মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

চোরের বয়ান
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের জীবনে প্রচলিত কিছু কিছু প্রবাদ বা প্রবচন যুগের সাথে আর খাপ খায় না। এগুলো পরিবর্তন বা সংস্কার করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল অর্থ ছাড়া কোনো কিছু পাওয়া যায় না। অথচ অর্থকে অনর্থের মূল বলে অর্থের প্রয়োজনীয়তাকে পাশ কাটানোর যে প্রয়াস তাতে যুগের ধর্ম প্রতিফলিত হয় না। তেমনি বলা হয়, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। কিন্তু লেখাপড়া করলেই যে গাড়ি চড়া নিশ্চিত তা কিন্তু নয়। বরং লেখাপড়া করতে গিয়ে রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ার ঘটনাই ঘটছে আজকাল। লেখাপড়া না করে অনেককেই গাড়িঘোড়ায় চড়তে দেখা যায় অহরহ। ঠিক সেরকম ‘চুরি করা মহাপাপ’ বলে যে প্রবচন প্রচলিত তা অনেকাংশে প্রযোজ্য হলেও সর্বাংশে প্রযোজ্য নয়। ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কাছে আহার চুরি করা মহাপাপ হবে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যে সমাজ বা রাষ্ট্র ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করতে পারেনি, মহাপাপ বরং তারই হওয়ার কথা। ওপরের ভণিতাটুকু যে কথা বলার জন্যে পাড়া হলো তা আমাদের সবার জীবনেই কোনো না কোনো সময় ঘটেছে। অর্থাৎ আমরা কোনো না কোনো সময় বই চুরি বা ফুল চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত। এমনিতেই বলা হয়, বই আর ফুল চুরিতে কোনো পাপ নেই। ফুল চুরির বিষয়টি কেবল ভালোবাসা বা ভালোলাগার জন্যে যে হয় তা নয়। আজকাল প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কাকডাকা ভোরে হাতে বাঁশের ফলা আর পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে ফুল চোরেরা বের হয় দেব-দ্বিজের পূজোর ফুল সংগ্রহের নিমিত্তে। ‘শিউলি ভিলা’ নামে এক বাসায় ছিলাম প্রায় সাত বছর। বাসার বৈশিষ্ট্য ছিল হরেক রকম ফুলে-পত্র-পল্লবে শোভিত আঙিনা। সদর দরজায় ছিল মধুমঞ্জরী লতা আর অলকানন্দার সমাহার। সকালে বাইরে গেট খুলে বেরোতে গেলেই দেখতাম ফুল গাছের কলিসহ পাতা, ছোট শাখার অগ্রভাগ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হতো না, ফুল শিকারীদের হাতে পড়ার কারণে এ নির্যাতন। ফুল গাছের ক্ষত দেখে কষ্ট হতো খুব। তবু ফুল চোরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।

করোনাকালে বাসা পাল্টে স্থানীয় একটা ক্লিনিকের চারতলায় উঠি। বারান্দা থেকেই ভোরে দেখতে পেতাম একজন দুজন করে ফুল চোরেরা প্রকাশিত হয় আঁধার চিরে। ক্লিনিক চত্বরে টগর-জবা-নয়নতারার ঝোপে তাদের হামলে পড়াটা ডাকাত পড়ার মতো ছিলো। মমতার ঘাটতি এবং কোনমতে ফুল পাড়তে পারলেই হলো। এতো নির্মমতায় বুকে কষ্ট লাগতো।

আমি নিজেও শৈশব-কৈশোরে ফুল চুরি করেছি বেশ কয়েকবার। কখনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ফুল চুরি করেছি, কখনো স্কুলের বাগান থেকে। শৈশবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুষ্প-শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর জন্য ভোর তিনটায় হানা দেই দলবেঁধে নগরীর সবচেয়ে বড় স্কুলের বাগানে। গাদা আর গোলাপের পাহাড় তুলে আনি অল্প সময়েই। ফুল নেয়ার সময় কোনো বিপত্তি ছিল না। ফুল নিয়ে নামার পথে পেয়েছিল কুকুরে। চার-পাঁচটি কুকুরের একটা দল ঘেউ ঘেউ করে আমাদের দিকে তেড়ে এসেছিল। তাদের তেড়ে আসায় এতো হিংস্রতা ছিল যে, আমরা ফুল রেখে ছুট দিলাম প্রাণ বাঁচাতে। বুক সমান দেয়াল সেদিন কীসের বলে টপকেছিলাম তা বিধাতাই জানেন। সেই থেকে রাতের আঁধারে আর ফুল চুরি করিনি। কৈশোরে পটিয়ার ঠেগরপুণি মেলায় গিয়ে রজনীগন্ধা ফুলের চারা দেখে ভালো লেগে যায়। তক্কে তক্কে থাকি, বিহার প্রাঙ্গণ থেকে কখন সেটা উঠিয়ে আনতে পারি সেই উছিলায়। অবশেষে লোকচক্ষুর দৃষ্টি এড়িয়ে সেই রজনীগন্ধার চারাটি নিয়ে আসি বাসায়। কিন্তু উঠোনে লাগানোর পর তাকে আর বেশিদিন বাঁচানো যায়নি। বুঝলাম, চোরাই মাল আসলে টেকে না।

ফুল চুরির চেয়ে বই চুরির ঘটনা আমার জীবনে বেশি। নিজে যেমন বই চুরি করে নিয়ে এসেছি, তেমনি আমার বইও অন্যেরা নিয়ে গিয়ে হজম করে ফেলেছে। লাইব্রেরির বই মোটামুটি অনেকগুলোই আমার শেলফে শোভা বাড়িয়েছিল। এরপর যাযাবরী জীবনের কারণে সেই বইগুলোর আর সুরক্ষা হয়নি। পাবলিক লাইব্রেরির চোরাই বই কয়েকটি ছিল রেফারেন্স বই। এতো এতো ফটোকপি তখন করার সুযোগ ছিল না। পাঠ্য বইয়ে পুরো ধারণা না পাওয়ায় সহায়ক বই হতে সংযোগ করার একটা রেওয়াজ ছিল তখন।

এ কারণে বন্ধু মহলে গ্রন্থ-তস্কর হওয়াটা বিরল ছিল না আমাদের। উচ্চশিক্ষার লাইব্রেরিতে বই আস্ত না আনলেও কয়েকটা পৃষ্ঠা এনেছি বেশ কয়েকবার। তখন মোবাইল ফোন না থাকায় বড় বেকায়দা ছিল আমাদের। সময় থাকতো কম, পড়ার চাপ থাকতো বেশি। কাজেই বইয়ের পৃষ্ঠা সংগ্রহের বিষয়টা নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল। কখনো কখনো যে চ্যাপ্টারের জন্যে কোনো রেফারেন্স বই নিতাম, দেখা, যেত সে বইয়ে সেই পৃষ্ঠাগুলোই নেই। বুঝতাম, আমার চেয়েও ঘাগু কোনো ব্যক্তি এ কর্ম সেরে ফেলেছে।

আমার নিজের সংগ্রহে থাকা চারখণ্ডের নজরুল রচনা সমগ্র থেকে ঘরে এসে কে যে তৃতীয় খন্ড হাপিশ করে দিলো তা আজও ধরতে পারিনি। ফলে বিকলাঙ্গ রচনা সমগ্র নিয়ে আমি পড়েছি বিপাকে। তখন আরেক সেট কেনার মতো উদ্যম যেমন ছিল না, তেমনি অপূর্ণ সমগ্রটাকে সহ্য করাটাও কষ্টকর ছিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে চাকমা লিপির একটা বই আমার অনুজ সতীর্থ মেরে দেয়ায়। কতবার চেয়েছি! ব্যাটা আমার চেয়ে বেশি ত্যাঁদড়। দিচ্ছি-দেবো বলে আজও দিল না। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদের 'নারী'কে পেয়ে হয়েছিলাম আত্মহারা। কিন্তু আমার ‘নারী’সঙ্গ আর বেশিদিন কপালে সইলো না। মুজিবুর রহমান ফরহাদ নামে এক বন্ধুপ্রতিম অগ্রজ ভাই আমার ‘নারী’ নিল অপহরণ করে। সেই প্রিয় ‘নারী’ বিচ্ছেদে অনেকদিন বেদনামথিত ছিলাম। মনে হয়েছিল যেন মনের রাধাকেই হারিয়েছি। একখণ্ড সম্পূর্ণ জীবনানন্দ হয়ে উঠেছিল আমার অবসরের সহচর। বইয়ের জ্যাকেটে পাটির প্রচ্ছদ। দারুণ সখ্য ছিল আমার তার সাথে কিন্তু সেই সখার ওপরও কার যেন শ্যেন দৃষ্টি পড়েছিল। ফলত আমি হলাম সখা হারা। মনে সদাই মনে হতো, ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর’।

একটু বেশি বড় হয়ে যাওয়ার পর আমি আর বই চুরি করিনি, একেবারে সোজা ডাকাতি করেছি। কিংবা ছিনতাইও বলা যেতে পারে। পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতনদার কাছে গেলে দুয়েকটা বই জোর করে নিয়ে আসি। দাদা কি আর বাধা দিতে পারেন? শিক্ষক মানুষের বাধার জোরই বা পেরে উঠবে কেন, বিশেষত স্নেহ যেখানে দিয়ে বসে আছে প্রচ্ছন্ন সম্মতি। ডাকাতি করতে গিয়ে দান হাত পেতে নিয়েছি বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ মনোজদার কাছ থেকে। তবে তাঁর দানে বামপন্থীর অবদান বেশি। তাঁদের পরিবারে বাম রাজনীতির চর্চা বেশি। তাঁর কাছ থেকে আনা বইগুলোতে কার্ল মার্ক্সের দাপট ছিল বেশি।

খুব ছোটবেলায় সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন মেজো মামার বিবাহবাসর সম্পন্ন হয়। তখন প্রীতি উপহার হিসেবে বই দেয়ার চর্চা ছিল। এই চর্চাটা কীভাবে যে বই হতে ক্রোকারিজে অবনমিত হলো তা বুঝা গেল না। মাঝে অবশ্য প্রাইজবন্ডে রূপ নিয়েছিল। এখন আবার তা এসে ঠেকেছে বিছানার চাদরে। তো, পরীক্ষার ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে পেয়ে গেলাম খাটের নিচে আস্ত এক খনি। বইয়ের খনি। সব শরৎ চন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের। দুপুরে খাওয়ার পরে বই খাই, সন্ধ্যায় চা পান করে বই গিলি আর রাতের ঘুমে বই মুখের ওপর স্বয়ং খোলা অবস্থায় পতিত হয়। কখনো ‘বড়দিদি’ এসে ঘুম পাড়ায়, কখনো ‘মেজদিদি’ এসে কাঁদিয়ে যায়, কখনো 'পথের দাবী' এসে ঘুম কেড়ে নেয়। ‘নৌকাডুবি’ ঘুমে স্বপ্ন দেখায়। ‘দত্তা’ এসে নরেণ হওয়ার স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেয় মনে। খনির এতো বই দশ দিনে পড়া আমার আর হয়ে ওঠে না। অগত্যা কাউকে না বলে ব্যাগের ভেতর একটা ছোট বইয়ের খনি বানিয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। চুরি করা সেই বইয়ের খনিতে মামাবাড়ির খাটের তলা শূন্য হলেও আমার মনের সরোবর টইটম্বুর হয়ে ওঠে।

বই যে কেবল চুরি করেছি তা নয়, কখনও কখনও চুরি করে পুরস্কারের বই বদলও করেছি। যে বই আমি পুরস্কার পেয়েছি তা পাল্টে বন্ধুর পুরস্কারের বইটা হাতিয়ে নিয়ে আমারটা তাকে দিয়ে দিয়েছি। এতে সব সময় যে আমিই জিতেছি তা নয় মোটেই। দামে আমি হারলেও মানে বা পছন্দে জিতে গেছি। চোরাই বইয়ের মধ্যে ছোট্ট ‘শরণাগত’ বইটা আমার মনে এনে দিয়েছিল প্রশান্তি। বেশ কয়েকবার বইটা পড়েই বুঝেছি, জীবন কখনো দেহে মুখর, কখনো মনে মুখর আর কখনো মুখর সে মৌন চিন্তায়।

বই ও ফুল সত্যিকার অর্থে তস্করের কোনো কাজে লাগে না। মননশীল ও সৃজনশীল মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে তুলতেই বই ও ফুলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই এ দুটো চুরি হলো উচ্চ মার্গের চুরি। অপরাধ হিসেবে ধর্তব্য হলেও নিন্দনীয় নয়। বই চুরি করে মার্ক টোয়েনকে আমরা খ্যাতিমান হতে দেখি। সৈয়দ মুজতবা আলীর 'বই কেনা' পড়ে বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি, এ কথা জানতে পারলেও বই চুরি করে কাউকে রাজা হতে দেখিনি। কিন্তু হেকিম সাহেবের বই জোর করে নিয়ে রাজা নিজেই তিলে তিলে বিষ গ্রাস করে মরণাপন্ন হয়ে জানতে পারলেন হেকিমের প্রতিশোধের কথা। ভাগ্যিস, আমার চুরি করা বইয়ে সে রকম কোনো হেকিমের প্রতিশোধ ছিল না।

পড়ার জন্যে বই চুরি করা একটি স্বাস্থ্যকর অপরাধ। সেই বইয়ের পাঠ হতে যদি নূতন কিছু সৃষ্টি হয়, তবে তা হয়ে যায় কিংবদন্তি। খ্যাতিমান লেখকদের আত্মজৈবনিক লেখাতেও বই চুরির বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে পরম মমতায়। মারি-আক্রান্ত অস্থির সময়ে এমনিতেই পাঠকের সংখ্যা গেছে কমে। তা সত্ত্বেও যদি চুরি করা বই দিয়েও সমাজে বই পাঠকের সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে তাই-ই মঙ্গল। বই হোক আমাদের অন্নোত্তর জীবনাহার। জগতের বই চোর অনাহারী নয়, জ্ঞানাহারী হোক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়