প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান বলেছেন, শামসুর রাহমান ‘প্রধান কবি : কারণ, সামগ্রিক বিবেচনায় তাঁর কালখণ্ডে তিনিই প্রধান কণ্ঠস্বর, আধি ও নিধিতে। পরভৃত কবি : কারণ তাঁর কালের পরিকীর্ণ প্রতিবেশ ও পরিবেশকে তিনি স্যামসনের মতো কাঁধে নিয়ে জয়-পরাজয়-প্রাচুর্যে হয়েছিলেন কালের কোকিল। পরঞ্জয় কবি : কারণ, কালের সকল প্রতিকূলতাকে তিনি দুর্জয় রিপু বলে জয় করে হয়েছিলেন অরিন্দম। কবিতাকে আমরা যদি পেতে চাই সময় চেতনায়, ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ চেতনায়, তাহলে তিনি মহত্তম কারিগর।’ শামসুর রাহমান সম্পর্কে এমন ধারণা যে কেবল গাজী আজিজুর রহমানের, তা নয়। হুমায়ুন আজাদও তাঁর বিষয়ে বহু আগে একই ধরনের কথা বলেছিলেন। শামসুর রাহমান দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে লেখালেখি করেছেন, সমকালকে ধারণ করে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিকতা ও প্রেম দীর্ঘপথ হাতে হাত ধরে হেঁটেছে।
শামসুর রাহমান প্রথম যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি ত্রিশের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুর চিন্তা তাঁকেও পেয়ে বসেছিলো। তিনি প্রথম কবি-জীবনে ঠিক করেছিলেন তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখবেন না। কারণ ত্রিশের কবিদের মতো তাঁরও ধারণা ছিলো রাজনৈতিক কবিতা কখনো শুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু সময়ের টান অথবা রাজনীতি কি উপেক্ষা করা যায়? রাহমান সে টান উপেক্ষা করতে পারেননি। সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে।...আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। ...যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে-আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠল বহির্জীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি মনস্ক। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ ক’রে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান।’
শামসুর রাহমান বাঙালির যে কোনো জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন। রাহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের কথা স্মরণযোগ্য। দীর্ঘ ন’ মাসের করুণ, বীভৎস, হৃদয়বিদারক বর্ণনা উঠে এসেছে এ কাব্যের কবিতাগুলোতে। স্বাধীনতা কখনো তাঁর কাছে বোনের হাতের নম্র মেহেদী, কখনো ‘বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার’, আবার কখনো ‘গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল’ হয়ে ধরা দিয়েছিলো। স্বাধীনতার জন্যে বাঙালির যে বিসর্জন, আত্মত্যাগ, সমবেত কণ্ঠস্বর- তা বেশ ক’টি কবিতায় শামসুর রাহমান তুলে ধরেছেন। তাঁর রচিত এ ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘গেরিলা’, ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘তুমি বলেছিলে’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। এ কবিতায় তৎকালীন নষ্টসময়কে নানা নামে, উপকরণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একাত্তরে যারা দেশের সাথে মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো, সেই রাজাকাররাই দেশ স্বাধীনের কিছুটা সময় পরে আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেলো। কবি শামসুর রাহমান এই অবস্থার প্রেক্ষিতে লিখলেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতাটি। এই কবিতায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এতোই শক্তিশালী যে, যা যে কাউকেই স্পর্শ করবে। সেই সময়ের প্রতি সৃষ্টি করবে বিরূপ মনোভাব। কবির মোনাজাত : ‘হে আলেমুল গায়েব, হে গাফ্ফার,/আপনি আমাকে এক্ষুণি/একজন চৌকশ রাজাকার ক’রে দিন। তাহ’লেই আমি/চটজলদি গুছিয়ে নেবো আখের।’ রাজনীতি সচেতন হওয়া সত্ত্বেও রাহমানের কবিতা রাজনৈতিক ব্যক্তি-বিশেষের হাতিয়ার হয়ে উঠেনি। বরং তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সর্ব সাধারণের অনুভূতি হয়ে উঠেছিলো তাঁর কণ্ঠ।
বাংলা কবিতার নাগরিক সভ্যতা শামসুর রাহমানের কবিতাকে কেন্দ্র করে সমৃদ্ধ হয়েছে। অল্প কিছু সময় বাদ দিলে শামসুর রহমান তাঁর দীর্ঘ জীবন ঢাকা শহরে যাপন করেছেন। ফলস্বরূপ তাঁর নগরকেন্দ্রিক কবিতা তাঁর নিজস্ব ঢংয়েই বেড়ে উঠেছে। তিনি শহুরে দালান কোটা, নিষ্প্রাণ পাথরে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় বাস, পাকা রাস্তা, রোড লাইট, বাজার, পার্ক, অলিগলি, মার্কেট, ঘুপচি, রেস্তোরাঁ ইত্যকার নাগরিক শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেখানে গ্রামের নিসর্গ ও প্রকৃতি দেখে সবাই মুগ্ধ, সেখানে শামসুর রাহমান মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন নগরের সৌন্দর্য। শহরের নিসর্গ তাঁকে বারবার টেনেছে। শহরের পরিবর্তনও কবি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কখনো শহরের প্রতি যে তাঁর বিতৃষ্ণা লাগেনি এমনটিও নয়। কখনো কখনো তিনি শহর ছাড়তে চাইলেও পরে সেই ইচ্ছাকে দমন করেছেন। স্মৃতিমাখা বেড়ে ওঠার শহর ঢাকাতেই তিনি স্থির থাকেন :
‘আঁধারের রহস্যময় প্রাচীন তারার স্বপ্নে দয়ালু উজ্জ্বল
নৈকট্যের স্মৃতিতে উষ্ণ চিরকাল। বুঝি তাই ফিরে আসি
বারবার তেতো হয়ে আসা চুরুটটা মুখে চেপে।’
শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় বারবার শহরকে বহুমাত্রিকভাবে দেখতে চেয়েছেন। ছোট ছোট বিষয় আশয়ও তার দৃষ্টি থেকে এড়ায়নি। মূলত কবির সুখণ্ডদুঃখ, অভিজ্ঞতা, পথচলা এই শহরকে ঘিরেই। যেহেতু রাহমান তাঁর দৈনন্দিনতাকে কবিতায় স্থান দিতেন, তাই শহর অসংখ্যবার স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। নগর, নাগরিকতা হয়ে উঠেছে তার কবিতার বিশেষ উর্বরভূমি।
কবির প্রেমের কবিতায় প্রাপ্তির চেয়ে বিরহ বেশি উচ্চকিত হয়েছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নিজেকে দায়ী করেছেন : ‘ভালোবাসা তুমি ক্ষত-চিহ্নিত/পাতাহারা আজ, তোমার কী দোষ বলো?/ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি/ ঢালিনি শিকড়ে একবিন্দু জলও’। তীব্র আকাক্সক্ষার কারণেই হয়তো প্রেমের বেদনা তাঁকে বারবার ছুঁয়েছে। তিনি যতই বলেছেন ‘তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না’, ততই তাঁকে ভুলতে হয়েছে। নানা উপমায় কবি তাঁর প্রিয় মানুষটিকে দেখেছেন। তাকে চিত্রায়িত করেছি অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে-‘তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ, দেখছো/ তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর।’ রাহমানীয় প্রেম এ কারণেই ব্যতিক্রম। তাঁর প্রেম প্রাপ্তিতে যতখানি না সফল, অপ্রাপ্তিতে তারচেয়েও বেশি সফল।
শামসুর রাহমানের কবিতা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত সম্ভবত হুমায়ূন আজাদই দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘সমকালীন বহির্জীবনের সাথে শামসুর রাহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন আপন ব্যক্তিতাকে, বারবার ‘আমি’ উচ্চারণ তাঁর স্বভাব, যার ফলে তাঁর কবিতায় রচিত হয়েছে বিপুল পরিমাণ আত্মবিবরণী; আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মকথনে তিনি বাঙালা ভাষায় সম্ভবত অদ্বিতীয়;-আপন প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ, ব্যক্তিগত জীবন ও প্রতিবেশ, আত্মীয়-বান্ধব এবং নিজের সাথে সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত কিছুই ঢুকে পড়েছে তাঁর কবিতায়।’ হুমায়ূন আজাদ তাঁর লেখায় এও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, শামসুর রাহমানের আমি সর্বজনের আমিত্বে পরিণত হয়েছে। আর নিজের মধ্য দিয়ে সর্বজনের কথা বলা যে একটি বিশেষ গুণ, তা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নেয়া শামসুর রাহমান সেই যে পঞ্চাশের দশকে লেখা শুরু করেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট কবি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।