সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ০৯:৪৬

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(বত্রিশতম পর্ব)

বন্ধুপর্ব-২

স্কুলের কুয়ো ছেড়ে কলেজের নদীতে এসে বন্ধুর সংখ্যা গেলো বেড়ে। আগের বন্ধুদের অনেককেই হারিয়েও ফেললাম, আবার নতুন অনেক বন্ধুকেও পেলাম। গণিত অপশনাল আর জীববিদ্যা আবশ্যিক করে বাছাই করা একাদশ শ্রেণির পাঠক্রমের কারণে আমি অন্তর্ভুক্ত হলাম ‘বি’ সেকশনে। এখানে আমার বন্ধু হলো নতুন নতুন অনেকেই। বন্ধু সাহেদ ছিলো আমার একজন কাছের মানুষ। অনুচ্চ স্বরে কথা বলতো, চলাফেরায় ধীরস্থির। ‘বুলবুল আহমেদ’ উপাধির তকমাটা কে কেন দিয়েছিলো মনে নেই। তবে সে আর আমি এক সেকশনে যেমন ছিলাম তেমনি বোটানিও পড়তাম একসাথে হামিদ স্যারের কাছে। সে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ শেষে খুলনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। অধ্যয়নে একাগ্র থেকে সে আজ লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে। সাথে ইমরান নামেও একজন আমাদের সাথে পড়তো বোটানি। ইমরান এখন কোথায় তা জানি না। কলিমদাদ স্যারের কাছে একসাথে ফিজিক্স পড়া হান্নান এখন ইঞ্জিনিয়ার। রেটারিয়ানও বটে। তবে তার আজকালের চিন্তা-ভাবনায় মনে হলো দূরদর্শিতার কিছুটা ঘাটতি আছে। কোনটা ঘোঁট পাকানো আর কোনটা স্বতঃস্ফূর্ত সে বিষয়ে এখনও সহজে বুঝে উঠতে পারেনি।

ফয়েজ ছিলো লম্বা গড়নের। সহজ সরল তখন। এখন সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে হয়ে গেছে ব্যবসায়ী। মান্নান ছিলো নতুন বন্ধু, যদিও তখন খুব বেশি কথাবার্তা হতো না। গ্রাম ছেড়ে পড়ার প্রয়োজনে শহরে এসে রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতাদের পতাকাতলে যেতে হয়েছিলো। মেডিকেল কলেজে গিয়েও সে একই ধারা বজায় রেখেছে। এখন সে জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের পদে আসীন। মান্নান দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্থানীয় বিধায় তার মুখে প্রায়শ কড়া চাটগেঁয়ে ভাষা শুনতে পেতাম। রিয়াদ কলেজ জীবন থেকেই ছিলো একটু অন্য রকম। মনে হচ্ছে উদাসীন কিন্তু আসলে তা নয়। সে সবকিছুতেই জড়িয়েছিলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে। রিয়াদকে দেখলেই আমার খালি মনে হতো চেহারার দর্শনে সে বুঝি সালমান রুশদীর বাংলা ভার্সন। মেডিকেল কলেজে ঢুকে রিয়াদ বামে ঝুঁকে যেতে যেতেও যায়নি। তবে সর্বকালে সর্বযুগে সকল সুবিধায় সে বাদ যায়নি। বাঁশিতে তার ঝোঁক ছিলো। পুরোপুরি চর্চায় মগ্ন হতে পারেনি। বামেরা যেমন করে, ‘পুঁজিবাদী মার্কিনকে জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ বলতে বলতে একসময় নিজেরাই মার্কিনের নাগরিক হয়ে যায়, রিয়াদও তেমন। সে এখন মার্কিনে পাগল সামলায়। মানে সাইকিয়াট্রিস্ট। তার সৃজনশীল মেধা প্রকট। আমাদের ব্যাচের তিরিশ বছর উদযাপনের থিম সং সে ভালোই লিখেছে। এখন আবার ভিডিও এডিটর হয়ে ব্যাচের বয়সী নারীদের মনও জয় করেছে। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন বকুলের সাথে তার খুনসুটি আমরা উপভোগ করতাম সবাই। সমাপনী উৎসবে বকুল বর আর সে বধূ সেজে সবাইকে লাগিয়ে দিয়েছিলো তাক। রোল চুয়াল্লিশ-সাতচল্লিশের এই ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র দাম্পত্য ছবি তোলা ও র‌্যালি পর্যন্তই টিকেছিলো। তারপর এখন রিয়াদ রিমুর কারাগারে কয়েদী। রিমু কলেজে একসাথে পড়লেও মেডিকেলে একই কলেজে ছিলো না।

হাসান মুরাদ এইচএসসিতে একই কলেজে পড়লেও তার সাথে বেশি কথা হতো না। তবে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে এসে সে তার ডার্টি জোক্সের কারণে নজরে আসে। ডার্টি জোক্স আসলে ডার্টি ছিলো না, তবে বয়স্ক ছিলো নিশ্চয়ই। তার হাতে নিউরোফাইব্রোমা থাকায় তাকে মনে রাখা সহজ ছিলো। হাতের লেখাও বেশ ভালো ছিলো। প্যাথলজিতে ক্যারিয়ার করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিধাতা দেয়নি। একজোড়া দেবশিশু রেখে স্রষ্টা তাকে নিজের প্রয়োজনে নিয়ে গেছে কাছে। তাও আবার কোভিডের সময়। কিরণ কলেজিয়েট স্কুলে ওড়লেও ছিলো মর্নিং শিফটে। তাই দেখা হতো না। কলেজেও দেখা হতো খুব কম। মেডিকেলে এসে কিরণের গতিবিধি চোখে পড়ে বেশি। সে হলো ‘চলিষ্ণু আনন্দকল্পদ্রুম’-এর মতো কিছু একটা। সে সাথে থাকলে কারও মন খারাপ করে থাকার প্রশ্ন আসে না। পাথুরে নদীও তার বচনে-ভাষণে কৌতুকময় হয়ে উঠতো। শখের সংগীতে কিরণের গলা বেশ তাল মিলাতে পারতো। কিরণের হাসি উদ্গীরণের ক্ষমতা অসাধারণ। সে এখন সকলের মধুমেহ সারায়। সারায় বললে ভুল হবে। মধুমেহ মন্থন করে সে নিজের আখের গোছায়। কিরণ আমাদের বন্ধু মহলে সর্বজনপ্রিয়, সর্বজনের জন্যে ধনেপাতার মিশ্রণ।

আমার সেকশনে এক বিচ্ছু বন্ধু ছিলো বিপ্লব দাশ। তাকে সংক্ষেপে বিলু নামে ডাকে। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে এসেছে। এ যেন লাফ দিয়ে রাস্তার ওপার থেকে এপারে এলো, এমনই। তার ‘বোম্বাই লিচু’র প্যারোডি আজীবন মনে থাকবে। তার চেহারা-সুরতে সে দক্ষিণী সিনেমার নায়ক হতে পারতো বিলক্ষণ। কিন্তু ওদিকে মনে হয় বিলু মন দেয়নি। ক্লাসে স্যারদের আসতে দেরি হলে গ্যালারির পেছনের বেঞ্চ হতে শুরু হতো বিলুর ছায়াছন্দ অনুষ্ঠান। ‘সাজন’ ছবির গান তার কণ্ঠে শুনতে শুনতে মনে হতো, অলকা ইয়াগনিকের সাথে এস.পি. বালা সুব্রহ্মণ্যম নয়, আমাদের বিলুই ছিলো মূল ভোকালিস্ট। বিলুর সাথে আরও দুজনকে আমি আমার সেকশনে পাই, যারা চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসেছিলো। একজন রাশেদ আর একজন রাজন। রাশেদ কথা বেশি বলতো না, তবে কমও নয়। তাদের পাড়ার টিমে সে উইকেট কিপার ছিলো। তার সাথে মেডিকেল কলেজেই মূলত বেশি জানাশোনা হয়। একাধিক রাশেদ থাকায় মেডিকেল কলেজে তাকে সবাই ‘দীপা রাশেদ ‘ নামেই চিনতো। শেষমেশ সে অবশ্য দীপার সাথেই বেঁধেছে গাটছড়া। তারা দুজনেই এখন অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের রেমিট্যান্স বীর।

রাজন ছিলো কলেজে যতটুকু সুবোধ, মেডিকেল কলেজে গিয়ে তারও অধিক। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে রাজন সবার প্রিয়পাত্র। সে যেন অজাতশত্রু। মাঝে মাঝে অনেকেই তাকে দুধভাতও মনে করতো বোধ হয়। পাওয়ারের চশমা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অধরোষ্ঠ কিঞ্চিৎ উন্মীলিত সলজ্জ দন্তবিকশিত বোকা বোকা হাসিতে রাজনকে মনে হতো বাঙালি-মণিপুরী শংকরায়িত বেভুলো বালক। রাজনের কথাগুলো চিলো উইটি। মারাত্মক উইটে ভরভরান্ত থাকতো তার প্রতিটা বচন। এ যেন রাজন্য-প্রবচন। রাজনের পরিবার আগে থেকেই বড়ো বুশের কাছে ছিলো। পাস করে রাজনও সুর সুর করে ওবামার টানে চলে গেলো বাংলাদেশিদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মার্কিন মুলুকে। বছর খানেক আগে হঠাৎ ফোন করে আমার একসেট বই চেয়েছিলো। বই পেয়ে বন্ধু বিকাশে মূল্যও পরিশোধ করেছিলো। নারী সহপাঠীদের সাথে কলেজে তখন খুব বেশি কথাবার্তা হতো না। কারণ তারা গ্যালারির সামনের কয়েক বেঞ্চে বসতো। স্যার এলে গ্যালারিতে ঢুকতো আর স্যারের সাথে সাথে বের হয়ে যেতো। তারা আলাদা ক্যান্টিন এবং আলাদা কমনরুমে যেতো টিফিন ছুটিতে। প্রাইভেটও পড়তো সকালে আলাদা ব্যাচে। ফলে খুব বিশেষ কোনো মিশন না থাকলে কোনো নারী সহপাঠীর সাথে কারও বেশি একটা কথা বলার সুযোগ হতো না। কলেজে আমার সেকশনে পড়া রুবি, সাগরিকা, পান্নাদের আমি মেডিকেল কলেজে এসেও পেয়েছি।

মেডিকেল কলেজে এসে প্রথম যে বন্ধুটির সাথে আমার কথা হয়েছিলো, সে হলো চিন্ময়। বাড়ি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরে সে মাইগ্রেশন নিয়ে চলে যায় স্যার সলিমুল্লায়। মেডিকেল কলেজ আমাকে উপহার দিয়েছে বেশ কয়েকজন ভালো বন্ধু। এর মধ্যে ফরহাদউদ্দীন নির্ঝর একজন। তার মধ্যে সহজাত নেতৃত্বগুণ বিরাজিত ছিলো। তার গানের গলাও ছিলো বেশ ভালো। ফুটবলও খেলতো ভালো। নির্ঝরের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মৈশাদী। বন্ধু নূরুল আলমের ডাক নাম ছিলো বাবু। তার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি। তার দেহের তুলনায় কণ্ঠের জোর ছিলো বেশি। আবৃত্তি করতো ভালো। এখন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ায়। তবে বাবুর সমাপনী র‌্যালিতে ভিখিরির সজ্জাটা ছিলো অসাধারণ। একই শহরে থাকলেও বাবুর সাথে আমার দেখা খুব একটা বেশি হতো না। মাঝে মাঝে সেমিনারে নয়তো রিকশায় রাস্তার মাঝখানে দেখা হতো। তার সাথে রাত জেগে কার্ড খেলার স্মৃতি আমার অনন্য। নোবেল, ফসি, স্বপন একসাথে তিনজনকে পেয়ে যাই কাছের বন্ধু হিসেবে। নোবেলের বাড়ি কুষ্টিয়া ভেড়ামারা। স্বপনের বাড়ি মনে হয় সিরাজগঞ্জ বা দিনাজপুর। নোবেল ও স্বপন দুজনেই সেনা কর্মকর্তা। স্বপন চোখ সারায় আর নোবেল প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলো। ফসির বাড়ি খুলনা। ছাত্রজীবনে অলস ছিলো। খালি ঘুমুতো। এখন সে পঙ্গুর ডাক্তার। ফসির উপস্থিত বুদ্ধি ক্ষুরধার। মেডিকেল কলেজ জীবনে শ্যামলের সাথে আমার বন্ধুতা বেশ প্রগাঢ়। বাড়ি গোপালগঞ্জ। থাকে মিরপুর। শিশুদের চিকিৎসক। শিশু স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে তার পড়াশোনা। সংস্কৃতিবান শ্যামল। তবলায় ভালো হাত ছিলো। কণ্ঠও ভালো ছিলো। তাপস পাল মার্কা চেহারা। বন্ধু মহলে গ্রহণযোগ্যতা বেশ। শ্যামলের বড়ো ছেলে আর আমার বড়ো ছেলে একই ক্লাসে পড়ে, তবে এক কলেজে নয়। আন্তঃবর্ষ ফুটবলে শ্যামল রক্ষণভাগ সামলেছিল মং, বাবুল আর জিনাংশুর সাথে।

আব্বাস, মঈন, শামসুর কথা না বললেই নয়। তারা আমার সেকশনে। আব্বাস এখন রেডিওলজিস্ট, মঈন ইন্টার্নিস্ট এবং শামসু নিউরোসার্জন। এদের পাশাপাশি শিমূল আর সাজুর সাথেও আমার সখ্য নিবিড়। শিমূল-সাজু মানিকজোড়। তাদের আলাদা করা বেশ কষ্টসাধ্য। ঢাকার আশিক আমাদের ব্যাচের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপন আমার মনে হয়ে তার কণ্ঠেই সেরা। টিটি খেলতো বেশ, ক্যারামও। জাপানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এখন মার্কিনে। বন্ধু গোপাল এক মজাদার চরিত্র। খিস্তি-খেউড়ে ওস্তাদ। বাবলা বা হাসিনকে খেপানো সহজ ছিলো। খোরশেদ স্কুল-কলেজ-মেডিকেল কলেজ থেকেই একসাথে। সুবোধ, চুপচাপ। মোজাম্মেলের শিস্ বাজানোর ক্ষমতা ছিলো বেশ। মং হ্লা চিং চাক নরম মনের মানুষ। শিপন, প্রণয় এরা একই রকম চরিত্রের বলে মনে হয়। ডেন্টালের জাহেদ আমাদের এক মজার চরিত্র। সে ছিলো হাস্যরসের উদ্গাতা। ডেন্টাল সুমন র‌্যালিতে হিজড়া সেজে বিখ্যাত হয়ে আছে। ডেন্টালের মুন্না, রুমু, নাসরিন, মমতা, নীপা এদের সাথে যোগাযোগ ছিলো বেশ ক্যাম্পাসে থাকাকালীন। একটা শিক্ষাজীবনের ক্রমবিকাশে এদের ভূমিকাও কম নয় মোটেই।

বিদেশিদের মধ্যে মোহাম্মদ, রিজওয়ান, নাদিম, প্রমোদ, আশিস এরাও আমার সহপাঠী ছিলো। তবে এদের কারও সাথেই আমার তেমন বন্ধুতা হয়নি।

(চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়