প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২২, ০০:০০
ডাক্তারের চেম্বার। নারী ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখছেন। মনিটরে একটা মানব শিশুর অস্পষ্ট আকৃতি নড়াচড়া করছে। ডাক্তার জানালেন অনাগত সন্তানটি মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের দিকে মুখ ফেরালো। দুজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি।
বাসায় ফেরার বেলায় রিকশাতে নিঝুমের মুখে রোদ লাগছিলো দেখে অর্ক হাতের ছায়া দিয়ে বউয়ের মুখ ঢাকলো। সাবধানে হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠার সময় কোলে তুলে নিতে চাইলো। নিঝুম বললো-পাগল।
নিঝুমের শাশুড়ি ডায়াবেটিসের রোগী। বিকেলে পার্কে হাঁটা শেষে ফেরার পথে হকারের কাছ থেকে শিশুদের দুটো ছড়ার বই কিনে নিয়ে আসলেন। নিঝুম তো অবাক! শাশুড়ির দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকাতেই শাশুড়ি বললো-ক’দিন পরে তো লাগবেই, তাই আগেভাগেই নিয়ে এলাম।
ঘরের দেয়ালে দুটো বাচ্চার ছবি ঝোলানো। নিঝুম সারাদিন মোবাইলে, ইউটিউবে বেবি কেয়ার লিখে সার্চ দিয়ে শিশু সেবার পদ্ধতি সম্পর্কে জানলো।
অফিস থেকে ফেরার সময় অর্ক দুই জোড়া জুতা নিয়ে ফিরলো। একই কালার, একই ডিজাইন, শুধু সাইজের পার্থক্য। বড় আর ছোট। বড়গুলো মায়ের জন্য, ছোটগুলো মেয়ের। সাথে একটা রাবারের খেলনা ডলফিন। ডলফিনটা নিয়ে দুজন দুজনকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করলো। অর্ক হঠাৎ নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো। কপালে চুমু খেলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো-আমাদের মেয়ের নাম রাখবো অর্ণি। অর্কের ‘অর’ নিঝুমের ‘নি’।
এমন সময় নিঝুম কুকড়ে উঠলো। ইশারায় বোঝালো পেটের ভেতর বাচ্চাটা নড়েচড়ে উঠেছে। অর্ক পেটে কান পাতলো, মুচকি হাসি দিলো। তারপর চুমু খেলো, যেনো মেয়েকেই চুমু খাচ্ছে।
সময় ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ গোসলখানার মেঝেতে পা পিছলে পড়ে গেলো নিঝুম। বাইরে থেকে একটা তীব্র চিৎকার শোনা গেলো-মাগো... তারপর অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন, লালবাত্তিটার ঘোরাঘুরি। স্ট্রেচারে চড়িয়ে সোজা অপারেশন থিয়েটারে। থমথমে পরিবেশে অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে অর্ক হন্তদন্তের মতো এখানে-সেখানে ফোন করছে-রক্ত চাই, রক্ত। ও নেগেটিভ।
ডাক্তার টাওয়েলে মুড়িয়ে নবজাতককে কোলে নিয়ে দরজা খুললো-চাঁদের মতো মেয়ে হয়েছে। তবে মা...
কি হয়েছে ডাক্তার? নিঝুম কি মারা গেছে?
ডাক্তারের মাথায় দুষ্ট চক্র ভর করলো-না, এখনো মরেনি। তবে জীবন সংকটাপন্ন।
আসলে নিঝুম মরে গেছে। ডাক্তার নিজের হাতেই নিঝুমের মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে এসেছেন। ডাক্তার চাইছেন কিছু টেস্ট করার ছুতোয় টাকা হাতিয়ে নিতে। প্রাইভেট হাসপাতাল। একটা দিনের সিট ভাড়া মানেও অনেক টাকা। অপারেশন থিয়েটারে থাকা অন্য একজন জুনিয়র ডাক্তার বিষয়টা বলে দিতে চেয়েছিলো। তিনি তাকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। তারপর আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন-খুব সৎ সাজার ভাব নাও দেখছি! হাসপাতালের লাভ না দেখাতে পারলে চাকরি থাকবে তোমার?
পরদিন সকালে শিশুটি মারা গেলো, যার নাম রাখার কথা ছিলো অর্ণি। দুপুরে ডাক্তার জানালেন নিঝুমও মারা গেছে। মোটা অংকের বিল চুকিয়ে বউ আর মেয়ের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বসলো অর্ক। সাদা কাপড়ে মোড়ানো কোলবালিশের মতো পাশাপাশি দুটি মরদেহ। একটি ছোট, একটি বড়। একে একে অতীতের স্মৃতি তার মনে পড়তে থাকলো। ডাক্তারের কাছে প্রথম দিন আসা, দুই-জোড়া জুতো কিনে বাসায় ফেরা, বউয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলা-আমাদের মেয়ের নাম রাখবো অর্ণি।
* পাঠক ফোরামে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]