প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
এক.
মনটা ভালো নেই কাসেমের। ইদানীং মন ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি থাকে। ছেলেটা ভীষণ অসুস্থ তার। কী করবে কিছু ভেবে পায় না সে। নিজের বলতে কিছুই নেই। বাপ-দাদার দেয়া জমি-জমা যা ছিল নদীর ভাঙ্গনে সব তলিয়ে গেছে। এখন অন্যের জমি বর্গা চাষ করে কোনোমতে পেট চালায়। যা পায় তা দিয়ে খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করে দেয়। নিজেদের একটা ঘরও নেই। অন্যের একটা খালি জায়গায় কোনো রকম প্লাস্টিক আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটা খুপরি ঘরে বসবাস তার। পাঁচজনের ছোটখাটো একটা সংসার। দুই মেয়ে, এক ছেলে আর বৌ মিলিয়ে নিজেসহ মোট পাঁচজন। ছেলেটা অসুস্থ বেশ কিছুদিন। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। গত দুইমাসে ওজন কমছে খুব দ্রুত। একবারে যেন হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেছে গত মাসের ৩ তারিখ। ডাক্তার কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছেন। কিন্তু ঔষধের যা দাম, সব ঔষধ কিনে আনতে পারেনি। হাতে যা কিছু টাকা ছিল ইতঃমধ্যে ফুরিয়ে গেছে। আসার সময় হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার বলে দিয়েছেন পারলে ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে। অনেকের কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছে কাসেম, ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যাবে এজন্য। কিন্তু কেউ ধার দেয় না কাসেমকে। কাসেম অন্ধকার দেখে দু-চোখে। চারদিকে যেন ঘোর অন্ধকার। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। অন্যদিকে ছেলের শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে।
দুই.
কাসেমের জমিতে এবার ভালো ফলন হয়েছে। দশ-পনেরো দিনের মধ্যে তার জমির ধান কাটা শুরু হবে। চারদিকে সোনালি ধানে একাকার। কাসেমের চোখে-মুখে সে কী আনন্দ! আনন্দ যেন আর ধরে না। এবার জমি থেকে অনেক ধান পাবে সে। যার কিছু বিক্রি করে ছেলেকে ঢাকায় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সে। ছেলে এবার ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে। এবার প্রায় ২৮ শতক জমি বর্গা করেছে কাসেম। জমিতে ধান বপনের সময় হাতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। গ্রামের মোড়ল জামশেদ মিয়ার থেকে কাসেম হাজার ত্রিশেক টাকা নেয় সুদে। প্রতি মাসে সুদ-সমেত কিস্তি আকারে টাকা পরিশোধ করার শর্তে। জামশেদ মিয়া এলাকায় খুব পরিচিত। যে কারো প্রয়োজনে টাকা দেয় সুদে। বলা যায় এটাই জামশেদ মিয়ার ব্যবসা। কোনো চাকুরি-বাকুরি নেই। এটা করেই চলে সে। পূর্বপুরুষও নাকি তা-ই করতো। শুধু গ্রামের না, এই এলাকার যারই টাকা দরকার হয় সবাই জামশেদ মিয়ার দ্বারস্থ হয়। জামশেদ মিয়াও হাত খুলে টাকা দেয়। পাঁচ হাজার চাইলে দশ হাজার টাকা দিয়ে দেয়। এর বদলে সময় শেষে তার চাই সুদণ্ডসমেত পুরো টাকা ফেরত। খুব লাভজনক ব্যবসা। আরও কিছু লাভও আছে। গ্রামের জমির মিয়াকে দুই বছর আগে কড়া সুদে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ দেয়। ঋণের টাকা সুদসহ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় জমির মিয়া। এ অপরাধে গত মাসে জমির মিয়ার বউকে ঘরের চার নম্বর বউ করে নিজের ঘরে নিয়ে আসে জামশেদ মিয়া। ছি-ছি পড়ে যায় গ্রামের ভেতরে বাহিরে। কিন্তু কেউ মুখ খোলে না তার বিরুদ্ধে। অনেকের মুখে শোনা যায়, শুধু এটাই না আরও কিছু কাজ করে সে। এলাকার বাজারের তোলা তোলে তার লোকজন। এলাকায় যাবতীয় মাদক সাপ্লাই দেয় তার পোষা-পালিত ছেলেরা। অনেকে এদের জামশেদ মিয়ার কুত্তা বলে গালি দেয়। তবে আড়ালে-আবডালে। কারণ কেউ বিপদে পড়তে চায় না। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলেই চরম বিপাকে পড়তে হয়। তাই কেউ খুব বিপদে না পড়লে জামশেদ মিয়াকে চটায় না। যে যার মতো নিজেকে বাঁচানোর ধান্ধায় ব্যস্ত। গতবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইলেকশন করে হেরে গেছে অল্প কয়েক ভোটের ব্যবধানে। গ্রামের হাইস্কুলের প্রবীণ শিক্ষক হানিফ স্যারের সাথে ভোটে হেরে গেছে। হানিফ স্যার ব্যক্তি হিসেবে অসাধারণ। স্যারের ব্যক্তিত্বের কাছেই মূলত হারতে হয়েছে জামশেদকে। তার অগাধ টাকা-পয়সা আর লোকবল থাকা সত্ত্বেও শুধু ব্যক্তি হানিফ স্যারের কাছে হারতে হয়েছে তাকে। তবে এখনো চেয়ারম্যান থেকেও তার ক্ষমতা বেশিই বলা চলে। আইন-কানুনকে পকেটে নিয়ে হাঁটে সে। নিজের সাঙ্গ-পাঙ্গরা এলাকায় যাবতীয় অপকর্ম করে বেড়ায়। নিজের পোষা কেউ আইনের মারপ্যাঁচে পড়লে টাকা-পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে আনে। ইলেকশনে হারার পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে সে। এমন কোনো হীন কাজ নেই যে সে করে না। তাই এলাকার সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। কেউ খুব প্রয়োজন না হলে জামশেদের ছায়াও মাড়ায় না।
তিন.
একদিন সকালে মাঠে যায় কাসেম। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে দেখতে পায় ধান ক্ষেতের আইলে। মেয়ে কাঁদছিল। আব্বা ভাইয়া ক্যামন জানি করতাছে। মা কইছে আপ্নারে তাড়াতাড়ি বাড়িত য্যাইতে। মাঠ থেকে মেয়েকে নিয়ে ফিরে কাসেম। কাসেমের বউ জমিলা কাঁদছে। সে কী কান্না! সামনে ছেলেকে উত্তর দিকে মাথা করিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কোনো নড়াচড়া নেই ছেলের। কাসেম মাঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই নাকি ছেলে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সেখান থেকে ধরাধরি করে একটা পুরাতন ছেঁড়া চাটাই বিছিয়ে তার উপর শোয়ায় ছেলেকে। জমিলা মাথায় জল ঢালে। ছোট মেয়ে মাকে পানি এনে দেয়। কিন্তু অনেকক্ষণ নড়াচড়া নেই ছেলের। বড় মেয়ে এখনো ফিরেনি স্কুল থেকে। স্কুল ছুটি হবে বিকেল চারটায়। ছেলের এমন অবস্থা দেখে কাসেম ছেলেকে কোলে করে একটা রিক্সায় তুলে নেয়। পিছু পিছু আসে ছোট মেয়ে আর বউ জামিলা। রিক্সা ছেড়ে দেয়। রাস্তার কোলঘেঁষে মা-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাসেমের লক্ষ্য উপজেলা হেলথ্ কমপ্লেক্সে। এখান থেকে উপজেলা হেলথ্ কমপ্লেক্সে যেতে সময় লাগে মিনিট চল্লিশেকের মতো। রিক্সা ছুটে চলে হাসপাতালের দিকে। জমিলা আর তার মেয়ে রিক্সার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকশা দ্রুত বেগে চলছে। কাসেমের কোলে শুয়ে আছে ছেলে। আরও জোরে চালাও ভাই, বলে কাসেম। ড্রাইভার রিকশার গতি বাড়িয়ে দেয়। আধা ঘন্টার মধ্যেই রিকশা পৌঁছে যায় হেলথ্ কমপ্লেক্সে। তড়িঘড়ি করে ছেলেকে রিকশা থেকে নামিয়ে ইমারজেন্সি বিভাগে নিয়ে যায় সে। দুজন নার্স ছুটে আসে। সাথে ডাক্তারও আসেন। ডাক্তার চেকআপ করে। ডাক্তারকে বিমর্ষ দেখায়। কাসেম মিয়া কিছু বুঝতে পারছে না কী হয়েছে, ডাক্তারকে দেখে মনে হচ্ছে, ছেলের মনে হয় বড় কিছু হয়ে গেছে। ডাক্তার সাব কিছু কন, কী হইছে আমার ছেলের? ডাক্তারের কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি কাসেম। ডাক্তারের কথায় বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় কাসেম। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। তার ছেলে যে আর নেই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কাসেম। কী করবে কিছু ভেবে পায় না সে। বউকে গিয়ে কী বলবে সে। শুধু টাকা ছিল না বলেই বড় ডাক্তার দেখাতে পারেনি ছেলেকে। মন ভীষণ খারাপ হয় তার। একমাত্র ছেলে মারা গেছে। কী কষ্টই না পেয়ে মরেছে ছেলেটা। বাবা হিসেবে নিজেকে দোষী মনে হয় তার। নিজেকে ব্যর্থ বাবা মনে হয়। এমন বাবা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। মৃত ছেলেকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে কাসেম। তার দু-চোখে অশ্রু। নিজের ছেলের লাশটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী লাশ মনে হচ্ছে কাসেমের। রিক্সা এগিয়ে চলছে বাড়ির দিকে। আর কাসেম লাশ কোলে নিয়ে নির্বাক বসে বসে শুধু অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।
চার.
ছেলের মৃত্যুর দুইদিন পর কাসেমকে ডেকে পাঠায় জামশেদ মিয়া। কী খবর কাসেম? তোর যে কোনো খোঁজ-খবর নাই। আমার টাকাতো এখনো পুরো শোধ করতে পারোস নাই। একুশ হাজার টাকা শোধ করেছো মাত্র। ত্রিশ হাজার টাকায় তোর কাছে সুদসহ মোট ষাট হাজার টাকা পেতাম।
তোর কাছে সুদসহ আরো ঊনচল্লিশ হাজার টাকা পাই আমি। বাকি টাকা দিবি কবে? বলতে থাকে জামশেদ সাহেব।
সাব, আপনি তো জানেন খুব সমস্যায় আছি। টাকা যা নিছি পোলার পিছনে সব খরচ হইয়া গেছেগা। আপনার সব ট্যাকা দিয়া দিমুনে। আরও কয়ডা দিন সময় দেন আমারে। ধান পাকছে। ধান কাইট্যা কিছু টাকা শোধ দিমু। বাকি টাকা আস্তে আস্তে পরিশোধ কইরা দিমু। ছেলেটারে তো বাঁচাইবার পারলাম না। আরও কিছু টাকা পাইলে ঢাকা নিতে পাইরলে আমার পোলাডা মইরতো না। এই বলে কেঁদে দেয় কাসেম।
কাসেমের কথা শেষ না হতেই কথা বলে ওঠে জামশেদ। ফালতু আলাপ বাদ দে। কাজের কথা ক। টাকা দিবি কবে, সেইটা বল।
সাব, দিয়া দিমুনে সব ট্যাকা। আর কিছুদিন সময় দেন আমারে। উত্তর দেয় কাসেম।
তোর টাকা দেওন লাগবো না। তোর জমির সব ধান আমার লোকেরা কাইট্যা নিয়া আইবো। তোর কিচ্ছু করন লাগবো না। ধানের বদল অর্ধেক টাকা শোধ। বাকি টাকা তিনমাসের মধ্যে দিয়া দিবি। বলে ওঠে, জামশেদ।
কী বলেন সাব? তাইলে আমরা কী খামু। আ¤েœর লোকেরা ধান কাইট্যা নিয়ে গেলে আমরা কী করুম! আমি, বৌ আর মাইয়াগোরে নিয়া উপাস মরুম। এইডা কইরেন না সাব। কইলাম তো আ¤েœর ট্যাকা আমি শোধ কইরা দিমু। হাত জোড় করে মাথা নত করে বলে কাসেম।
তুই বেশি কথা কইতাসস। যেডা কইছি সেডাই হইবো। আমার কথার যেন নড়চড় না হয়। এখন এইখান থেইক্যা যা। আমার মেলা কাম আছে। এই ছুডন আমার পানটা দিতে ক তোর নতুন ভাবীরে। এই বলে জামশেদ মিয়া চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ায়।
বাড়ি চলে যায় কাসেম। বাড়ি গিয়ে বিষণ্ন মনে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বউ জমিলা কাসেমের মন খারাপের কারণ জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে? আরে কইয়ো না, জামশেদ সাব ডাইক্যা নিয়া বাকি সুদের টাকা চাইছে। কই থেইক্যা টাকা দিমু কও? কইলাম আরও কিছু দিন সময় দেওনের ল্যাইগা। কিন্তু না সময়ও দিবো না। উল্টা কইছে আমাগো সব ফসল নাকি তার লোকজন কাইট্যা নিয়া যাইবো। আইচ্ছা মন খারাপ কইরো না। একটা কিছু হইবো। এখন খাইতে আইয়ো। ম্যাইয়ারা বইসা আছে তোমার ল্যাইগা। ওরা তোমার লগে ছাড়া নাকি খাইবো না। অনেকক্ষণ হইছে জোহরের আজান দিছে। নামাজ পইড়া চাইরটা খাইয়্যা নাও আগে। পরে ভাবোন যাইবো কী করণ যায়। লাগলে আমিসহ সাবের কাছে আবার যামু। একটা কিছু তো অইবো। বলতে থাকে জমিলা।
রাতে জমিলা বেগম মোড়ল জামশেদ সাহেবের কাছে যায়। সাব আমাগোরে আরও কয়ডা দিন সময় দেন। আ¤েœর টাকা যে কোনোভাবেই শোধ কইরা দিমু আমরা। বলে কাসেমের বউ জমিলা বেগম।
জামশেদ সাহেব কিছুতেই রাজি না। বরং এই বলে শাসিয়ে দেয়, আমার কথা না শুনলে কিন্তু বিপদ আছে তোমাগো। পরে কিন্তু অন্যকিছু দিয়ে শোধ দেওন লাগবো আমার টাকা। জমিলা ভয় পেয়ে যায়। মনে পড়ে যায় জমির মিয়ার বৌয়ের কথা। যাকে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় স্বামী থেকে নিয়ে জামশেদ সাহেব নিজে বিয়ে করেছে। জমিলা বেগম আর কথা বাড়ায় না। তাড়াতাড়ি চলে যায় এখান থেকে।
পাঁচ.
দুই দিন পর মাঠে ধান কাটতে যায় কাসেম। সাথে ছোট মেয়েকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় জমিলা অনেক নিষেধ করেছে স্বামী কাসেমকে। যেন ধান কাটতে না যায় জমিতে। কারণ জামশেদ সাহেব যেহেতু নিষেধ করছে সেহেতু ধান কাটতে যাওয়া ঠিক হবে না তার। লোকটা ভালো না। কী করে বসে আবার! তার কথার বাহিরে গেলেই দুনিয়ার বিপদ। কিন্তু বউ জমিলার নিষেধ শুনে না কাসেম। সে মাঠে চলে যায়। জমিতে গিয়ে যেই না ধান কাটতে কাস্তে চালালো তার সাথে সাথে হাজির জামশেদ মিয়া। সাথে লোক দশেক। কারো হাতে কাস্তে, কারো হাতে আবার ধান কাটার ধারালো দা। তারা ধান কাটবে। কাসেমকে তারা ধান কাটতে দিবে না। কাসেমও গোঁ ধরে আছে অন্য কাউকে নিজের জমির ধান নিতে দিবে না। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। ক্ষেতে কাসেম একা। আর জামশেদ মিয়ার সাথে দশজন। কাসেম এর পরও চেষ্টা করে নিজের সোনালি ফসল রক্ষার। কিন্তু পেরে ওঠে না। কোনো উপায়ন্তর না দেখে যারা ধান কাটছিল তাদের সামনে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কাসেম। জামশেদ মিয়া আর মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। পাশে একটা দা দেখতে পায় সে। হাতে দাওটি নেয় জামশেদ। দা দিয়ে কোপ মারে সজোরে। দায়ের কোপ গিয়ে লাগে কাসেমের গলায়। কোপের তীব্রতায় দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায় কাসেমের। ঘটনার আকস্মিকতায় সবার চোখ ছানাবড়া।
কী হয়ে গেল এটা।
পুরো ধর লাফাচ্ছে। মাথাটা পড়ে আছে হাত তিনেক দূরে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ধান ক্ষেত। সোনালি ধান যেন এ রক্তের জন্যই এ বছর খুব করে জন্মেছিল। কাসেমের সাথে থাকা ছোট মেয়ে দৌড়ে গিয়ে কাসেমের বৌ জমিলাকে জানায়। দ্রুত ছুটে আসে কাসেমের বউ জমিলা। স্বামীর বিচ্ছিন্ন দেহ দেখে বিলাপ করছে জমিলা বেগম। ওমা, মাগো। এটা কী হইয়া গেলো গো। আমার স্বামীরে তোমরা বাঁচাওগো। আমার এখন কী হইবো গো। আমার মেয়েরা কারে বাপ ডাকবো গো। এরকম আরো অনেক কিছু বলে বিলাপ করছিল জমিলা। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে তার চিৎকারে। সাথে মেয়ে দুটিও কতক্ষণ মায়ের পা ধরে আবার কতোক্ষণ পড়ে থাকা বাবার লাশ ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। এতোক্ষণে জটলা বেঁধে গেছে। খবর পৌঁছে গেছে পাশের থানায়। মিনিট দশেকের মধ্যে ধান ক্ষেতে এসে যায় পুলিশ। জামশেদসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। সাথে করে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যায় কাসেমের লাশ।
ছয়.
কাসেমের মৃত্যুর পর ভালো নেই তার পরিবার। ঠিকমতো খাবারও জুটে না এখন। জমিলা আর তার দুই মেয়ে যেন বোবা হয়ে গেছে। মা মেয়েদের চোখে-মুখে রাজ্যের অন্ধকার। দিশেহারা তারা। কিভাবে বেঁচে থাকবে এ সমাজে। কে বা দেখবে তাদের! জমিলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েরা তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। তাদের চোখেও জল। কেউ কিছু বলছে না। শুধু অশ্রুমাখা নয়নে মা-মেয়েরা সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ হঠাৎ জমিলা শুনতে পায় জামশেদ সাহেবসহ বাকি সব আসামী জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য লাগে সব। সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এলাকার মানুষও যেন এতোদিনে ভুলে গেছে সব। সব কিছুই স্বাভাবিক। সামনের নির্বাচন উপলক্ষে জামশেদ সাহেব নাকি বিশাল জনসভা করেছে স্কুল মাঠে। আর জনগণ জামশেদ সাহেবকে মাথায় তুলে ধেইধেই করে নাচছে। সব কিছুই স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি এই এলাকায়। আর কাসেমের মৃত্যুতে জমিলার জীবনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। পাল্টে গেছে জীবন, জীবনের হিসেব। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ইতঃমধ্যে। অভাব-অনটনে মানবেতর এবং অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ায় জমিলা আর তার মেয়েরা...।