই জনপদে ইচ্ছেপূরণের ম্যাজিক হাতে হেঁটে বেড়ায় হিমু। আরেক চরিত্র মিসির আলিকে দিয়ে হুমায়ূন লজিকের দুনিয়া গড়েছেন। রহস্য, ডিটেকটিভ আর ফ্যান্টাসির এক আশ্চর্য জগৎ দেখতে পাওয়া যায় মিসির আলিতে। মূলত হুমায়ূন যা হতে চেয়েও পারেননি, তারই দুই প্রতিনিধি হিমু ও মিসির আলিকে দিয়ে তা করিয়েছেন। ফ্যান্টাসির উপাদানগুলোর কাছে ধরা না দিয়ে উল্টো সেগুলোকেই নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এ কারণেই তার ফ্যান্টাসিতে জীবনবোধ লঙ্ঘিত হয়নি। পাঠকের জন্য তার অধিকাংশ রচনাই আসলে ফ্যান্টাসির নিমন্ত্রণ। ফ্যান্টাসি পড়ছি জীবনের গদ্যে, যেখানে আবেগ আছে, হাসি-ঠাট্টা সবই আছে, এটা হুমায়ূন আহমেদের রচনা ছাড়া যেন কল্পনা করা যায় না। তার রচনায় ফ্যান্টাসি আর জীবন একাকার হয়ে গেছে। একটা স্বপ্নময় জগৎ কতটা মায়াময় ও জীবনপ্রধান হতে পারে তা অনুধাবনে হুমায়ূন আহমেদের ফ্যান্টাসির দ্বারস্থ হতেই হবে।