শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মেঘনা কি শুধু একটি নদীর নাম?

মোঃ নূরুজ্জামান
মেঘনা কি শুধু একটি নদীর নাম?

বাংলাদেশ নদীমাতৃক এক স্বদেশ। সমাজ ও দেশ গঠনে নদীর ভূমিকা প্রাচীনকাল থেকেই সুবিদিত। নদী মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নদ-নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতার ইতিহাস। দেশের কৃষি, পানি বিদ্যুৎ, সেচব্যবস্থা, সহজ ও সুলভ পানিপথ, পানীয় জলের অনন্ত যোগান, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, উৎপাদন, বিপণন, পরিবেশ সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শহর ও শিল্পকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে একটি দেশে নদ-নদীর প্রভাব খুবই বেশি। নদ-নদীগুলো যেনো মায়ের হাতে সন্তানস্নেহে লালন-পালন করে চলছে এই বাংলাদেশকে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে নদ-নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সকল নদীই বিশ্বমানবতার এক নিদর্শন। বিন্দু বিন্দু পানিরাশির অববাহিকায় উৎসস্থল পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে ছড়া, উপনদী, শাখানদী, নদী, জলপ্রপাত, সাগর ও মহাসাগরের সৃষ্টি। নদী-ছড়া-উপত্যকার নামে দেশের অধিকাংশ গ্রাম-শহর পরিচিত। নদীর সাথে যেনো মানুষের আত্মীয়তার চিরন্তন বন্ধন। নদীগুলো অবিরত তাদের চঞ্চল-চপলা জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছে মানুষের কল্যাণে। নদীর সুবিধাজনক তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শহর, বন্দর, নগর, হাট-বাজার, শিল্পকারখানা প্রভৃতি।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালোবাসা অবচেতনভাবেই জড়িত হয়ে যায়। বাংলাদেশের কিছু পাহাড়ি ও তৎসংলগ্ন সমতল ভূমি ছাড়া নদীর সাথে সকল মানুষ, প্রকৃতির রয়েছে প্রাণের নিবিড় সম্পর্ক। নদীপথ আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ। আজ যে যানজটের কারণে মানবজীবন থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সড়কপথের সাথে নদীপথকে আরো গুরুত্ব ও আধুনিকায়ন করতে পারলে দেশের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ ও উপভোগ্য হতো।

আমাদের জনজীবনে নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। মিশরের নীলনদ যেমন মিশরীয় সভ্যতার প্রাণ, তেমনি পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পাদভূমি বাংলাদেশের সভ্যতা সংস্কৃতি অর্থনীতির প্রাণ সিঞ্চিত হয় প্রধান এ নদী গুলোকে কেন্দ্র করে। নদীর সঙ্গে আমাদের জীবনধারা, সাহিত্য সংস্কৃতি, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে।

নদ-নদী মানুষ, বৃক্ষরাজি ছাড়াও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণনা, কল্পনারও বাইরে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল রয়েছে নদীতে।

মেঘনার বংশ পরিচয়

বরাক নদী (বরাক গাং হচ্ছে ভারতের আসাম রাজ্যের মহিপুর ও কাছাড় জেলায় সুরমা নদীর উজান প্রবাহপথের নাম)। এই নদীটি প্রায় ৫৬৪ কিলোমিটার (৩৫০ মাইল) লম্বা এবং ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম এবং আসামের মধ্যে গিয়ে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বরাক নদী হচ্ছে দক্ষিণ আসামের একটি প্রধান নদী এবং সুরমা-মেঘনার আপার বা উৎপত্তি অংশ। এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে মণিপুর রাজ্যের পাহাড়ে। আাসমের বদরপুর এবং সিলেটের আমলসিদের কাছে এটি সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের সিলেটের সমভূমিতে এসে মাদনা নামক স্থানে এ দুটি শাখা আবার মিলিত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই মিলিত ধারা বরাক থেকে শুরু হলেও স্থানভেদে এটি কালনী, ভেড়ামোহনা, বলেশ্বর ও মেঘনা নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের আসামে এর অববাহিকা প্রায় ৮,৮০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৩,৪০,০০০ মাইল) জায়গাজুড়ে রয়েছে। এই অববাহিকা প্রচুর ধান, গমসহ বিপুল শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া অববাহিকাটিতে ব্যাপক পরিমাণে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

মেঘনা নদী বা মেঘনা আপার ও লোয়ার নদী বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল ও ভোলা জেলাকে নৌপথে সংযুক্ত করেছে। মেঘনা নামে পরিচিত অংশ থেকে নদীটির দৈর্ঘ্য ১৫৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৪০০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদী ব্যবস্থার মধ্যে মেঘনা-সুরমা নদী ব্যবস্থা অন্যতম এবং দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত একটি বৃহত্তম নদী ব্যবস্থাপনা। পৃথিবীর বৃষ্টিবহুল চেরাপঞ্জির প্রায় কাছাকাছি স্থান এই নদী ব্যবস্থার উৎপত্তি স্থল এবং বাংলাদেশের প্রায় ৯০% পানি এই মেঘনা-সুরমা নদী ব্যবস্থা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে।

মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ামক হিসেবে মেঘনা নদীর নাম উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বড় বড় নদীগুলোর মধ্যে তিনটি বড় নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহত্তম নদীমালা। তবে সব ক’টি বড় নদী এদেশে পরিণত অবস্থায় প্রবাহিত হওয়ার ফলে এদেশের সমভূমি গঠনে নদীগুলোর ভূমিকা সক্রিয়। নদীগুলোর প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং পরিণত অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থিত হওয়ায় নদীগুলো নিয়ে নীরবে নিভৃতে চলছে আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লষ্ট কূটনৈতিক খেলা।

মেঘনা বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম। এটি হিমালয় বহির্ভূত একটি নদী ব্যবস্থার অংশ।

সুরমা শাখাটি সিলেট শহরকে দুভাগে বিভক্ত করে পিয়াইন, ধলাই ও চেংগের নদী, বোগাপানি, যাদুকাটা, সোমেশ্বরী এবং কংশনদীর পানি বুকে নিয়ে খরস্রোতারূপে সুনামগঞ্জ হয়ে এবং কুশিয়ারা শাখাটি মৌলভীবাজারের মনু ও হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই নদীর পানি বুকে ধারণ করে সর্পিল পথ ও গতি বেয়ে মাদনা নামক স্থানে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে মিলিত প্রবাহটি ভৈরববাজারের মারকুলি নামক স্থানে মেঘনা নাম ধারণ করে চাঁদপুরের কাছে পদ্মা এবং ডাকাতিয়া নদীর সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়ে এর গতির সমাপ্তি টানে।

মেঘনা নদীর নামকরণ : মেঘনা নদীর নামকরণ নিয়ে গল্প কথা প্রচলিত রয়েছে। এতে বলা হয়, আকাশে মেঘ দেখা দিলে মেঘনা উত্তাল হয়ে যায়। এ সময় নৌযান চলাচল নিরাপদ নয়। তাই মেঘনা নামের ব্যাখ্যা দাঁড়ায়-মেঘ+না অর্থাৎ আকাশে মেঘ দেখা দিলে নাও ছাড়ো না। মেঘনা নামের এই কিংবদন্তি আজও মাঝি মাল্লাদের মনে সক্রিয়ভাবে জাগরুক রয়েছে (ওয়াজেদ)।

উৎপত্তি এবং সমাপ্তির ভিত্তিতে মেঘনা নদী ব্যবস্থাপনাকে আপার মেঘনা ও লোয়ার মেঘনা হিসেবে বিভক্ত করা হয়।

কুলিয়ার চর থেকে ষাটনল পর্যন্ত মেঘনার অংশ আপার মেঘনা হিসেবে পরিচিত। নদীর এ অংশটি মেঘনার অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ।

লোয়ার মেঘনা অংশটি ষাটনলের নিচ থেকে চাঁদপুর অংশে ডাকাতিয়া এবং পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে খরস্রোতা রূপ ধারণ করে হাতিয়া, বরিশাল, ভোলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে একীভূত হয়। লোয়ার মেঘনা অংশটি পৃথিবীর অন্যতম গভীর ও প্রশস্ততম নদী হিসেবে পরিচিত। লোয়ার মেঘনার সাথে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও গঙ্গার পানিও এসে মিশে একীভূত প্রবাহ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

মেঘনার প্রধান প্রধান শাখা নদীগুলো হলো পাগলী, উর্বমদি, কাঁঠালিয়া, ধনালিয়া, ধনাগদা, মতলব।

মেঘনা এবং উপরোক্ত শাখা নদীগুলোর সাথে ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকা থেকে কিছু প্রবাহ এসে মিলিত হয়। এগুলো হলো : গোমতী, বালুঝুরি, হান্দাছড়া, হাওড়া, কুরিলিয়া, জঙ্গোলিয়া, সোনাইবুড়ি, সোনাইছড়ি, দুরদুরিয়া। এসব পাহাড়ী নদী মেঘনা নদীর কারণে যে আকস্মিক বন্যা হয় সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বরাক থেকে মেঘনার দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০৪ কি. মি.। ভৈরববাজার ব্রিজের নিকট এর প্রশস্ততা ০.৭৫ কি. মি.।

অপরদিকে ষাটনলের নিকট মেঘনার প্রশস্ততা ৫ কি. মি.। ষাটনল থেকে ১৬ কি.মি. দূরে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র যমুনা মেঘনার সাথে মিলিত হলে এর প্রশস্ততা দাঁড়ায় ১১ কি. মি. (বর্ষাকালে)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মেঘনার দক্ষিণ ভাগ পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর একটি। (হারুনুর রশিদ, জিওগ্রাফি অব বাংলাদেশ)।

আপার ও লোয়ার মেঘনা নদী বিপুল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত এবং অধিকাংশ স্থানে নদীটি ভাঙ্গনপ্রবণ। মেঘনা ট্রাজেডির অন্যতম সাক্ষী। প্রায় চারশত বছরের ঐতিহ্যধারক ব্যবসাকেন্দ্র চাঁদপুর পুরাণবাজারটির অধিকাংশ আজ মেঘনার পেটে বিলীন।

লোয়ার মেঘনার নিচের দিকে প্রচুর চর রয়েছে। মেঘনা অত্যন্ত গভীর ও নাব্য নদী, সারাবছর নৌ চলাচল করতে পারে। ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হওয়ার স্থানে দুই নদীর পানির রংয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। এখানে মেঘনার পানি পরিষ্কার নীলাভ সবুজ। আর ধলেশ্বরীর বাদামি (ওয়াজেদ)।

মেঘনা নদী ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক ইস্যু

মেঘনা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীর উৎসস্থল ভারতে হওয়ায় এই নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কিছুটা তিক্ত ও ঝাল সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারত মেঘনার উজানে আসামের বরাক ও তুইড়ী নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব করলে ভাটি অঞ্চলে অবস্থান হওয়ায় একসময় বাংলাদেশের জনগণের মাঝে কিছুটা আশঙ্কা ও উত্তেজনামিশ্র সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।

মেঘনাকে নিয়ে কেন আমার এ নিবেদন?

পেশাগত জীবনে বদলির সুবাদে প্রথমবারের মতো আমি সিলেট থেকে এখন চাঁদপুরে অবস্থান করছি। আমার কাছে এ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণ হলো ঐতিহাসিক তিন নদীর (পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া) মিলনস্থল বা মোলহেড বা চাঁদপুর বড়স্টেশন। ছুটির দিনগুলোতে বা কাজের ফাঁকফোকরে নিরন্তর বয়ে যাওয়া স্রোত এবং মৃদুমন্দ স্নিগ্ধ বায়ু উপভোগ করতে সেখানে যাই। এ সাগরসম মিলনস্থলের তিনদিক বেয়ে স্পিডবোট, ট্রলার, মাছ ধরার নৌকা, বিরাটকায় পণ্যবাহী জাহাজ, বহুতল যাত্রীবাহী লঞ্চণ্ডস্টিমার যেন গ্রামীণ খাল বিলের বালিহাঁসের মতো নিশ্চিন্তে ভেসে বেড়াচ্ছে।

চাঁদপুর মোহনায় এ ক’দিনে অনেকবার মেঘনাকে সামনে রেখে অপলকে নিরিবিলি বসেছি, নিতান্ত বন্ধুবৎসল প্রিয়জনের দক্ষ ও আন্তরিক ব্যবস্থাপনায় মেঘনার পাড়ে বসে নদী থেকে সবেমাত্র ধরা টাটকা ইলিশভাজা উপভোগ করে রসনা তৃপ্ত করেছি। নদীর ব্যাপকতা, বিশালতা ও ব্যস্ততা অবলোকনে আন্দোলিত ও দোলিত হয়েছি। মেঘনাকে নিয়ে এমনি এলোমেলো আমার একান্ত কিছু ভাব-ভাবনা স্বভাবসুলভ ভাবে তুলে ধরতে ইচ্ছে হলো। কারণ সুরমাপাড়ে আমার ক্ষুদ্রমোতি নিবাস। আমি এও চিন্তা করে দেখেছি, আমার টিনের চালে রিমঝিমিয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সুরমার খরস্রোতে মিশে চাঁদপুর হয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত ম্যাসেজ দিয়ে মেঘনার কলকল স্রোত ধরে অবিরত সাগরে মিশছে। আমি চাঁদপুর মোলহেডে বসে সে ভাবনা থেকেই বাংলাদেশের বৃহত্তম, গভীরতম ও প্রশস্ততম নদী মেঘনাকে নিয়ে এ মানসিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি। এ লেখায় ভাবনা, ধারণা, তথ্য ও তত্ত্বগত কোনো ভুল থাকলে তা আমার নিজস্ব। সবসময় সে ভুল সংশোধনে আমি প্রস্তুত রইলাম।

নদী ও সাহিত্য সংস্কৃতি

নদী ইতিহাস রচনা করে। নদীর পানি সর্বধর্ম সর্বজাতির কাছে পবিত্র। 'জাতের মাইয়া কালোও ভালো, নদীর জল ঘোলাও ভালো' নদী নিয়ে কত কথা, রূপকথা, গল্প, সাহিত্য, কবিতা গান রচিত হয়েছে। এ গল্প, গান, কবিতা এতদ্অঞ্চলের মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়। কত কবি, সাহিত্যিক, লেখক তাদের শব্দশিল্পে নদীকে নিয়ে এতোকিছু লিখেছেন তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। মানুষের কাজ-কর্ম, কথা, আচরণ, আনন্দ, বেদনা, বিরহে নদীর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে।

-আর কতকাল ভাসব আমি দুঃখের সারি গাইয়া, আমার জনম গেল ঘাটে ঘাটে ভাংগা তরি বাইয়া রে আমার ভাংগা তরি বাইয়া----

-মাঝি বাইয়া যাওরে, অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাংগা নাও রে মাঝি বাইয়া যাও রে--

-কল কল ছলছল নদী করে টলমল ঢেউ ভাংগে ঝড় তুফানেতে-নাও বাইওনা মাঝি বিষম দইরাতে--

-নদীর কুল না-ই কিনারা না-ই রে---

-মেঘনা নদীর পূর্ব পাশে ঐ সুন্দর একটি গ্রাম, আমার মনটা কাইরা নিল বলব না তার নামণ্ড-

-ওরে মেঘনা নদীর তীরে, সাঁঝের বেলা যখন আমার ডিঙ্গি নৌকা ভিড়ে--

-পানি টলমল মেঘনা নদীর কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে-ঋণ আছে--

-এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা এই সুরমা নদীর তটে--

-মেঘনা নদীর তীরে, গেরাম বদরপুরে--

-দে দে পাল তুলে দে-- মাঝি হেলা করিস্ না, ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনা--

-আমি মেঘনা নদীর মেয়ে, আমার মেঘনা পাড়ে বাড়ি, ইচ্ছে হলেই এপাড় থেকে ওপারে দেই পাড়ি--

-নাইয়া-রে, নায়ের বাদাম তুইলা, কোনদেশে যাও চইলা--

-শোন মা আমিনা রেখে দে রে কাজ ত্বরা করে মাঠে চল,

এল মেঘনার জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল--

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি আল মাহমুদ, শিল্পী আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দীনসহ অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক তাদের গান কবিতায় মেঘনার কথা, নদীর কথা তুলে ধরেছেন।

মেঘনা আমায় অবাক করে

এক সময় নদী পার হতে হতো বৈঠা চালিত গোদারা/খেয়া (মাঝারি আকারের ছইয়া বিহীন নৌকা) দিয়ে, এখন সে স্থান দখল করেছে স্পিডবোট, যন্ত্রচালিত ট্রলার। বঙ্গোপসাগর হয়ে মেঘনা উপকূল বেয়েই একসময় পর্তুগীজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, বৃটিশসহ ইউরোপীয় বণিকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে বাংলাদেশে এসে দুশো বছর শাসন ও শোষণ করে যায়। বণিক বা জমিদাররা বজরা বা পালতোলা নৌকায় দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস ভ্রমণ করে দূর-দূরান্ত গন্তব্যে যাওয়া-আসা করতেন। হাল আমলে তিন বা চার তলাবিশিষ্ট দ্রুত গতির তাপানুকূল ক্যাবিন, থ্রি-স্টার মানের রেস্টুরেন্টসহ জলযানে স্বল্প সময়ে আন্তঃজেলা যোগাযোগ, যাতায়াত সহজলভ্য। যেমন : ঢাকা টু চাঁদপুর, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা, বরিশালসহ অন্যান্য জেলায় আধুনিক বিশাল জলযান মেঘনার বুকচিরে অবিরত চলছে। এক সময়ের সবচেয়ে আতঙ্কের নদী ভ্রমণ এখন অনেকটা সৌখিন ও আনন্দদায়ক ভ্রমণে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত জাহাজের বিশালতা ও আধুনিকতাতো অবাক করার মতো। নৌপথের সবচেয়ে কম খরচে যাতায়াত, পণ্য পরিবহন মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যবসায়িক জীবনে গতি এনেছে। আমার মতো, যারা সুরমা কুশিয়ারা বা তিতাসের মতো ঐতিহ্যবাহী অথচ ভোলা, বরিশাল অঞ্চলের নাম বা স্মারকবিহীন খালের মতো স্বল্প প্রশস্ত নদীতে ছোট বারকি নৌকা চড়ে অভ্যাস, তাদের জন্যে লোয়ার মেঘনা বুকের বহুতলবিশিষ্ট বিশাল জলযান হঠাৎ করে দেখলে অবাকতো হতেই হবে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে বিশাল কার্গো জাহাজ মেঘনার বুক বেয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে স্বল্প সময় ও খরচে সহজে পণ্য পরিবহন করে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো শুধু নদীপথেই সম্ভব। উদ্যোক্তাদের সাশ্রয়ী অর্থ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান জিডিপিতে অবদান রাখছে। পবিত্র কোরআন পড়লেও আপনি এমন জলযানের কথা পাবেন-

‘আর তাঁর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে পর্বতসদৃশ সাগরে চলমান নৌযানসমূহ। তিনি চাইলে তো বাতাসকে থামিয়ে (বা ঘূর্ণি ঝড়ে পরিণত করে) দিতে পারেন এবং জাহাজগুলো দরিয়ার বুকে নিশ্চল (বা বিকল) হয়ে থাকতো। (সুরা আশ্ শুরা-৩২-৩৩)

রূপালী ইলিশ ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিসোপান

রসনাবিলাস বা স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টি, রূপের গুণই বিশ্বব্যাপী মেঘনার ইলিশের সুনাম ও ঐতিহ্য বহন করে না। বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, রূপালি ইলিশ হতে পারে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

দেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে, যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের যেটুকু রপ্তানি হয় তাতে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ৩০-৩৫ লাখ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে ইলিশ নিয়ে নানা শঙ্কাও থাকতে পারে। দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও আগামী দিনগুলোতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা গবেষণা ও উদ্যোগ জরুরি। শুধু কি তাই, মেঘনা তীর ও বেসিনে অসংখ্যা চর, হাওর বাঁওড়, বিলে কৃষি ও মৎস্য চাষে জেলে নামক জলচাষী বা জলশিল্পী হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

মেঘনাকূলে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য

সুরমা-কুশিয়ারা বেসিন, কুলিয়ারচর, ভৈরব অঞ্চল অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা মিলনকেন্দ্রের আশপাশের জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি হাওর-বাঁওড়, বিল এবং বিভিন্ন নামে জলাভূমির অবস্থান। বাংলাদেশে খাদ্য ভা-রের উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এতদ্অঞ্চলে উৎপাদিত হয়ে থাকে। তাছাড়া দেশীয় শত প্রজাতির ছোট-বড় সুস্বাদু মাছ, সরীসৃপ, কাঁকড়াসহ দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রবিশেষে অভয়াশ্রম রয়েছে। কৃষি অর্থনীতি, ইকোলজিকাল ব্যালেন্স মূলত আপার মেঘনা বেসিনের প্রাকৃতিক পানি ব্যবস্থাপনারই ফল। মেঘনা বেসিনের হাওরগুলোর নাম এবং অবস্থান অনেকটা নিম্নরূপ-

নিকলী হাওর-২২,০৫৬ একর, কিশোরগঞ্জ; টাঙ্গুয়ার হাওর-৯০,৭২৭ হেক্টর, সুনামগঞ্জ; ডাকের হাওর ও তল্লার হাওর, কিশোরগঞ্জ; নলুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ; পচাশোল হাওর, সুনামগঞ্জ; বাড়ির হাওর, কিশোরগঞ্জ; মইয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ; মাকার হাওর, মাহমুদপুর হাওর, কিশোরগঞ্জ; রায়েরগাঁও হাওর, সিলেট; শনির হাওর, সুনামগঞ্জ; সুরমা বাউলার হাওর, কিশোরগঞ্জ; সোমাই হাওর, কিশোরগঞ্জ; হাইল হাওর, মৌলভীবাজার; শ্রীমঙ্গলের হাকালুকি হাওর-১৮,১১৫ হেক্টর, মৌলভীবাজার; হুমাইপুর হাওর, কিশোরগঞ্জ।

মেঘনাপাড়ের ব্যবসা ও বন্দর ব্যবস্থা

বিশেষ করে বৃটিশ আমল থেকে মেঘনা নদীপথগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। নদী পথগুলো তুলনামূলক প্রাকৃতিক ও সহজ, পরিবহন খরচ কম হয়, নদীগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন সহায়ক, অনিন্দ্য সুন্দর ও উপভোগ্য প্রকৃতি, সহজলভ্য কৃষি সেচ, ঝিনুক আহরণ, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, পাথর উত্তোলন ও বালি উত্তোলনের উৎস।

মেঘনার তীরে প্রসিদ্ধ জেলাগুলো হলো : সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, ভোলা, চাঁদপুর, বরিশাল প্রভৃতি।

মেঘনা অববাহিকায় উল্লেখযোগ্য নৌ ও বাণিজ্যবন্দর হলো : ভৈরববাজার, কুলিয়ারচর, কালুপুর, পুরাতন চাঁদপুর, মারকুলী, আজমীরিগঞ্জ, মাদনা, বৈদ্যের বাজার ও রামদাসপুর।

কুলিয়ারচর পৃথিবীর অন্যতম মৎস্য বাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা ও আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেসরকারি দেশ এনার্জি এ মেঘনা তীরেই অবস্থিত। মেঘনা অববাহিকার জেলা ও নদীবন্দরগুলোতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় একই সাথে লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

ঢাকার সুপেয় পানি ও ভবিষ্যৎ মেঘনা

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ঢাকাবাসীর পানির বিকল্প উৎস হিসেবে মেঘনা নদীর সম্ভাবনা যাচাইয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও দূষণের প্রেক্ষিতে রাজধানীর বর্তমান খাবার পানি সরবরাহের নাজুক অবস্থা তুলে ধরেছে।

এডিবি ‘মেঘনা নদী সুরক্ষা : ঢাকার জন্য একটি টেকসই পানির উৎস’ শীর্ষক ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে মেঘনা নদী কী কী হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তা তুলে ধরে নদীটি যেনো একটি টেকসই ও নিরাপদ খাবার পানির উৎস হতে পারে, তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঢাকার আশপাশের ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ব্যাপকভাবে দূষিত এবং বর্তমান চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানি শহরটির ভূ-গর্ভে নেই। অধিকন্তু ইতোমধ্যেই পানি সংকটে বিপর্যস্ত শহরটিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পানির চাহিদার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

সৌভাগ্যজনকভাবে মেঘনা নদী পানির এই উৎসের একটি টেকসই সমাধান। নদীটি ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। আগামী বছরগুলোতে এখান থেকে ঢাকার দুই কোটি বাসিন্দার পানির চাহিদার ৪০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পানিকে দূষণ থেকে রক্ষা ও পানির গুণগত মান বজায় রাখতে মেঘনা নদীতে সরকারের জোরালো পর্যবেক্ষণ ও বিধিনিষেধ আরোপের পরামর্শ দিয়েছে এডিপি।

খরস্রোতা মেঘনায় মিশেছে কত নোনা আঁখিজল

‘নদী এ পার ভাংগে ওপার গড়ে, এইতো নদীর খেলা, সকাল বেলার আমীর তুমি ফকির সন্ধ্যা বেলা’।

কত জনপদ মেঘনাবক্ষে বিলীন হয়ে কত মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। এর রাজসাক্ষী প্রায় চারশত বছরের ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের ধারক চাঁদপুরের পুরাণবাজার। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যের ধারক ব্যবসায়িক কেন্দ্র পুরাণবাজারের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মেঘনার গহীন পেটে বিলীন। আর কত শত বা হাজার নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ মেঘনার রাক্ষুষে পেটে আরোহীসহ ডুবেছে, কত বাবা, কত মা, কত স্ত্রী-সন্তানের চোখের নোনাজল মেঘনার পানিতে একাকার হয়ে সাগরের নোনা পানিকে নোনা থেকে নোনা করেছে, এর সঠিক হিসাব কে-ই বা রাখবে? নিচে এরই কয়েকটি চরম বেদনাবিধূর ঘটনা তুলে ধরা হলো, যে দুর্ঘটনায় বার বার আকাশ বাতাস ভারী হয়েছিলো--

২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মতলবের ষাটনলে মেঘনা নদীতে ‘এমভি জলকপোত-এর সাথে সংঘর্ষ ঘটে প্রাণ হারায় ১৬২ যাত্রী।

২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনলে মেঘনায় ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের লঞ্চ, মৃত্যু ঘটে ৩৬৩ যাত্রীর।

২০০৩ সালের ৮ জুলাই ‘এমভি নাসরিন-১’ মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনস্থলে দুর্ঘটনা কবলিত হলে সরকারিভাবে ৬৪১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে লাশ উদ্ধার করা হয় প্রায় ৮০০।

২০০৪ সালের ২২ মে আনন্দ বাজারে ‘এমভি লাইটিং সান’ দুর্ঘটনায় ৮১ জন এবং ‘এমভি দিগন্ত’ ডুবির ঘটনায় শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ভৈরবের মেঘনা নদীতে এমএল মজলিসপুর ডুবে ৯০ জনের মৃত্যু হয়।

২০০৬ সালে মেঘনা সেতুর কাছে ‘এমএল শাহ পরাণ’ দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা যায়।

২০১১ সালের ২৮ মার্চ চাঁদপুরের বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় মেঘনা নদীতে দুটি লঞ্চের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় এমভি কোকো-৩ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ।

২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ ডুবে যাওয়ার পর অন্তত ২২ জন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা নদীর বেলতলা খেয়াঘাট এলাকায় বালুবাহী একটি কার্গোর ধাক্কায় এমভি গ্রীন লাইন-২ লঞ্চের তলা ফেটে যায়।

২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা নৌ-পথের মেঘনা নদীর চাঁদপুর সংলগ্ন মাঝ কাজীর চর এলাকার মাঝ নদীতে দুই লঞ্চের সংঘর্ষে দুই যাত্রী নিহত এবং আটজন আহত হয়।

এমন ছোট-বড় ট্রাজেডি মেঘনার বুকে অহরহ ঘটে যাচ্ছে, অধিকাংশগুলোর খবর নীরবে-নিভৃতে ইথারে মিলিয়ে যায়, দেশ জনতা জানার আগেই।

সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় আমার মনে হয়, মেঘনা শুধু একটি নদী নয়, এটা নিজেই একটি আল্লাহর অপার দান, দেশ ও সমাজহিতৈষী প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান। মেঘনার বুকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন মেঘনা বাংলাদেশের গভীরতম ও প্রশস্ততম নদী, একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, রূপালি ইলিশের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম, দেশীয় সুস্বাদু মাছের অনিঃশেষ ভাণ্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্যের চিরন্তন যোগসূত্র, লক্ষ মানুষের রুটিরুজির উৎস, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসাকেন্দ্র, কৃষি উৎপাদনের সূতিকাগার, পরিবেশ সংরক্ষণকেন্দ্র, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির আধার, একই সাথে দুঃখ, বিরহ, বেদনার চিরন্তন সাক্ষী। তাই মেঘনাকে আমি শুধুমাত্র একটি নদী বলতেই রাজি নই, এটাকে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি মনে করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়