বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

(তৃতীয় পর্ব)

নব্বই সাল ছিলো বাংলাদেশের জীবনে আরেক নবজন্মের অধ্যায়। এ সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। আলকরণ এলাকায় বাসা হওয়ার কারণে আন্দোলনের উত্তাপ আমরা বাসা থেকেই টের পেতাম। বাসার অদূরেই ছিল চট্টগ্রাম সিটি কলেজ এবং শহরের হৃদপি- নিউমার্কেট এলাকা। মুহুর্মুহু মিছিল আর স্লোগানে আগুন ঝরে পড়তো রাজপথে। মাঝে মাঝে স্লোগান কানে আসতো, পুলিশ তুমি যতই মারো, ‘তোমার বেতন চারশো বারো।’ স্লোগান শুনেই বুঝতাম আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ঘন ঘন লাঠিচার্জ আর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতো। এ কারণে এ সময়ে এই স্লোগান তৈরি হলো। পুলিশ হয়ে গেলো সরকারের পেটোয়া বাহিনী। তখন পুলিশ কনস্টেবলদের বেতন রেশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ব্যতিরেকে ছিলো মাত্র চারশো বারো টাকা। অবশ্য তখন টাকার মূল্যমানও ছিলো অনেক। আলকরণ থেকে নিউমার্কেট আসতে পায়ে টানা রিকশায় লাগতো তিন টাকা। আজকাল ত্রিশ টাকায় এসে ঠেকেছে এ ভাড়া। অর্থাৎ প্রায় দশগুণ ভাড়া বেড়েছে। চট্টগ্রামের রিকশাচালকদের মধ্যে স্থানীয় খুব একটা বেশি ছিলো না। অধিকাংশই ছিলো মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গ এলাকার। কুড়িগ্রাম, রংপুর এসব অঞ্চলের। তবে বরিশাল বা দক্ষিণবঙ্গেরও ছিলো বেশকিছু সংখ্যক। প্রতিদিন রুটিন করে সিটি কলেজ থেকে মিছিল বের হতো। 'স্বৈরাচারের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে' এই ছিলো মূল স্লোগান। মাঝে মাঝে চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বড় বড় শোডাউন হতো। তখন পুলিশকে বেশ ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যেতো। আন্দোলনকে কীভাবে ঘনীভূত করতে হয় তা মহিউদ্দিন চৌধুরীর চেয়ে ভালো কেউ জানতেন না।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমার সন্নিহিত সহোদর ছোটবোন রূপা ছিলো সিটি কলেজ ছাত্রলীগের মহিলা সম্পাদিকা। তাদের সহশিক্ষার্থী জহির ছিলো তখন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। তার গ্রামের বাড়ি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। জিএস ছিলো নোমান। পুরো নাম সম্ভবত মুহাম্মদ নোমান লিটন। আমাদের আলকরণ এলাকা ছিলো সিটি কলেজ ছাত্রলীগের ঘাঁটি। বাকশালের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তারেক সোলায়মান সেলিম, ওসমান ভাই, মাকসুদ আলম বাবুল, কামাল ভাইয়েরা ছিলেন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন সময়ের ছাত্র সংসদ ও কলেজ ক্যাম্পাসের পদধারী সংগ্রামী তরুণ। কামাল ভাই ছিলেন জুঁই খেলাঘর আসরের একজন বড় ভাই। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ভালো ফুটবলও খেলতেন। তিনি দু'দুবারের মতো সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। ঊনিশশো আটাশি সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত সহযোদ্ধাকে রক্তদান করতে গিয়ে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতকারীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। ছোটবোনের বন্ধুদের বদৌলতে রাজনীতির অনেক খবর আমরা আগাম পেতাম। তাছাড়া আলকরণের গলির মুখে বাবার কর্মস্থান ছিলো বিধায় নিউমার্কেট মোড়ে পুলিশি তাণ্ডব কিংবা ছাত্রজনতার প্রতিবাদের আগুনের ঝাঁজ আমরা ঘরে বসেই পেতাম। নব্বইয়ের সেইসব গণআন্দোলনের সময়েই চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের সড়কদ্বীপের গোল চত্বরটিকে নাম দেওয়া হলো জিরো পয়েন্ট। এ ঘটনা অবশ্য ঢাকায় ঘটে যাওয়া স্বৈরাচারের তাণ্ডবেরই পরিণাম। ঢাকায় ঊনিশশো সাতাশি সালের দশ নভেম্বর বুকে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক', পিঠে 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক' সাদা রঙে লিখে নূর হোসেন নামে ঢাকার বনগ্রাম মোটর শ্রমিক লীগের এক রাজনৈতিক কর্মী মিছিলে আসে এবং পুলিশের গুলিতে সে সময় তাৎক্ষণিক নূর হোসেনসহ তিনজন নিহত হয়। ফলে ঢাকা জিরো পয়েন্ট হয়ে যায় শহিদ নূর হোসেন চত্বর আর চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এলাকার গোল চত্বর হয়ে যায় জিরো পয়েন্ট। এখন অবশ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বদান্যতায় এই জিরো পয়েন্ট চত্বরের নাম হয়েছে 'শহীদ কামালউদ্দীন চত্বর'। এটা অবশ্য সিটি কলেজ ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো।

এসএসসির ফলাফলের পর তখন অনেকেই কলেজ ভর্তির কোচিং শুরু করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমার এ ব্যাপারে কোন হুঁশ ছিলো না। তাই আমি কোচিং না করে বরং ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করার দিকে মন দিলাম। এর পাশাপাশি কোতোয়ালির মোড়ে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে বেসিক কম্পিউটার ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হলাম। কীভাবে কম্পিউটার ওপেন ও ক্লোজ করতে হয়, কীভাবে ইন্টারনেট চালাতে হয় এবং কীবোর্ড হ্যান্ডেল করতে হয় সেগুলোই শিখলাম। কিন্তু দুপুরের দিকে সময় তখন বেঁচে যেতো খুব বেশি। তাই কখনো কখনো মেলোডি কিংবা দিনারে গিয়ে এক টিকেটে দুই ছবি মার্কা বিনোদনেও ঢুঁ মেরেছিলাম। অবশেষে কলেজে ভর্তির ফরম বিতরণ শুরু হলে দল বেঁধে বন্ধুরা গিয়ে ফরম ফিলাপ করি। সে সময় ছাত্র-ছাত্রীদের ফরম ফিলাপের একটা বড় বিড়ম্বনা ছিলো গেজেটেড অফিসারের সত্যায়ন ও সিল মারা। ভর্তির ফরম জমা দেওয়ার সময় আমার ছবি সত্যায়িত না থাকায় আমাকে বাসায় আসতে হতো সত্যায়িত ছবি নিয়ে যেতে। কিন্তু বন্ধু উক্য চিংয়ের বাবা ক্য হ্লা চিং আংকেল আমাকে সেই বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার করেন। তাঁরা আমাদের একই বিল্ডিংয়ে প্রতিবেশী ছিলেন অনেকদিন। মিঃ পেরেইরাদের বিল্ডিংয়ে। আমরা ছিলাম দুই তলায় আর তাঁরা ছিলেন চার তলায়। পরে আমরা আলকরণ চার নম্বর গলিতে মেহের বিল্ডিংয়ে এসে পড়ি এবং তারা চলে যান পিকেসেন সাততলার সামনে। তিনি যে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন আমি তা ভুলে গিয়েছিলাম। উক্য চিংয়ের অভিভাবক হিসেবে তিনিও ফরম জমা দিতে যাওয়ার কারণে আমার কাজ সহজ হয়ে যায়। আমার পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে তিনি সত্যায়িত করে দেন আমি কিছু বলবার আগেই। ব্যস্। আমার কাজ শেষ। তখন ফরম ফিলআপ করতে গিয়েই জানলাম, আমার বন্ধুদের অনেকেই ‘কর্নিয়া’য় কলেজ ভর্তি কোচিং করছে। কেউ কেউ ‘প্রবাহে’ও যোগ দিয়েছে। ভর্তি কোচিংয়ের ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের নেটওয়ার্ক খুবই শক্ত। আমি নিজেকে যাচাইয়ের জন্যে একদিন কর্নিয়ার একটা ক্লাসে বসলাম। ক্লাসশেষে মনে হলো, অসুবিধা হবে না। তাই আর কোনো গাইড কিংবা কোচিংয়ের ধার ধারিনি। ওখানেই শুনলাম আমার আজকের দিনের প্রিয় মানুষ ডাঃ ও কবি ভাগ্যধন বড়ুয়ার কথা। তিনি নাকি খুব ভালো কেমিস্ট্রি ক্লাস নেন। যেদিন ভর্তি ফরম নিতে গিয়েছিলাম এবং ফরম জমা দিতে গিয়েছিলাম, সেদিন দেখলাম, টেবিল-চেয়ার বসিয়ে কলেজে আধিপত্য বিরাজকারী ছাত্র সংগঠনের গাইড বই বিক্রির মহোৎসব এবং তাদের পরিচালিত কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দেওয়ার বিজ্ঞাপন। আমার একটা ছবি তারা কেন যে চেয়েছিল তখন তা না বুঝলেও বছরখানেক পরে বুঝতে পেরেছি এই ছবি-বাণিজ্যের কাহিনী। তাদের কাছে জানা ছিলো কারা কারা বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে। এরা যে ভর্তি পরীক্ষায় টিকবে এটা নিশ্চিত জেনে তারা ছবি সংগ্রহের চেষ্টা চালাতো। পরের বছর কলেজ ভর্তি কোচিং শুরু করার জন্যে প্রচারপত্র বা প্রসপেক্টাস ছাপাতে গেলে এই সংগৃহীত ছবি ছাপিয়ে দাবি করা হতো, এই ছাত্র বা ছাত্রী তাদের প্রতিষ্ঠানে কোচিং করেছে এবং তাদের সাফল্যের হার বেশি। সুতরাং যত ছবি তত বাণিজ্য।

যে কলেজে আমি ভর্তির ফরম নিয়েছিলাম তা ছিলো চট্টগ্রাম কলেজ। কেবল এই একটা ফরমই নিয়েছিলাম। কেউ আমাকে অন্য আরেকটি কলেজের ফরম নিতেও বলেনি আর আমার মাথায়ও আসেনি। এই চট্টগ্রাম কলেজেই পড়ে গেছে আমার মেজদা ঊনিশশো আশি-একাশি সালে। চট্টগ্রাম কলেজের তোরণটি দৃষ্টিনন্দন ও শিল্পসমৃদ্ধ হলেও এর তাৎপর্য বাঙালির মনে কষ্ট এনে দিতো। কলেজের গেট ছিল 'এ. কে' বর্ণমালার আদলে যা দ্বারা আইয়ুব খানকে বুঝাতো। আঠারোশ ছত্রিশ সালে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও আঠারোশ ঊনসত্তর সালে এটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে রূপান্তরিত হয় এবং তখন থেকেই এটি চট্টগ্রাম কলেজ নামে পরিচিত হয়। ঢাকা কলেজের পরে এটি ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় কলেজ।

এটি শুরু হয় চকবাজারে কুড়ি একর জমি বরাদ্দ নিয়ে। তবে বর্তমানে কলেজের অফিসিয়াল পেইজে তা ছয় একর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পর্তুগীজ আমলের লাল দালানে এর কার্যক্রম শুরু হয়। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর জে সি বোস। উল্লেখ্য যে, ঊনিশশো চব্বিশ সালে অধ্যক্ষ শামসুল ওলামা সাহেবের আমলেই এই কলেজে সহশিক্ষা চালু হয়। ঊনিশশো একুশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম কলেজ এর অধীনে চলে যায়। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পার করে বর্তমানে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে। ঊনিশশো ঊনসত্তর সালে কলেজের শতবর্ষ উদযাপনকালে এটি নতুন এক তোরণে শোভিত হয়, যা ছিলো মূলত স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের নামের আদ্যাক্ষর। এর চুয়াল্লিশ বছর পরে অর্থাৎ দুহাজার বারো সালে এই গেইটটি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বরাদ্দে বর্তমান গেইটটি নির্মিত হয়। দুঃখের বিষয়, ঊনিশশো নব্বই-একানব্বই সালে আমাকেও 'এ-কে' অক্ষরের গেইটের নিচ দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়েছিলো। চট্টগ্রাম কলেজে বর্তমানে ষোলটি প্রাতিষ্ঠানিক ভবন আছে এবং পাঁচটি আবাসিক ভবন আছে। আমরা যে সময়ে চট্টগ্রাম কলেজে প্রবেশ করি, সেসময় অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর। তিনি ছিলেন কেমিস্ট্রির শিক্ষক। উপাধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর নূরুল হুদা। তিনি ছিলেন বোটানির শিক্ষক।

ভর্তি পরীক্ষায় কোথায় সিট পড়েছিলো তা এখন আর মনে নেই। তবে পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তেমন কোনো রোমাঞ্চ অনুভব করলাম না। ভর্তির পর আমার রোল নম্বর হলো একশো আটাত্তর। আমি পড়লাম 'বি' সেকশনে। যাদের বায়োলজি এবং গণিত কম্বিনেশন ছিলো তারাই মূলত 'বি' সেকশনে ছিলাম। যারা গণিত আর পরিসংখ্যান নিয়েছিলো কম্বিনেশনে, তারা পেলো 'এ' সেকশন। 'সি' সেকশনে ছিলো মিশেল কম্বিনেশন। কেউ কেউ বায়োলজি আর গণিত কম্বিনেশন আর কেউ কেউ ছিলো গণিত আর পরিসংখ্যানের। কয়েকজন মনে হয় বায়োলজি আর ভূগোলের কম্বিনেশনও ছিলো। ছেলেদের ইউনিফর্ম ছিলো সাদা শার্ট এবং যে কোনো রঙের প্যান্ট। অধুনা তা সাদা-কালো রঙে নির্দিষ্ট হয়েছে। মেয়েদের ছিলো সাদা এপ্রোন, সাথে দুপাশের দুই পকেটের উপরে সবুজ প্লেট।

কলেজের ক্যাম্পাসটি বেশ বড়। কলেজ চত্বরে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ আর পদার্থবিদ্যা বিভাগের মাঝখানে ছিলো কৃষ্ণচূড়া গাছ। সেই গাছের নিচে আমাদের অনেক বন্ধু-যুগল ভালোই সময় কাটাতো ইকিরি-মিকিরি কথা বলে। মূল প্রশাসনিক ভবন ছিলো টিলার উপরে। হলরুম থেকে শুরু করে ক্যান্টিন, কমনরুম, রসায়নবিদ্যা বিভাগ, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগ নিচে। তারও নিচে হলো দক্ষিণ দিকে প্রাণিবিদ্যা ভবন। রসায়ন ও বোটানি বিভাগের সামনে একটা মরা কুয়ো ছিলো। সেই কুয়ো নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। অনেকেই বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কুয়োতে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন্ত ফেলে পাথর চাপা দিতো। তবে এই কিংবদন্তির সত্যতা জানা যায়নি।

কলেজে যেদিন প্রথম ছাত্র হিসেবে ঢুকি সেদিন ছিলো অন্যরকম উত্তেজনা। স্কুলের বন্দীশালা থেকে কলেজের মুক্ত শিক্ষাঙ্গন। একই শ্রেণিকক্ষে সব পিরিয়ডের দিন শেষ। বরং এক ক্লাস শেষ হলে অন্য ক্লাসে যেতে হতো অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে। ক্লাসগুলো হতো লেকচার গ্যালারিতে। গ-একশ পনেরো, রবি-একশ পনেরো, পবি-একশো পনেরো, উবি-একশো পনেরো, প্রাবি-একশো পনেরো--এই ছিলো আমাদের ক্লাসরুম। এক ক্লাস শেষে আরেক ক্লাসে দল বেঁধে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা যেতাম যেন শান্তিনিকেতনের নিসর্গকে আপন করে নিয়ে। প্রতিটি ক্লাসেই পার্সেন্টেজ দেওয়া হতো। গ্যালারির দুইদিকে প্রথম তিন বা চার বেঞ্চে বসতো মেয়ে শিক্ষার্থীরা আর উপরের বেঞ্চগুলোতে বসতো ছেলে শিক্ষার্থীরা। স্কুলের ডোবা থেকে যেন ব্যাঙ এসে পড়লাম বিশাল সমুদ্রে। কাঁধে একটা জিন্সের ব্যাগ থাকতো। তাতে কয়েকটি খাতা, ইংরেজি, বাংলা আর গণিত বই ছাড়া কিছু নিতে হতো না। কোন কোনদিন কোন বইই নিতাম না। শুধু একটা খাতা ছাড়া। তখনও আমরা স্বৈরাচার মুক্ত হইনি। অক্টোবরে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিলো। চট্টগ্রাম কলেজ ছিলো শিবিরের কড়া অধীনে। ফলে কলেজের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল খুব একটা উজ্জীবিত ছিলো না। আমাদের বরণও তাই সে রকম মুক্তভাবে হয়নি। কেমন একটা আরোপিত বাধা সব সময় ছিলো চারপাশে। তবে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের আড্ডাটা জমতো ভালোই। অধিকাংশ সময়েই সাদা হাফ শার্টের সাথে জিনসের প্যান্ট পরেই ক্লাস করতাম। সুবিধা ছিল এই, কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হলে কলেজ ছাত্র নাকি আর কেউ তা বুঝা যেতো না। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়