প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
সুযোগ সন্ধান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মনমরা হয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। রানা ভাই বললেন, ভাবিস না। এ বছর টিকতে না পারলে আগামী বছর আমার সিটে থেকেই পরীক্ষা দিতে পারবি। রানা ভাই কথাটা এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মনে হলো, তিনি এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় টিকেই যাবেন এবং হলে থাকার সিট পাবেন।
রানা ভাইয়ের ব্যাপারটা হলো, নিজের ওপর তীব্র আস্থা রাখা, উচ্চাভিলাষী কল্পনা করা এবং সেই আকাশকুসুম কল্পনাকে মানুষের সঙ্গে বলতে বলতে এক সময় বাস্তব মনে করা। শেষে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় আমি টিকে গেলাম। কিন্তু অতিআত্মবিশ্বাসী রানা ভাই টিকতে না পেরে মফস্বলের একটা কলেজে মার্কেটিংয়ে অনার্সে ভর্তি হলেন। ক'দিন পর তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, মার্কেটিংয়ে পড়ার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এলএলবিতে ভর্তি হবো। উকিল হয়ে একজন ডাক্তার বিয়ে করব। আমার গায়ে থাকবে আইনজীবীদের কালো কোট আর তোদের ভাবির গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন। সাদা-কালোর কম্বিনেশনে সত্যিকারের জীবন। আমি বললাম, বেশ ভালোই হবে। কিন্তু রানা ভাইয়ের এ স্বপ্নও সত্যি হলো না। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে টিউশন ফির দৌরাত্ম্যে তার এলএলবিতে ভর্তি হওয়া হয় না।
মার্কেটিংয়ে অনার্স শেষ করে রানা ভাই সরকারি চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। চেষ্টা করতে করতে এসআইর রিটেন পরীক্ষায় টিকে ভাইভা দেওয়ার আগেই একটা বাঁশের লাঠি কিনে ফেললেন। এসআই হওয়ার পর যে লাঠিটা তিনি সঙ্গে রাখবেন। যাকেই সামনে পান তাকেই বলতে লাগলেন, এসআই হয়ে অধীনস্ত পুলিশদের উল্টাপাল্টা শাস্তি দেব; কারণে-অকারণে খাটাব। বাসার বাজার করাব; রাস্তায় হাত উঁচিয়ে গাড়ি থামিয়ে টাকা তুলব; অপরাধীদের উল্টো ঝুলিয়ে পেটাব; কেস নিয়ে থানায়... ইত্যাদি। কিন্তু শেষে ভাইভাতে টিকতে পারেননি।
তারপর সরকারি চাকরির জন্য আরও অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছেন। সব ফেল। হঠাৎ তার জীবনে আরেকটি সুযোগ এলো। এক দালালকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরির ব্যবস্থা হবে। ১৫ লাখের বিনিময়ে চাকরি! তিনি বললেন, ব্যাপার না। একবার চাকরিটা হয়ে গেলে ফাইলপত্র আটকিয়ে, নতুন সংযোগ নিতে আসা লোকদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে, বিভিন্ন কোম্পানির অতিরিক্ত বিল মওকুফের ব্যবস্থা করে বকশিশ পেয়ে, সময়মতো বিল দেয় না যারা তাদের লাইন কেটে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে ভয়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা করে, ১৫ লাখ টাকা তুলে আনা ১৫ দিনের কাজ।
শেষ পর্যন্ত এ চাকরিটাও হলো না। রানা ভাই ভেঙে পড়লেন। তার সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স চলে যাচ্ছে।
কদিন আগে রানা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জানালেন, তিনি একটা চিকেন ফার্মের মালিক হয়েছেন। মানে দেশি মুরগির খামার দিয়েছেন। মুরগির খাবার দেওয়া থেকে বিষ্ঠা ফেলা, সব কাজ নিজেই করেন। কর্মচারী রাখলে নাকি তারা কাজে ফাঁকি দেয়। সবকিছুতে টাইট শিডিউল।
তিনি বললেন, দেখিস বাপ্পি, আমার ফার্মে লাভের মুখ দেখলেই আমি বেরিয়ে পড়ব বিশ্বভ্রমণে। তোরা তো জানিস, সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার আমার ভীষণ শখ। প্রথমে যাব কানাডার নায়াগ্রা ফল্স দেখতে। আহ্, কী মনোরম জলপ্রপাত! তারপর ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জে পাথরের ছড়াছড়ি দেখতে যাব। আইফেল টাওয়ারকে পেছনে রেখে সেলফি তুলে যাব ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের সামনে। উটের গলার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে আর পিরামিড দেখতে যাব মিসরে। তোদের জন্য উপহার হিসেবে এমন সব জিনিস নিয়ে আসব, যা তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। দামি পাথরের শোপিস, হাতির দাঁতের ছাইদানি, কুমিরের চামড়ার মানিব্যাগ, দুর্লভ পারফিউম।
আমি বললাম, আমার একটু তাড়া আছে ভাই, আপাতত যাই।