প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২২, ০০:০০
সগীর আলী বসে আছে চেয়ারে। বয়স আনুমানিক সত্তর। গায়ে একটা সাদা গোলগলা গেঞ্জি। পাশে বসা রুস্তম সাহেব। অনেক দিন পর দেখা দুজনের। সম্পর্কে দুজন বন্ধু। তাদের এ সম্পর্ক প্রায় ছয় দশকের। রুস্তম ঢাকায় থাকে। কিছুটা অবস্থাপন্ন রুস্তম। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি করেছে অনেক আগেই। এলাকায় খুব একটা আসা হয় না তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকুরি করতো রুস্তম। তার পোস্টিং ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে শুরু হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। হাহাকার করতে থাকে রুস্তমের মন। দেশে নেই সে। পরিবার-পরিজন সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ। দেশের সবাই কেমন আছে তা জানারও সুযোগ নেই। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের কোনো খবর সেখানে যায় না। তিনমাস আগে জন্মগ্রহণ করেছে ছেলে আনান। কিন্তু দেশে আসার সুযোগ হয়নি। ছেলে আনানের একটি ছবি বাড়ি থেকে পাঠানো হয় রুস্তমের কাছে। দেখতে কী সুন্দর হয়েছে। ঠিক বাবার মতো। যেনো একবারে রাজপুত্তর। যুদ্ধের ভয়াবহতায় সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু রুস্তমের মন পড়ে আছে দেশে। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আসতেও দিচ্ছে না রুস্তমকে। রুস্তমের সাথে বন্দি আরও ২৩ জন বাঙালি আর্মি অফিসার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাদের আটক করে রেখেছে। কারণ পাকিস্তানিরা ভাবছে বাঙালি অফিসারদের দেশে আসতে দিলে তারা দেশে এসে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করবে এই আশঙ্কায়। বন্দিদশা থেকে অনেক কষ্টে, কৌশল করে পালিয়ে আসে রুস্তমসহ অন্য তিনজন।
কাশ্মির হয়ে বাংলাদেশের পথে পায়ে হেঁটে রওনা দেয় রুস্তম। পথে আটকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। প্রথমে ভারতীয় বাহিনী মনে করেছিলো রুস্তম পাকিস্তানের কোনো সেনা অফিসার কিংবা গোয়েন্দা। সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের অফিসে ধরে নিয়ে যায় রুস্তমকে। চলে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ, টর্চার। নানা কায়দায় টর্চার করার পরও রুস্তম থেকে কিছু বের করতে পারে না তারা। পরে রুস্তমকে ছেড়ে দেয় তারা। সেখান থেকে ফিরে রুস্তম অংশগ্রহণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে। একটি অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পায় রুস্তম। অনেকগুলো অপারেশন পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন তিনি। অনেকগুলো সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে রুস্তম। নাস্তানাবুদ করে দেয় পাকিস্তানি দোসর আর তাদের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে, পাক হানাদার আর লুটতরাজদের, হিং¯্র-বর্বর পাকিস্তানি পশুগুলোকে। অসমান্তরাল যুদ্ধ সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা। চারদিকে মুক্তিকামীদের মুক্তির খোঁজ। মুক্তির মিছিল। দ্রোহ আর অবিরাম সংগ্রাম। এ সংগ্রাম স্বাধীন সার্বভৌম লাল-সবুজের বাংলাদেশের জন্যে, লাল-সবুজ পতাকার জন্যে।
দুই.
সগীর আলী আর রুস্তম, দুই বন্ধু বসে আছে সামনাসামনি। অনেক দিন পর দেখা দুজনের। কিন্তু কিছু বলতে ভালো লাগছে না সগীর আলীর। সগীর আলীর যে মন ভালো নেই। বয়সের ভারে দিন দিন ন্যূজ্ব হচ্ছে সে। হাঁপানির শ্বাস টান উঠে কিছুক্ষণ পর পর। যৌবনে চেহারায় যে আলো ঠিকরে পড়েছিলো, যে লাবণ্য ছিলো তা এখন ম্লান হওয়ার পথে। কখনো দেখা হলে রুস্তম আর সগীর আলী কথা বলে দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তবে তাদের মধ্যে একাত্তরের কথাই বেশি হয় ঘুরে ফিরে। এবার দুজনের দেখা প্রায় বছর পাঁচেক পর। মুক্তিযুদ্ধ শেষে রুস্তম আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। চাকুরি শেষে এখন ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন তিনি। তাই রুস্তমকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয় সবসময়। তার বয়সও এখন প্রায় সাত দশক পার হয়েছে। কাগজে কলমে ৭২ ছুঁইছুঁই। প্রকৃত বয়স বেশি বৈ কম নয়। মা বলতো তাকে নাকি একটু বেশি বয়সেই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলো। কিন্তু এখনো সাবলীলভাবে চলাফেরা করেন তিনি। শক্তি-সামর্থ্যও ভালোই। এখনো নাদুস-নুদুস চেহারা। রুস্তমের চেহারায়, সগীর আলীর মতো বয়সের ছাপ নেই। কারণ জীবনের পুরো সময় নিয়ন্ত্রিত জীবনের মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া রুস্তম প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ। সব সময় যেনো মুখে হাসি লেগেই থাকে। রুস্তম সাহেবকে প্রাণচঞ্চল দেখালেও সগীরের মন খুব একটা ভালো নেই।
রুস্তম ধরতে পারে সগীরের কিছু একটা হয়েছে। সগীরকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেনো জানি, যা কিছুটা বেমানান ঠেকে রুস্তমের কাছে। রুস্তম এর আগে এরকম অবস্থায় কখনো দেখেনি সগীর আলীকে। সগীর কী হয়েছে বলো তো?
কিছু হয়নি। আজ-কাল ভালো লাগে না কিছু। যেনো দম বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার দেখি চারদিকে। যেনো মরতে পারলেই বাঁচি। দুমুঠো মাটিতে ঠিকঠাক কবরটা হলেই হয়। এদেশে আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কি জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি! আক্ষেপের সুরে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে যায় সগীর আলী।
কেনো, কী হয়েছে। এমন ধরনের কথা কেনো? ডাক্তার দেখাস নাই?
ডাক্তার দেখিয়ে লাভ কী বল। মনের অসুখ তো আর সারে না কখনো। বরং ছাড়ার পরিবর্তে বাড়ে। এর পরও রুস্তম আবার কারণ জিজ্ঞাসে করে। এবার কান্না ছলছল কণ্ঠে এক নিশ্বাসে বলতে শুরু করে সগীর আলী।
তিন.
আমাদের রক্তের পুকুরটা নেইরে বন্ধু। ভরাট হয়ে গেছে। রক্ত আজ মুছে গেছে। আমাদের রক্তের মূল্য এখন আর কেউ দেয় না। একটানা বলে যায় সগীর আলী। একথা শুনে রুস্তুমের বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠে। কী বলছে সগীর! এই পুকুরও তো আমাদের ইতিহাস। কে করেছে এই কাজ?
সগীর বলতে থাকে, পাশের সাহেবরা বেদখল করে পুকুরটি ভরাট করে ফেলেছে। এদের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। কেউ কিছু বলে না এদের। কেউ কিছু বললেই তার উপর চলে দমন, পীড়ন আর নানা রকম অত্যাচার। ভয়-ভীতি আর জীবননাশের হুমকি। তারা যেভাবে চায় সেভাবেই এই এলাকার আইন-আদালত পরিচালিত হয়। বলা চলে এদের কথায় উঠে বসে আইন আদলতের সাথে জড়িত সবাই। তাদের সাথে লিয়াজোঁ করেই চলে বেশির ভাগ স্বার্থান্বেষী মহল। আর এরাই এদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তির ইতিহাসকে বিকিয়ে দিতে চায়। মুছে দিতে চায় সব সত্যি আর আমাদের রক্তের ইতিহাসকে, আমাদের স্বাধীনতার গর্বকে।
বলতে বলতে চোখে জল এসে যায় সগীর আলীর। বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুছে নেয় সগীর আলী। রুস্তম শুনে যাচ্ছে সগীরের কথা। তার চোখও যেনো ছলছল করছে। এই পুকুর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। অস্তিত্বের ইতিহাস। যেখানে মিশে আছে মুক্তিকামীদের লোহিত কণিকা। যে কণিকা মিশেছে কৃষ্ণচূড়া আর রক্তজবায়।
কথা বলতে বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৭১ সালের সেদিনের এই পুকুরের কথা। আজকের মতো পরিবেশ এতো সুন্দর আর শান্ত ছিলো না সেদিন। চারদিকে ছিলো থমথমে অবস্থা। সেদিন এই এলাকা মোটামুটি গ্রাম ছিলো বলা যায়। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে দেশের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। গ্রাম এখন পুরোদস্তুর শহর। তাই নতুন প্রজন্ম খুব একটা জানে না এই পুকুরের প্রকৃত ইতিহাস। কী বিভৎস অবস্থা ছিলো সেদিন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন রক্ষা পায় সগীর আলী। সেদিন প্রাণে বেঁচে ফিরে সগীর আলী। সাক্ষাৎ কোনো ফেরেশতা হয়তো সেদিন নিজ হাতে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো তাকে। এখনো সেদিনের কথা মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয় সগীরের। সাথে এলাকা বাসীরও। এখনো সগীরের চোখে ভাসে লাশ আর লাশ। পাক সেনারা এদেশের দেশীয় দোসরদের সাহায্য গলা কাটে সগীরদের গ্রামের প্রায় ৫৪ জনের। এর মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছয়জন ছিলো। হঠাৎ করে সেদিন চারটি আর্মি ট্রাক প্রবেশ করে গ্রামে। সাথে ৩০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা। সাথে কয়েকজন রাজাকার, যারা পাকসেনাদের এখানে নিয়ে এসেছে। এ গ্রামের কয়েকজন মুক্তি বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। এ খবর পেয়ে পাকসেনারা এ গ্রামে আসে। এ জন্য সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই ট্রাকে তুলে নেয়। নিয়ে গ্রামের শুরুতে যে পুকুর ছিল সেখানে ট্রাক থেকে নামায় সবাইকে। পুকুরের কাছে নামিয়ে হাত-পা, চোখ বেঁধে কয়েকজনকে ব্রাশ ফায়ার করে মারে। বাকি সবাইকে জবাই করতে শুরু করে। একজন একজন করে শুইয়ে দিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে একে একে জবাই করে সবাইকে। জবাই করে পুকুরে ফেলে দিচ্ছিল লাশ। চারদিকে যেন লাশের স্তুপ। পুকুরের পানি রক্তে লাল হচ্ছিল। পঁচিশজনকে জবাইয়ের পর সিরিয়াল আসে সগীর আলীর। সগীরের হাত পা, চোখ বাধা ছাড়াই গলায় ছুরি চালায়। ধারালো ছুরি! ছুরি চালানো মাত্রই গলার একদিক কেটে যায় সগীর। পিনিক দিয়ে রক্ত ছুটে তীব্র গতিতে। এমন অবস্থায় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সগীর আলী। এই অজ্ঞান অবস্থায় খান সেনাদের একজন লাথি দিয়ে সগীর আলীকে ফেলে দেয় পুকুরে। সন্ধ্যা গড়িয়ে আবার প্রায় সকাল হয়ে এসেছে। সারারাত এখানেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল সগীর আলী। সাথে লাশের স্তুপ। এখন চারদিক থেকে কানে পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। আস্তে আস্তে চোখ খোলে সগীর আলী। আবছা আবছা আলো ফুটতে শুরু করেছে সবেমাত্র। পুব আকাশে রক্তের মতো রক্তিম সূর্যটা যেন উঁকি দিচ্ছে। চোখ খুলেই সগীর আলী দেখতে পায় শুধু লাশ আর লাশ। সাথে তার দুই ভাই, বাবা আর বন্ধু মুক্তিবাহিনীর সদস্য জহিরের লাশও রয়েছে। রক্তের দাগ লেগে রয়েছে পুকুরের পাড়ের উপর থেকে নিচ অবধি। পুকুরের পানি রক্তাক্ত। যেনো রক্তের এক সাগর হয়ে আছে। হাত পা অসার হয়ে আসছে সগীর আলীর। কয়েকটি লাশ পড়ে আছে তার নিচে আর উপরে। তবু এখান থেকে দ্রুত সরতে হবে তাকে। এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে। যদি আবার কেউ দেখে ফেলে তাহলে বিপদ! যদিও গ্রামে এ বিপদের সময়ে এ অবস্থায় কেউ নেই। যারা ছিলো তারা পালিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাকিদের মেরে ফেলেছে পাকসেনারা। গলায় তীব্র ব্যথা হচ্ছে সগীরের। অসহ্য এ ব্যথা। সাথে বাবা, ভাই, আত্নীয় স্বজন হারানোর শোক। গলার এক তৃতীয়াংশ কেটে গেছে। রক্ত কিছুটা আঠালো হয়ে গলা থেকে পেট পর্যন্ত লেগে আছে। গলায় অস্বস্তি হচ্ছে তার। গলায় অনেকগুলো কালো কালো বড় পিঁপড়া। কিছু পিঁপড়া গলার ভিতরেও ডুকে পড়েছে মনে হচ্ছে। পিঁপড়াগুলো কামড়াচ্ছে সমানে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সগীর আলীর। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁদতেও পারছে না সে। সগীর কী করবে বুঝতেছে না। কিন্তু এটা জানে এখানে এ অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কিছু সময়ের মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে পুরোদমে। আলো ফুটতে শুরু করেছে চারদিকে।
যাই হোক এখান থেকে পালাতে হবে শীঘ্রই। সগীর আলী কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায়। পাশের জলাশয় পার হতে হবে তাকে। বর্ষাকাল এখন, বুক সমান পানি জলাশয়ে। জলাশয় পার হতে ঘণ্টাঘানেক সময় লেগে যায় সগীরের। কোনো মতে পৌঁছে জলাশয়ের অপর পাশের গ্রামে। কোনো রকম একটা বাড়ির উঠোন পর্যন্ত হেঁটে যায় সে। বাড়ির উঠোনে পৌঁছেই কাউকে কিছু বলার আগেই আবার অজ্ঞান হয়ে যায় সগীর আলী। ঐ বাড়ির কয়েকজন মহিলা ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যায় তাকে। এ গ্রামেও কোনো পুরুষ নেই। বলা চলে পুরুষশূন্য গ্রাম। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আবার অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিয়েছে। কারণ পাকসেনারা ধরে ধরে পুরষদের হত্যা করছে। সগীর আলীকে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে মহিলারা সুইসুতা দিয়ে গলা কোনো রকম সেলাই করে। কারণ এ অবস্থায় তাকে বেশিক্ষণ রাখা যাবে না, দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। কিন্তু আশপাশে কোনো ডাক্তার কিংবা হাসপাতালও নেই। মহিলারা রক্ত আর গলায় থাকা পিঁপড়াগুলো পরিষ্কার করে দেয়। ধরাধরি করে নৌকায় তুলে দেয় সগীর আলীকে। লক্ষ্য, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। নৌকায় করে সীমান্তের পাশে থাকা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় সগীর আলীকে। আড়াই ঘণ্টা পর নৌকা ভিড়ে হাসপাতালে। হাসপাতালটি ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। কিন্তু এখন এই হাসপাতাল মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালে আনার পর সগীর আলীকে ভালো মানের মেডিসিন, ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়। প্রায় বাইশ দিন হাসপাতালে থাকার পর রিলিজ পায় সগীর। পরে ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অংশগ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ চলতে থাকে। বাঙালিরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে। বাঁচাতে হবে স্বদেশ, দেশ-মাতৃকা। তখন ছিল নভেম্বর মাস। পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ আর তান্ডব ক্রমেই বেড়ে চলছে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই মেরে ফেলছে। চলতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে মানুষ হত্যা। সম্ভ্রমহানি করে আমাদের মা-বোনদের। চারদিকে লাশের সারি।
সগীর আলীরা যুদ্ধ চালাতে থাকে। এভাবে চলে আসে ডিসেম্বর মাস। দুই একজায়গা থেকে বিজয়ের বার্তা আসতে থাকে। ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ স্বাধীন হয় দেশ। বাংলার মুক্তভূমিতে উড়ে লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত পতাকা। বিজয়ের বেশে এলাকায় ফিরে আসে সগীর আলী। কিন্তু পরিবার, আত্মীয়স্বজন কোনো কেউ বেঁচে নেই তার। সব আত্নীয় স্বজনকে মেরে ফেলেছে পাক হানাদার বাহিনী। পাশের গ্রামের অনেককেও চোখ বেঁধে নিয়ে আসে ঐ পুকুরে। এখানে এনে ব্রাশ ফায়ার করে অনেককে মেরে ফেলেছে। প্রায় শখানেক মর্মান্তিক মৃত্যুর স্বাক্ষী ছিল এ পুকুর।
চার.
অথচ আজ এই পুকুরের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ক্ষমতার দম্ভে আমাদের রক্তের ইতিহাস মুছতে শুরু করেছে। বলা যায় মুছে ফেলা হচ্ছে ইচ্ছে করে। ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বেদখল হচ্ছে সব। তাই তো রক্তে রঞ্জিত পুকুরটিও আজ নেই। মুছে দেওয়া হচ্ছে আমাদের ইতিহাস। অথচ কেউ কিছু বলছে না। সগীর আলীর চোখে জল। কাউকে কিছু বলার নেই। বলে কোনো ফলও হবে না হয়তো। রুস্তমের চেহারায়ও কালো মেঘ ভর করেছে।
জিজ্ঞেস করে, কার এতো বড় সাহস যে আমাদের ইতিহাসকে অবরুদ্ধ করছে। নস্যাৎ করে দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে। আমাদের সকল স্বপ্নকে, মুক্তির ইতিহাসকে। রুস্তম আর বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। দুচোখ লাল হয়ে গেছে রুস্তমের। যেন চোখ দিয়ে রাগ আর ঘৃণা ঝরছে। আর সারা শরীরে ঘাম।
চল সগীর। কই যাবি? চল, বলছি। এটার একটা বিহিত করা দরকার। এই দেশ আর দেশের ইতিহাসকে আমাদেরকেই বাঁচাতে হবে।
এ বলে সগীরের হাত ধরে টেনে রুস্তম তার গাড়িতে সগীরকে তুলে নেয়। গাড়ি স্টার্ট নেয়। ঘাম ঝরছে দুজনেরই। রক্তের পুকুরের ইতিহাস যে রক্ষা করতেই হবে।