মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আমার লেখালেখি ও আমার অনুজরা...
অনলাইন ডেস্ক

আমার জন্ম ত্রিশের দশকে। তৎকালীন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কুমিল্লাতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে দেশ হয় পূর্ব পাকিস্তান। জেলার নাম একই থাকে। ভাষা, সংস্কৃতি, সবই এক থাকলেও দেশের প্রেক্ষাপট বছরে বছরে পরিবর্তন হতে থাকে। আমার লেখালেখি শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দেয়- তিন কোটির মানুষের দেশ পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনতাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। আমি তখন নবীন, বয়সে খুবই ছোট। ভাষার মাস ১৯৫২ সালের দিকে আমি তখন তৎকালীন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ময়ূরা হাইস্কুলের ছাত্র। বর্তমানে স্কুলটি নাঙ্গলকোট উপজেলার অধীন। ওই সময় স্কুলের আশেপাশেসহ আট-দশ গ্রামের বুঝার মত উঠতি ছেলেদের নিয়ে একটি ফোরাম করা হয়। এতে প্রায় সময় আসতেন কাজী জাফর আহমেদ, যিনি ১৯৯০ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। আসতেন ভিপি সাদেক হোসেন চেয়ারম্যান, যিনি লাকসাম কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৫৯ সালের ভিপি ও ১৯৭২ সালে নাঙ্গলকোট ইউনিয়ন পরিষদ (যা বর্তমানে পৌরসভায় উন্নীত)-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আসতেন আবদুল করিম মজুমদার, ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল ও আবদুল মালেক। কুমিল্লা শহরে গেলে পরিচয় হয় আরো অনেকের সাথে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যাডঃ আহমেদ আলী, অজিত গুহ। ওই সময় দেশের জনপ্রিয় ও জাতীয় নেতা হিসেবে আমরা চিনতাম আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আকরম খাঁ, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, অলি আহাদ, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমার বাবা ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেন নি। ময়ূরা হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে চলে যাই ঢাকা শাহজাহানপুর হাইস্কুলে। এসএসসি কমপ্লিট করার পূর্বেই বাবার পেশায় যোগ দিই। সাথে শুরু হয় লেখালেখি। লেখালেখি করতে গিয়ে পাকিস্তান আমলের পুরো সময়টা আমার ঢাকায় কাটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে বাবার মৃত্যুর কারণে আমি নিজ এলাকা নাঙ্গলকোটে চলে আসি ও নাঙ্গলকোট বাজারে নিজ শেখা ও পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পেশা স্বর্ণ ব্যবসা শুরু করি। এর আগে ১৯৫২-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্য ও লেখালেখির সাথে সংযুক্ত থেকে পরিচয় হতে থাকে নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিক ও রাজনীতির নতুন-পুরানো সকল মানুষের সাথে। শুধু মাত্র ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কাল কিংবা আমার বিয়ের বছরটি বাদ দিলে বাকি ২৬ বছরই টানা থেকেছি শহরটিতে। ওইসময় ক্রমাগত বদলাতে থাকে দেশের প্রেক্ষাপট। হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুন, আসাদ চৌধুরী প্রমুখের সাথে সাহিত্য আসরেই পরিচিত হয়েছি। ব্যবসার সাথে মনোযোগী হওয়ায় ও বর্তমান সময়ের মত মোবাইল, ফেসবুক ব্যবহার না থাকায় বেশিদূর সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে পারি নি। তবে যেটুকু নিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার বয়সে নবীন ও তরুণ লেখকরা এখনো ফোনে ও নাঙ্গলকোটের কালেম গ্রামের বাসায় এসে যোগাযোগ করছে, যা রীতিমত আমাকে আনন্দ দেয়। আমি অনেককে ফোন করতে পারি না, যোগাযোগ করতে পারি না। ঠিকমত লিখতে পারছি না। লেখাটিও একমাত্র অনুজ আজিম উল্যাহ হানিফের অনুরোধে লেখা। যা এডিট করছে সেই নিজেই। আমার ছোট ছেলে রাসেলের বয়স তার। তার জন্য আমার দোয়া ও ভালোবাসা সবসময়। আজিম ভালো থাকুক, ভালো কিছু করুক, এটাই আমার চাওয়া।

আমি এই জীবনে বহু লেখালেখি করেছি। সংগঠন করেছি। এখনো কয়েকটি সংগঠনের দায়িত্বে আছি, অন্যরা পালন করছে আমার দায়িত্ব। বই বের করেছি মাত্র দুটি। একটি উপন্যাস ’সাফল্যের সিঁড়ি’, যা ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় বইটি নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে। তারপর কেটে যায় অনেক বছর। যৌথ কাব্যগ্রন্থে ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখে গেলেও বই বের করা হয়নি। ২০১৮ সালে বেশ কিছু কবিতা বাছাই করে আজিম উল্যাহ হানিফের উৎসাহে মেলা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এম এস দোহার প্রকাশনী থেকে ‘কবিতায় বিশ্ব দেখি’ কাব্যগ্রন্থ বের করি। ৩ বছর আগে আমার সহধর্মিণী মৃত্যুবরণ করার পর তেমন একটা বাসা থেকে বের হতে পারি না। উপজেলা সদরের নাঙ্গলকোট বাজারের ৪ জুয়েলারি ব্যবসা ৪ ছেলে দেখাশোনা করে। আমি তাদের ও ডাক্তারের নিয়মমাফিক চলাফেরা করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, খাওয়া দাওয়া করি ও লেখালেখি করি। জীবনে শেষ প্রান্তে এসে ভালো লাগছে এই ভেবে যে, এই দেশের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-তিন শাসনামলই দেখতে পেরেছি। চোখের সামনে বহুজনকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী হতে দেখেছি। পত্রিকায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন। জড়িত ছিলাম লাকসাম লেখক সংঘের সাথে, সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই। দীর্ঘকাল সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। সংগঠনটিতে আসতেন নেভী নুরুল হক, সিরাজুল ইসলাম রাহী মিনু ও করুণ কুমার দেব রায়। সংগঠনটির প্রাণ ছিলেন ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল। আজকের সময়ে মানুষগুলো আর বেঁচে নেই। কিন্তু সাহিত্য আড্ডার স্মৃতিগুলো রয়ে গেলো। বছরের পর আড্ডা দিয়েছি ভাষাসৈনিক আবদুল জলিলের সাপ্তাহিক লাকসাম পত্রিকা অফিসে। অনুজ হিসেবে পরে সংগঠনটিতে যোগ দেন শিক্ষক মোঃ তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, আজিম উল্যাহ হানিফ, ফারুক শাহরিয়া, ফারুক আল শারাহ, তাসলিমা শাহনুর প্রমুখ। নাঙ্গলকোট বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি কয়েক সেশন। সংগঠন করেছি নাঙ্গলকোট প্রেসক্লাব, নাঙ্গলকোট সাংবাদিক সমিতি, নাঙ্গলকোট সাংবাদিক ফোরাম, নাঙ্গলকোট রাইটার্স এসোসিয়েশন, কুমিল্লা কবি ফোরাম, জাতীয় কবিতা মঞ্চ, জাতীয় সাংস্কৃতিক মঞ্চ। জাতীয় কবিতা মঞ্চ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি ছিলাম ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত। নাঙ্গলকোট রাইটার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলাম ২০১৪-২০১৭। নাঙ্গলকোট সাংবাদিক সমিতির ২০১৫-১৭ মেয়াদে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছি কুমিল্লা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় সাংস্কৃতিক মঞ্চ চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে। এছাড়াও আছি কুমিল্লা বিভাগ আন্দোলন কমিটিতে, লাকসাম জেলা বাস্তবায়ন কমিটিতে, নাঙ্গলকোট জেলা বাস্তবায়ন কমিটিতেও। এছাড়াও কিছু সামাজিক সংগঠনে রয়েছি উপদেষ্টা হিসেবে। নিয়মিত প্রোগ্রাম করি নাঙ্গলকোট, লাকসাম, কুমিল্লা প্রেসক্লাব, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ দেশের আনাচে কানাচে। আমার অনুজপ্রতিম নঈম নিজাম, সায়েম মাহবুব মজুমদার, দীপ্র আজাদ কাজল, মোঃ তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, হাসান হাফিজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শাহীন রেজা, ইমদাদুল হক মিলন, আল মুজাহিদী, জাহিদুল হক, মোশাররফ হোসেন খান, জাকির আবু জাফর, ড. আলী হোসেন চৌধুরী, আবদুল হালিম খা, রাশেদ রউফ, মাহমুদুল হাসান নিজামী, হেলাল হাফিজ, লতিফ জোয়ার্দার, ইমরান মাহফুজ, আবিদ আজম, আবদুল হাই ইদ্রিছী, মাহফুজুর রহমান আখন্দ, সীমান্ত আকরাম, আহমেদ ইউসুফ, আরিফুল হাসান, ফারুক শাহরিয়া, সাইফুল আনোয়ার স্বপন, মুকুল মজুমদার, প্রিন্সিপাল ইয়াসিন মজুমদার, ড. শায়খ হেদায়েত উল্লাহ, এইচ এম আজিজুল হক, রমিজ খান, গাজী মোহাম্মদ ইউনুস, আবদুল আউয়াল সরকার, আজাদ সরকার লিটন, আবদুল কাইউম আশিক, হাবিবুর রহমান হৃদয়, জহির শান্ত, গাজী জাহাঙ্গীর আলম জাবির, তাসলিমা লিয়া, রহিমা আক্তার মৌ, নুরুন্নাহার মুন্নি, লুৎফুন নাহার রহমান, জামাল উদ্দিন দামাল, জসীম উদ্দিন অসীম, মোহাম্মদ অংকন, নেসার আমীন, রফিকুজ্জামান রণি, আশিক বিন রহিম, তছলিম হোসেন হাওলাদার, শামছুল করিম দুলাল, ইয়াছিন আশরাফ, মাহমুদ কচি, জালাল খান ইউসুফী, আসলাম সানী, আফজাল হোসাইন মিয়াজী, রাশেদ রউফ, আইউব সৈয়দ, মোরশেদ আলম হৃদয়, রানা হাসান, মাহমুদা শিরীন, জায়েদ হোসেন লাকী, খোরশেদ মুকুল, মুসা বিন হাফিজসহ সকলকে শুভেচ্ছা। এরা সবাই ভালো লিখছেন। সবার জন্য শুভ কামনা। আরও নাম না জানা অনেকেই ভালো লিখছেন। এবারও বইমেলায় যাবো, অনেক নবীন-প্রবীণ লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের সাথে দেখা হবে, পুরানো আড্ডা দিবো ভাবতেই পুলকিত হই। ইতিপূর্বে অনেকেই গত হয়ে গেছে। তাদের লেখনী শক্তিগুলোই বাংলা সাহিত্যে পঠিত হওয়ার ফলে অনেকেই জীবিত আমার কাছে, তাদের সংস্পর্শ পাই আমার লেখনীতে, আমার কলমে, আমার চোখে, আমার টেবিলে, আমার খাতায়...।

আমি প্রায় ৩ শতাধিক গ্রন্থ লিখেছি। জানি না আমার জীবদ্দশায় কতখানি প্রকাশিত হবে। তবে আমি সকল বিষয়েই কম-বেশি লেখার চেষ্টা করেছি। আমার বেশি কষ্ট লাগে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, কথা বলেছেন, আন্দোলন করেছেন, মার খেয়েছেন, গুলি খেয়েছেন, ৫৩ সালে শহীদ মিনার তৈরির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন- ওই সকল মানুষের তালিকা আজো তৈরি হয়নি বলে। আমি নিজেই বেশ কয়েকবার ঢাকায় আহমদ রফিকের সাথে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু কোনোরূপ সুরাহা না হওয়ায় জীবনের অস্তবেলায় বেশ খারাপ লাগছে। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে হয়, কেননা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই...।

লেখক : এস এম আবুল বাশার, জন্ম : ৭ র্মাচ ১৯৩৫, বাসা : কালেমণ্ডকেশতলা, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা। ফোন : ০১৯২০-৯৮৯০২৮

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়