প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
যে নববধূ নাক ফুল হারায়, খুঁজে খুঁজে অস্থির হয় চক্ষুযুগল। নাকফুল স্বামীর মঙ্গল প্রতীক। তাই তন্ন তন্ন করে খুঁজে চৌদিক। কোথাও হদিস মিলে না। নেপালের মা দিশেহীন ঘুরে চেনা-অচেনা হরেক পথে। পুত্রশোকে পাথর হয় দিনদিন। সময় গড়িয়ে যায়, কোথাও মিলে না খোঁজ। নেপালের বাবা যগিন্দ্র বিনোদনপ্রিয় মানুষ। বিশেষত যাত্রাপালা। যাত্রাপালার বেলায় খরচের চিন্তা মাথায় রাখে না। একদম হাত খোলা। পুত্র বাড়ি ফিরেনি সেদিকে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যদিও গণ্ডির মধ্যেই ছেলেকে খোঁজে যগিন্দ্র। যাত্রাপালায় হাজার হাজার মানুষ। হাজার মুখের মাঝে কখন উঁকি মেরে উঠে প্রিয় মুখ। এ ভাবনায় এখন আর যাত্রাপালায়ও মন বসে না। দিনদিন ছেলের মুখ ঝাপসা হয়ে উঠে। যেন কল্পনায় আঁকা হাজার বছরের নগরী। কল্পনা মুহূর্তেই স্বরূপ বদলায়। মরে যাওয়া প্রিয়জনের মুখ ভুলে যায় মানুষ। মনেও রাখে না। যেখানে লেনদেন দেনা-পাওনা থাকে না, সেখানে প্রাচীন স্থাপত্য থিতু হয় বিনা কারণ।
কিশোর নেপাল বৈদ্য। একদিন সে ঘরহারা পাখির মতো উড়ে যায়। কোথাও খোঁজ নেই। আর ফিরে না। দিনেদিনে অদৃশ্যে ফিরে যায় বহু স্বজন। আপন-অতি আপন। পঙ্গপালের দল ভেসে আসে। বাড়ে ডেঙ্গুর উপদ্রব। মহামারি করোনার হানায় দিশেহারা পুরো পৃথিবী। বাতাসে ভেসে বেড়ানো জীবন বেছে নিয়েছে নেপাল? নাকি ‘রাত বাড়ছে, হাজার বছরের সেই পুরানো রাত’ জহির রায়হানের ক্ষণকাল। মানুষ মাটি হয়। মাটি মানুষ। নেপালকে ভুলে যায় সবাই। অথচ লাল পাতার অরচারা যৌবন ভাসিয়ে দেয় খোলা আকাশে। নেপালের হাতে রোপা ত্রিশফুট লম্বা গাছে বিশুদ্ধ পানিওলা সবুজ ফল ঝুলে থাকে। তরতাজা যুগ গাছগুলো পাহারায় দিয়ে রাখে। কিছু ফল ব্র্রাউন রং ধরে।
রাত যতোটা দীর্ঘ হয় আমার ভালো লাগা আজ তারায় ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাতে আমার নেপাল হতে ইচ্ছে করে। হারিয়ে যাওয়া চরিত্র আমায় জড়িয়ে ধরে পরম মমতায়। অথচ নেপাল চরিত্র কেউ নিতে চাইবে না। এ চরিত্রে এক ফোঁটা আলো নেই। যেটুকু আলো সবটুকু কেড়ে নেয় অগাধ বিশ্বাস। যে রাত ভালোবাসে, নেপালের বিবর্ণ চরিত্র চুম্বকের মতো টানবে। জোছনাবিলাসীদের নিকট বিদঘুঁটে অথবা হতাশার চরিত্র নেপাল।
নেপাল বাড়ি ফিরেছে। বাড়ির মানুষ চমকে উঠে। এটি স্বপ্ন না সত্যি? ঠাকুর মা এসে গায়ে চিমটি আঁকে। বাড়ির সবাই ছুটে আসে। গায়ে হাত দেয়। মাথায় হাত বুলায়, মিহি চুলগুলো নির্লজ্জের মতো পূর্বের স্থানে ফিরে যায়। সেই মুখ, গায়ের রঙ সবতো ঠিকই আছে। শুধু গায়ে গতরে বড় হয়েছে। ঠাকুর নেপালকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সে কী কান্না! নেপাল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার কাছে সব অদ্ভুত লাগে। বাড়ির মানুষগুলো এমন করছে কেন? সে ভেবে পায় না। মা-বাবা আসে না কেন? সবাই এসেছে, ঠাকুর মা, জেঠি মা, বিনোদ, অনিমা, হরিপদ কাকা ছোট ছোট বাচ্চারা। কিন্তু নেপাল যা খোঁজে তা তো নাই। এক সময় নেপাল কান্নায় ভেঙে পড়ে। সবাই সান্ত¡না দেয়। বাড়ির পূর্বদক্ষিণ কোণের শ্মশানে গিয়ে চিতা দেখে। চিতার উপরে কাঁচা মাটি লেপে দেয়া হয়েছে। চকচক করছে যেন। গতকাল ঠাকুরমা লেপে দিয়েছে। দুই খণ্ড মাটির নিচে বাবা-মা ঘুমিয়ে। সে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু সত্য মেনে নিতে হয়। সত্যের বিরুদ্ধে অভিমান করা যায়। ক্ষাণিক প্রতিবাদ। বিনিময় শূন্য। তাই মেনে নিতে বাধ্য হয় মানুষ।
পরদিন সন্ধ্যা রাতে বাড়ির ছাদে বিছানা পেতে বসেছে। যেন গ্রামীণ সালিস বৈঠক। না সবাই নেপালের ফিরে আসার গল্প শুনতে চায়। নেপাল হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজে আনে। আর একটা একটা করে টুকিয়ে নেয় সবাই। নেপালের কোনো কথা কেউ অবিশ্বাস করে না। শুধু একটা বিষয় আরো উদাম করে জানতে চায়। মেয়েটা কে? নেপালের সাথে কেন এসেছে? প্রশ্নগুলো আওড়াচ্ছে সবার মুখে।
মাড়ঝরা ভাতের হাড়ির ঢাকনা সরালে যেমনি কুয়াশা উড়ে, নেপাল সব খোলাসা করে তেমনি। সেদিন কেউ একজন বললো, তার সাথে যেতে। আমি যেতে চাইনি। আমি তাকে চিনি না। বারবার বললাম, আমি যাবো না। লম্বা পাঞ্জাবি ওলাদের মতো দেখতে। লোকটা যখন আমার ঘাড়ের ওপর হাত রাখলেন, আমি সব ভুলে গেলাম। স্মৃতিভ্রষ্ট হলাম। তারপর থেকে আর কিছু মনে করতে পারিনি। পরদিন ভোরে আমাকে আগরতলা শহরের একটি স্ট্রীট থেকে তুলে নেয় হারাধন কাকা। তিনি দ্যুতির বাবা। জন্মের বছরের মাথায় দ্যুতির মা মারা যায়। ঘরে সৎ মা আসে। পৌরসভার সুইপারের কাজ করেন হারাধন কাকা। একটা পথের মানুষ আমাকে কেন তুলে নিলেন জানি না। কে আমি, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, এমন ডজনে ডজন সওয়াল করা হলো। আমি একটারও উত্তর দিতে পারিনি। আমি কিছুই মনে করতে পারিনি। মানুষতো কতো কিছুই ভুলে যায়। ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। প্রাণহীন ডাকাতিয়া নদীও ভুলে যায় একদিন সেও ছিলো খরস্রোতা। আমি আমার নামও ভুলে গেলাম।
দিনে দিনে বছর হয়। বদল হয় সরকার। মানুষ দিনদিন আত্মকেন্দ্রিক হয়। কোয়ারেন্টাইনে ঢুকে যায়। গালভর্তি পশম গজায় আমার। বয়স বাড়ে। মাঝে মাঝে হারাধন কাকার সাথে কাজে যাই। কিন্তু কাজ ভালো লাগে না। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। একদিন কাকা অসুস্থ হলেন। দ্যুতিকে আমার হাতে তুলে দিয়ে তার যত্ন নিতে বললেন। কাকা চলে গেলেন। যেখান থেকে মানুষ আর ফিরে না। দ্যুতির সৎ মা আমাদের থাকতে দিলেন না। আমি আঘাত পাই। বুকের ভেতর খুব দাহ হতে থাকলো। পলিথিনে আগুন দিলে যেভাবে পোড়ে। ঠিক সেভাবে আমি পুড়তে থাকি। দহনে আমি ছাই হই। গলে যাচ্ছি। তারপর হাঁটতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি দ্যুতি আমার পিছে পিছে হাঁটছে। আমি তাকে নিয়ে কোথায় যাবো? ধীরে ধীরে আমার সব মনে হতে থাকে। আমি, আমার অতীত বর্তমান সব। প্রকৃতির খেলাইতো এমন। প্রকৃতির খেলায় স্বকীয়তা না থাকলে বেমানান ঠেকে। তারপর আগরতলা থেকে বাড়ি ফিরেছি। নেপালের কথা শুনে সবাই সমস্বরে বলে উঠে হরিবল। বলহরি। যাক, তবুও ভগবান বাড়ির পোলা বাড়ি ফিরাইয়া আনছে। এটাই বড় কথা। একটু দম নিয়ে নেপাল আবার বলতে থাকে, বাড়ি এসে দেখি আমি আর দ্যুতি এক পৃথিবীর মানুষ। ওর নাম দ্যুতি। অথচ আলোহীন। ছায়াহীন। ওর কেউ নেই। দ্যুতি মাটি রঙা মেয়ে। খুব ভালো।
বাড়ির সবাই দায়িত্ব নিয়ে নেপাল দ্যুতির বিয়ে দেয়। দ্যুতি মা হয়। মা হতে গিয়ে...। ছেলেটা যেন রাজপুত্র। নাম রাখা হলো বিশ্বজিৎ। এতোই সুন্দর যেন কোনো চিত্রশিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম। সবাই ভালোবাসে বিশ্বজিৎকে। মা মরা ছেলেকে সবাই একটু বেশিই আদর করে। সবাই নেপালকে আবার বিয়ে করতে বলে। কিন্তু নেপাল দ্যুতির আলো নিয়েই থাকতে সংকল্প করে। দিশাহীন জীবনের মানে খুঁজে পায় না নেপাল। বাবা মায়ের স্মৃতি মলিন হলেও দ্যুতির স্মৃতি কচি লাউয়ের ডগার মতো ঝুলে থাকে। যেন মাচার নাগাল পায় না। মাথায় গালে শরীরের পরশ বুলায়। ছেলেটা বড় হয়। বড় হলেই হলো। দ্যুতির মতো একটা মেয়ে দেখে বিশ্বজিৎকে বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখে নেপাল। বিশ্বজিৎ ভুলে যায় তার মা নেই। আদরে আদরে বড় হতে থাকে সে। শুধু সন্ধ্যা হলেই বুকের চাপা কষ্ট উছলে পড়ে। ঘর অন্ধকার থাকে সারারাত। সব আলো ঢেকে যায় মায়ায়। মা ছাড়া একটা পৃথিবী কিভাবে চলে? বুকের প্রতিটি দেয়ালে ল্যাপ্টে থাকে বিষম ব্যথা। এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমপাড়ানি মাসি আছে বলেই হয়তো বেঁচে আছে বিশ্বজিৎ। মাসি তো মায়ের চেয়েও ভালো। তাই হয়তো।
বিশ্বজিৎ রোজ গভীর রাতে কাঁদে। গুমরে কাঁদে। চিৎকার দিয়ে কাঁদে না। বাবার ঘুম ভেঙে যাবে। বুকের ভেতর খুব কষ্ট হয়। বাবা জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। কিন্তু বিশ্বজিতের কান্না মাঝে মাঝে টের পায় নেপাল। কিছু বলে না। কি-ই বা বলবে? মায়ের অভাব কে পূরণ করবে তার। বাবা হিসেবে খুব বেশি মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে না। বিশ্বজিতের বয়স বার ছুঁই ছুঁই।
সেদিন রাতে একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি ছেলেটা। বুকের ব্যথা যেন খুব বেশি। তাই নেপাল কোলে করে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালে এতো রাতে ডাক্তার থাকে না। যে ডিউটি ডাক্তার আছে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম থেকে উঠে আসতে আসতে দশ পনের মিনিটতো লাগবেই। ততোক্ষণে বিশ্বের প্রাণ ছটফট করে নিরব হয়ে যাচ্ছে। নেপাল বুঝতে পারে। ডাক্তার এসে পাল্স দেখে না সূচক মাথা নাড়েন। নেপাল বুঝতে পেরে বুক ফাটা চিৎকার দেয়। কিন্তু ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করে না। কিন্তু সে চিৎকার গলার বাহিরে এলো না। কাঁধে করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। ঘরে ভেতরের খাটে শুইয়ে রাখে নেপাল। নেপালও যেন বাকরুদ্ধ। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। মাকে খুব মনে পড়ে। বাবা, হারাধন কাকা, দ্যুতি। বিশ্বজিৎতো চোখের সামনেই ঘুমিয়ে। বিশ্বজিৎকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নেপাল। চোখে এক ফোঁটা পানি নেই। শুধু একবুক কষ্টের পাহাড়। স্বপ্নরা কখন-সখন পরাজিত হয়।
ভোর নেমে আসে ধরায়। ঠাকুর মা রোজ বিশ্বজিৎকে ঘরের দরজায় এসে ডাকে। আজও ডাকে। সাড়া নেই। শব্দ নেই। নেপালের নাম ধরে ডাকে। টু শব্দও নেই। ঠাকুর মা ডাক-চিৎকার দিয়ে বাড়ির সব মানুষ জড়ো করে। ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সবাই। ছেলেকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নেপাল। বুকের উপর থেকে হাত সরাতে পারে না বিশ্বজিৎ। ঠাকুর মা নেপালের হাত সরায়। বিশ্বজিৎকে কোলে নেয়। কিন্তু নেপালেরও ঘুম ভাঙে না...