প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সফরের পর নির্দিষ্ট গন্তব্যে উপনীত হলো তরুণ। গন্তব্যস্থল ছিলো হোটেল ‘রয়েল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট এন্ড স্পা’। কিন্তু মাঝ রাস্তায় বন্ধুর অনুরোধে গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করে হোটেলের পরিবর্তে তার নিজস্ব বাংলো বাড়ির দিকে মোড় নিতে হলো তাকে।
আজ থেকে প্রায় বছরচারেক আগে এই বাংলোয় এক রাত্রির জন্যে অবস্থান করেছিলো সে। সেই এক রাত ছিলো চার চব্বিশ বছরের জীবনের সবচাইতে ভয়ানক এক কাল রাত্রি। সেই রাতের কথা এখনো মনে পরলে গা হিম হয়ে আসে তার। চার বছর পর আবার এই বাংলোয় অবস্থান করতে হবে ভেবে ভয়, আতঙ্ক, দ্বিধা, আশঙ্কা কাজ করতে শুরু করলো। বাংলোর নাম ‘বন্দি বিহঙ্গ’। দেড়ঘণ্টা পর বাংলোর সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বন্ধুর নাম্বারে কল করে নাম্বার বন্ধ পেল। একে তো এতো ঘণ্টার সফর তার উপর সেই বাংলো বাড়ি আবার মোবাইল বন্ধ! মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল তরুণের। বারকয়েক চেষ্টা করার পরেও যখন মোবাইল বন্ধ পেল তখন হুট করেই খুব জোরে এক লাত্থি দিলো লোহার গেইটটিতে। সুনশান এলাকায় লাত্থির শব্দটি বিকট আওয়াজ রূপে ধরা দিলো। চারদিক ভয়ানক শব্দে কেঁপে উঠলো মনে হলো। আশপাশ থেকে অচেনা সব প্রাণিরা হঠাৎ এমন শব্দের আতঙ্কে অস্বাভাবিক চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলো। এমন সব হুঙ্কারে ভয় পেয়ে গেলো তরুণ। বন্ধুকে মোবাইলে এবার চেষ্টা করতেই পেয়ে গেলো লাইনে। শুরুতেই রাগে, ভয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেও পরে যা শুনলো তা শুনে থমকে যেতে বাধ্য হলো সে। মেঝেতে পা হড়কে পড়ে গিয়ে পা মোচড়ে গিয়েছে বন্ধুর বউয়ের। তাকে নিয়েই হাসপাতালে সে। অন্তর্জালে ব্যাঘাত ঘটায় মোবাইল বন্ধ পেয়েছে বললো। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে কথা শেষ করলো সে। মিনিট দুয়েক পরেই তার বন্ধু চলে এলো। গাড়ি থেকে নেমেই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো। প্রাণের বন্ধু তারা একজন আরেকজনের। চার বছর আগের সেই ঘটনার পর থেকে আজকের আগে আর দেখা হয়নি তাদের। ছোটোবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়ার দরুণ তাদের বন্ধুত্বটা বাকি আট দশটা বন্ধুত্বের থেকে অনেক বেশি গাঢ়। আবেগে বন্ধুর চোখ থেকে সন্তর্পণে এক ফোটা জল গড়িয়ে তরুণের শার্টে এসে ঠেকলো। আলতো করে বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে একসাথে ফটক পার করে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো তারা। পুরো বাংলো লাল ইটের রংয়ের। শুরুতেই আছে বিশাল বড় এক বৈঠকখানা। একপাশে রান্না ঘর, আরেকপাশে কাজের লোকদের থাকার ঘর আর এক পাশে সুবৃহৎ অলিন্দ। বন্ধু তার বউকে নিয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে তাকে তার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষটি দেখিয়ে দিয়ে গেল। রুমে প্রবেশের সাথে সাথেই মৃদু সমীরণ বয়ে গেলো তার সর্বাঙ্গে। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখলো কক্ষের সবগুলো বাতায়ন বন্ধ। তাহলে এই সমীরণ! এর উৎস কোথায়? ক্লান্তিকর শরীর নিয়ে এই বিষয়ে আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না তার। নিজেকে সতেজ করে শয্যায় গা এলিয়ে দিলো সে। সুনশান নিরব আঁচল চারদিক। শুধু কানে আসছে দূর থেকে বয়ে আসা সমুদ্রের উত্তাল ধারা ধ্বনি।
দরজায় কড়া নাড়ার পরেও ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে বুঝতে পারলো ভেতরে অবস্থানরত মানুষটি ঘুমে আচ্ছন্ন। মিনিটদশেক পর আবার এসে নাম ধরে ডাক দেয়ার কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে দরজাটি খুলে দিয়ে বন্ধুর সাথে খাবার টেবিলে এসে বসলো। দুপুরে রান্না করা খাবার গরম করেই এই রাতের বেলা চালাতে হবে কারণ ভাবির পক্ষে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রান্না করাটা সম্ভব নয়।
‘শুভ্র?’
খাবার টেবিলে বন্ধুর ডাক শুনে এক পলক তার দিকে তাকিয়ে নিরবে আবার খাওয়া শুরু করলো। শুভ্রের কাছে খাওয়ার মাঝে কথা বলাটা অভদ্রতা বলে মনে হয়। এটা তার বন্ধু খুব ভালো করে জানতো বলেই আর কোনো কথা বললো না। খাওয়া শেষ করে বন্ধুকে বললো
‘রাফি, কি বলবি বল। এখন কথা বলতে আর কোনো সমস্যা নেই।’
হাতের থালাটি টেবিলে রেখে শুভ্রের দিকে ফিরে একটা চেয়ারে বসে তাকে জিজ্ঞেস করলো
‘কেমন আছিস শুভ্র? আজ চার বছর পর তোর দেখা পেলাম। এই চার বছরে এতো যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম একবারের জন্যও তোর নাগাল পেলাম না। কোথায় লুকিয়েছিলি তুই? আর গতকাল তুই কল করে বললি তুই এখানে আসবি তা-ও আবার নাকি হোটেলে উঠবি। আমি যদি...”
‘চার বছর আগের সেই রাতের সবটা ঘটনা তোর মনে আছে রাফি? কিভাবে আমি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম।’
রাফির কথার মাঝেই শুভ্রর বলা কথাটা শুনে সেই কাল রাত্রের সম্পূর্ণ ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মনে হলো।
‘মনে আছে আমার। কিভাবে তোকে সেই রাত্রে সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার থেকে বাঁচিয়েছিলাম, তোর গায়ে এতো শক্তি চলে এসেছিলো যে আমিসহ আরো দশজন মানুষ মিলেও তোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কিছু মুহূর্ত পর তুই হঠাৎ করেই আবার শান্ত হয়ে গেলি যেমন কিছুক্ষণ আগে অশান্ত হয়েছিলি।’ ‘সেই রাতে অদিতি শুধু আমাকেই শেষ করতে ব্যর্থ হয় তাও শুধু মাত্র তোর জন্য কিন্তু সে আমার বাবা মাকে ঠিক সেই রাত্রেই মেরে ফেলে।’
‘অদিতি কে?’
‘বাবার ব্যবসায়ী বন্ধুর মেয়ে। কালো জাদুবিদ্যায় বিশেষ জ্ঞান আছে তার। আমাদের তিনজনের আদলে তিনটা পুত্তলিকা বানায়। জাদুবলে পুত্তলিকাদের বশে আনে আর বাবাকে দিয়ে মাকে আগে খুন করায় তারপর বাবাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। মাকে কি নৃশংসভাবে মেরেছে সে! আমাদের বাসার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়, পড়ে গিয়ে মায়ের মাথা ফেটে যায় আর যদিও সেখানেই মায়ের মৃত্যু হয় কিন্তু অদিতি তাও ছাড়েনি। বাবাকে দিয়ে পাশে পড়ে থাকা পাথর দিয়ে মায়ের মাথাসহ পুরো শরীর থেঁতলে দেয়। বাবা নিজের হাত-পায়ের রগ ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে আর শেষ পর্যন্ত মায়ের শাড়ি বাড়ির উঠানের আমগাছের সাথে বেঁধে সেখানেই গলায় ফাঁস দেয়।’
‘ও কেনো তোদের মারতে চাইবে?’
রাফির প্রশ্ন উপেক্ষা করে শুভ্র আবারো নিজের কথা বলতে থাকে।
‘এবার শুধু বাকি রইলাম আমি। আমাকে নিয়ে ওর অন্য রকম এক পরিকল্পনা ছিলো। আমি যেহেতু তোর বাংলোয় ছিলাম এটা বাবা মা ছাড়া আর কেউ জানতো না তাই অদিতি চেয়েছিলো আমি যেখানেই থাকি আমাকে বশ করে আগে বাড়ি নেওয়াবে তারপর বাবা মাকে খুনের দায়ে জেলের ঘানি টানাবে।’
‘তুই এসব কিভাবে জানলি?’
‘বেঁচে যাওয়ার পর তোর বাসা থেকে যেদিন চলে গেলাম সেদিন কালো জাদুবিদ্যায় পারদর্শী একজনের সাথে যোগাযোগ করি আর উনি আমাকে দেখেই বলে আমাকে কেউ বশ করেছে। উনি আমাকে পরীক্ষা করে ওনার জাদুবলের মাধ্যমে আমার উপরকার জাদু কাটিয়ে দেয়। ওনার কাছে থেকে তিন বছরে আমিও কালো জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে গেলাম। তিন বছর পর যখন বাড়ি গেলাম গিয়ে দেখলাম আমাদের বাড়িতে অদিতিরা পরম সুখে দিন কাটাচ্ছে। আমাদের ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি, সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছে। এসব দেখে আমি আর তাদের মুখোমুখি হইনি। নিজের জাদুবলে এক এক করে তাদের বশ করি আর বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করি, কেউ যখন বলতে পারলো না তখন এক এক করে সবাইকে শেষ করতে শুরু করলাম। অদিতির বাবা, মা, ভাই, বোন কেউই যখন পারলো না শেষে অদিতিকে বশে আনলাম। যেহেতু অদিতি নিজেও জাদুবিদ্যা জানতো তাই তাকে বশে আনা সহজ ছিলো না আমার জন্য। ওকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর জানতে পারলাম বাবা মাকে কে আর কেন মেরেছে।
যেভাবে সে আমার বাবা মাকে মেরেছে আমিও ঠিক সেভাবে মেরে তাকে সেই আমগাছে ঝুলিয়ে দিয়ে আসি।’
কথাটা বলেই শুভ্র আমার দিকে তাকিয়ে কি বিদঘুটে একটা হাসি দিলো। ওর হাসি দেখে আমারই কেমন ভয় হতে শুরু করলো।
‘তখন তুই জিজ্ঞেস করেছিলি না যে অদিতি কেন বাবা মাকে মেরেছে? তার উত্তর দিচ্ছি আগে তুই চা করে আন। কথা বলে বলে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে। যদিও তোর গ্যাস শেষ, অজুহাত না দেখিয়ে হিটারে বানিয়ে আন।’
আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকানো মাত্রই আমার মনের প্রশ্ন বুঝে ও আবার উত্তর দিলো
‘আমি জাদুবলে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি এখন পর্যন্ত। এই যেমন ধর তোর বউকে তুই ইচ্ছে করে মেঝেতে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিস যাতে সে তোর ব্যাপারে নাক না গলাতে পাতে আর তুই নিশ্চিন্তে তোর প্রেমলীলা চালাতে পারিস’
আর এক মুহূর্ত ওর সামনে না দাঁড়িয়ে চা বানাতে চলে এলাম। কি ভয়ঙ্কর এই জাদুবিদ্যা! চা বানিয়ে ওর হাতে দিলাম, খাওয়া শেষ করে আবারো বলতে শুরু করলো
‘আমার আর অদিতির বাবা একটা নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা করেছিলেন। যার বাজেট ছিলো প্রায় কয়েক কোটি টাকা। অদিতির বাবার ছিলো ষাট শতাংশ টাকা, যা ছিলো তার সারা জীবনের আয়ের মূল অংশ। পরিকল্পনাটা বাস্তবায়নের শতভাগ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাবার একটি ভুল স্বাক্ষরের জন্যে তা বাতিল হয়ে যায় আর সব টাকা খোয়া যায়। যেহেতু এখানে অদিতির বাবার সব টাকা ছিলো আর তা আমার বাবার ভুলের জন্যে হারাতে হয়েছে। আর অদিতি এসব করেছে তার বাবার হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।’
‘তার মানে তুই একজন খুনি? পাঁচ পাঁচজন মানুষকে খুন করে তুই আমার সামনে বসে আছিস! তোকে যদিও এই মুহূর্তে আমার অনেক বেশি পরিমাণে ভয় করা উচিত কিন্তু আমার ভয় লাগছে না।’
‘ভয় লাগবে কিভাবে! তুই নিজেও এই মোহিনীবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ।’
শুভ্র রাফি একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক কুটিল হাসি দিয়ে যে যার কক্ষে ফিরে আসলো। শুভ্র যখন আবারো কক্ষে প্রবেশ করলো আবারো সেই মৃদু সমীরণ তার গা ছুঁয়ে গেলো সাথে এক মিষ্টি সুবাসে পুরো কক্ষ ম-ম করছিলো। এই সমীরণ আর সুবাসের রহস্যটা কি!