প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২২, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
রাত প্রায় ১০টা। শুভকে ওসি রুমেই বসিয়ে রেখেছে। নিপু একবারের জন্যেও থানায় আসেনি। সে বাড়িতেই ঝিম ধরে বসে থাকে। সবাই ভাবছে নিপুর সাথে মেয়েটি অনেক কথা বলতো দুষ্টুমি করতো। তাই হয়তো তার মনে কষ্ট হচ্ছে বেশি।
তখন রাত ১২টা। থানা অনেকটাই ফাঁকা। নিরিবিলি। থানার সামনে মাঠের এক কোনো ভ্যান গাড়ির উপর রাখা নুপুরের মৃতদেহ। একজন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। এবার রুমের দরজা বন্ধ করে ওসি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। শুভ বিষন্ন মনে বসে আছে। নুপুরের মৃত্যুতে শুভই বেশি আঘাত পেয়েছে হয়তো। নুপুরের বাবা-মা নির্দ্বিধায় আরো বেশি। কারণ সন্তান হারানোর শোকের চেয়ে পৃথিবীতে আর কোনো বড় শোক নেই। যদিও কেউ কেউ টাকা হারানোকে সন্তান হারানো শোকের সাথে তুলনা করে। সন্তান আর সম্পদ দুটি বিষয়কেই মানুষ একই পাল্লায় মাপে। পুলিশ আর মামলা ঝামেলা এড়াতে সন্তান হারানো শোক অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে নুপুরের বাবা মায়ের।
ওসি একটা সিগারেট মাথায় আগুন ধরায়। অনেকে স্টাইল করে সিগারেট খায়। যদিও ধূমপান কারো কারো নেশা। এসট্রেতে সিগারেটের ছাইয়ের প্রথম অংশ ফেলে শুভর দিকে তাকায়। শুভ একবুক বিষণœতা নিয়ে নিরব হয়ে বসে থাকে।
- আচ্ছা, তুমি শুভতো?
- হুম। আমার নাম শুভ।
- তোমার বাবা কী করে?
- বিদেশে থাকেন।
- কোন্ দেশে?
- ওমান।
- কয় ভাই, কয় বোন?
- দুই ভাই, তিন বোন। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ে।
- আচ্ছা, সবাই নুপুরের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তুমি চাও না কেনো?
স্যার, আমার কাছে এটিকে হত্যাকাণ্ড মনে হয়েছে। নুপুর এতো রাতে আখড়ায় যাবে তা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যদি যায়ও কেউ না কেউ তাকে নিয়ে গেছে। কারো না কারো সাথে সে সেখানে গেছে। অথবা তাকে হত্যা করে সেখানে লাশ ফেলে রেখেছে।
- তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তুমি বিষয়টি নিয়ে এতো ইন্টারস্টেড কেনো? তোমার আবেগ এতো উথলে পড়ছে কেনো?
- ভালোবাসি স্যার। আমি নুপুরকে অনেক ভালোবাসি। আমি ওকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস করুন স্যার তার না থাকা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
- আচ্ছা, নুপুর তো এখানে বেড়াতে এসেছে। তোমার সাথে পরিচয় হলো কিভাবে?
- নুপুর হচ্ছে আমার বন্ধু নিপুর বোনের ননদ। নিপু আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমি প্রথমেই দেখাতেই তাকে পছন্দ করি। এবং তা জানাই। নুপুর আমাকেও পছন্দ করতো। সম্পর্কের কথা বললে ভেবে জানাবে বলে সময় নেয়। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আমি প্রতিদিনই নিপুদের বাড়ি যাই। অবশ্য নুপুর আসার আগে থেকেই। হয়তো নুপুর আসার পর থেকে ওই বাড়িতে একটু বেশি আসা-যাওয়া করি। শুধু দুপুরে এসে বাড়িতে ভাত খেতাম আর গোসল করতাম। আর বাকি সবটুকু সময়ই আমি ওই বাড়িতে দিতাম।
শুভ হঠাৎ আনমনা হয়। সেদিন নিপুদের ঘরে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো। নিপু, শোলকা, অলকা আর শুভ। শুধু তাই নয়, নিপুর মাও আড্ডাস্থলে উপস্থিত ছিলো। সবাই যখন নানা কথায় ব্যস্ত তখন নুপুর শুধু ঘরের দক্ষিণের জানালার উপর দিকে তাকাচ্ছে। বারবার ওদিকে তাকানোর কারণে শুভ বিষয়টি লক্ষ্য করে। কিন্তু শুভ জানালার দিকে না তাকিয়ে নুপুরের দিকে তাকায়। কিন্তু নুপুর ঘরের দক্ষিণের জানালর উপরেই তাকিয়ে আছে। শুভ তখনো বিষয়টি আঁচ করতে পারলো না। তখন ওদিকে তাকাতে শুভকে ইশারা করে। শুভ জানালার উপরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত। ওখানে একটা আয়না ঝুলছে। ঝুলন্ত আয়না আলোকিত করে রেখেছে নুপুরের মায়াময় মুখ। নুপুরের স্থান থেকে শুভকেও দেখা যাচ্ছে। অন্য সবাই যখন নানা কথায় ব্যস্ত তখন শুভ ও নুপুর আয়নার ভেতর কথা বলায় বিভোর। অবশ্য সেকথায় শুধুই চোখের। এর ফাঁকে দুজনে জীবনের কতো গল্প বলা হয়ে যায়। আয়নার ভেতর চক্ষু মিলন। দুজনের মনের মিলন হলেও দুজনের মাঝে কিছু একটা দেয়াল হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় যতোটা কাছের মনে হয় ততোটাই দূরের যেনো।
ওসি বুঝতে পারে শুভ ভিন্ন জগতে আছে।
একটু আওয়াজ বড় করে ওসি বলেন, তোমার সাথে নুপুরের সর্বশেষ কথা হয়েছে কখন?
ধ্যান ভাঙার পর একটু সময় নিয়ে শুভ বলে, ঘটনার আগের দিন দুপুরে।
- কী কথা হয়েছে?
- বলেছি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। সে আমাকে একটা ছোট্ট কাগজ হাতে দেয়। কাগজে কিছু লিখা ছিলো না। মানিব্যাগ থেকে কাগজটি বের করে শুভ। এই যে দেখুন স্যার, এই দেখুন।
- কিন্তু এটাতো সাদা কাগজ।
- জ্বি স্যার। ও শুধু বলেছিলো কাল যা বলবো তা লিখে রাখবে নিজের হাতে। আমি বিশ্বাস করি, সে ‘ভালোবাসি’ বলতো। আমার বাবা-মা-ভাই-বোন সব থেকেও কেনো যেনো নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আর ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দেয় শুভ। ওসি এবার ভাবনায় পড়ে যায়। কেনো যেনো শুভকেই তার সন্দেহ হয়। শুভ এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আছে। এ মামলায় তাকে আটক দেখাবো? ভাবে ওসি।
ওদিকে খবর পেয়ে ছুটে আসে শুভর মা ও ছোট ভাই। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে শুভর দুই বোন বোনের জামাইও চলে এসেছে। কেনো পুলিশ শুভকে আটক করে রেখেছে? গ্রামের মানুষ এবার ভাবতে শুরু করেছে পুলিশ যেহেতু শুভকে সন্দেহ করছে সেহেতু কিছু না কিছু আছে এ ঘটনায়। তা নিশ্চয় পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পারবে।
থানার ভেতর হাজির শুভর আত্মীয়-স্বজন। শুভ মাথা নিচু করে বসে আছে। সবাই রিকুয়েস্ট করে ওসিকে। শুভকে যেনো ছেড়ে দেয়। একপর্যায়ে শুভকে ছেড়েও দেয় পুলিশ। তবে আবার ডাকলে যেনো থানায় এসে কথা বলে যায় এমন শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তে রাজি হয়েই শুভকে নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে সবাই। এবার শুভর মা-ভাই ও দুলাভাইরা জানতে চায় আসর রহস্য কী? শুভর কাছ থেকেই জানতে চায় সবাই। শুভর মা রাহেলা বেগম বলে, তোকে পুলিশ এতো সময় কেনো থানায় বসিয়ে রেখেছে?
- আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, মেয়েটি এমনি এমনি মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি শুধু বলতে চেয়েছি পোস্টমর্টেম ছাড়া যেনো লাশ হস্তান্তর না করে। এটুকু দাবিতো যে কেউ করতেই পারে। তাছাড়া পুলিশের উচিৎ কোনো ঘটনার সন্দেহাতীতভাবে সমাধান করা। অবশ্য ওসি পরে আর কোনো রহস্য থাকতে পারে কি না জানতে চেয়েছে। আমি যতদূর জানি তা বলেছি।
- একটা হিন্দু মেয়ের জন্যে এতো নাক গলানোর কি দরকার? তাছাড়া সেতো আমাদের কোনো আত্মীয় না। তাহলে তোর আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিলো?
শুভ নীরব। কিছু বলে না। অনেক চাপাচাপির পর শুভ বলে, ভালোবাসি। আমি নুপুরকে ভালোবাসি। সে আমার আত্মার পরম আত্মীয়।
শুভদের ঘরোয়া বৈঠকে এখন কথা হচ্ছে। সবাই শুধু নিপুকে বিবিধ প্রশ্নে জর্জরিত করছে।
শুভর বড় দুলাভাই বলে, যে মেয়ে মারা গেছে তাকে ভালোবাসো এ কথা বলার দরকার কী? অযথা কেন পুলিশি ঝামেলা নিচ্ছো। কেন পরিবারকে হয়রানির মধ্যে ফেলছো। তাছাড়া এখন কোনো ঘটনা ঘটার পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরেও মানুষ অস্বীকার করে। আর তুমি মিয়া বিশ্বপ্রেমিক হয়ে গেছো। থানায় গিয়ে ওসিকে বলো মরা লাশকে তুমি ভালোবাসো। ঠিক আছে। যতোটা সম্ভব পুলিশকে এড়িয়ে চলো। এখন ফ্রেস হও। রাত প্রায় তিনটা। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সবাই সবার মতো করে ঘুমিয়ে যায়। শুভর ঘুম আসে না। বুকের ভেতর বিষাদের সুর বেজে ওঠে। তুমুলভাবে বাজতে থাকে। নিরবে প্রভাত নামে। আরেকটা বিষণœ সকাল হানা দেয় শুভর জীবনজুড়ে। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]