প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২২, ০০:০০
একটি দেশের ভাষার লালিত্য, শব্দ বুনন, সংস্কৃতির যথাযথ মূল্যায়ন ও সমৃদ্ধির মাপকাঠির মধ্য দিয়ে ভাষাগোষ্ঠী পৌঁছে যায় অনন্য উচ্চতায়। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধী কিংবা ক্ষমতালোভীদের কূটকৌশলে এই ভাষা কিংবা ভাষিক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলনই হয়ে ওঠে সমাজের সুশীল ও সর্বশ্রেণীর ভাষাবাহীর সত্তাকে স্বাধীন করার একমাত্র পথ। প্রাচীন কাল থেকে এই অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠী ভাষাপ্রেমে পরীক্ষিত অদম্য সৈনিক। হাজার বছরের বাঙালি জাতির জীবন প্রবাহে নান ঘূর্ণিপাকে যেসব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও আন্দোলন, সংগ্রাম, গৌরবগাথা যুক্ত হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর ভাষা আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম। এটি ছিল গতানুগতিক বাকসর্বস্ব আন্দোলন নয়। ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী পলকহীন দৃষ্টিতে অবলোকন করেছে বাঙালির নিঃস্বার্থ ভাষাপ্রীতি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম ‘ভাষার জন্য আত্মত্যাগ’ বাঙালিকে বিশ্বের মানুষের কাছে ত্যাগী, অপ্রতিরোধ্য, অজেয়, আদর্শিক ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে ঔজ্জ্বল্য ও স্বমহিমায় প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া এক দেশভুক্ত দুটি দেশের তেমন সাযুজ্য ছিল না। ভাষা এবং সংস্কৃতির তো নয়ই। এমনই সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর নানান গণবিরোধী নীতি চাপিয়ে দিতে শুরু করে ক্ষমতাসীন পশ্চিম-পাকিস্তান। এর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার নীলনকশা বাঙালিকে আহত করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওই নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সচেতন জনগণও ওই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রদের হাতকে শক্তিশালী করতে সমর্থন জানায়। রুখে দেয়ার ঘোষণা দেয় বাংলা ভাষা নস্যাতের সকল ষড়যন্ত্র। ফলে অমানুষিক নিপীড়ন শুরু হয় বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় বাঙালি দমন ও নিধন প্রক্রিয়া। ভাষা রক্ষার দাবিতে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া ভাষিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে আসেন ঢাকার রাজপথে। তারা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। পুলিশ গুলি চালায় ছাত্রদের মিছিলে। নিহত হন তিনজন। পরদিন আবারো মিছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির ওই মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। শাসকরা সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেয়। ক্রমে দ্রোহের এ আগুন সম্প্রসারিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকরা। আর এসব প্রতিবাদ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে সাহিত্য।
তবে এই আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে অবহেলিত ও অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আব্দুল হাকিম রচিত ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ কবিতাটি মাতৃভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রচিত সার্থক কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আন্দোলন চলাকালে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বসে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচনা করেন ১২০ লাইনের ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামের কবিতা। দীর্ঘ কবিতাটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের স্মরণে প্রথম এবং ভাষিক আগ্রাসনের ওপর লিখিত দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়। কবিতাটির কয়েক পঙ্ক্তি তুলে ধরছি- ‘যে শিশু আর কোনোদিন তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না, যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না, যে জননী খোকা এসেছে বলে উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবে না, যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করেছিল তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবী করতে এসেছি।’
[কাঁদতে আসিনি, ফাাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি/ মাহবুবুল আলম চৌধুরী]
এরপর আন্দোলনকালীন সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো!’- ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ শিরোনামের এই কবিতাটিকে দ্বিতীয় এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ভাঙার দিনে লুৎফুর রহমান জুলফিকার রচিত ৬৩ পঙ্ক্তির দীর্ঘ কবিতাকে একুশের ওপর লিখিত তৃতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন আর্য সভ্যতায় বসবাস করেও আর্য ভাষার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তিনি অহিংসনীতি অনুসরণ করে স্থানীয় মুখের ভাষা পালীতে ‘ত্রিপিটক’ রচনা করে বিদ্রোহের জবাব দেন। ভাষিক বিদ্রোহের এ ধারা বাঙালির ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তবে সত্য এই যে, সংস্কৃতিগত মিল না থাকায় হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধানের একই রাষ্ট্রভুক্ত দুটি দেশের মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। দুটি পৃথক জাতি এবং পৃথক ভাষা। পূর্ববঙ্গে বসবাসকারীরা স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। আর এটি বাংলা ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বাংলা ভাষা, যার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রায় দুশ বছর শাসনের পর ইংরেজরা যখন এ উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হয় তখন অলীক এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা পূর্ববঙ্গের ওপর যে ভাষিক নিপীড়ন শুরু করেছিলেন তা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। পরবর্তীতে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যে মৌল ভিত্তির ওপর বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে, তা প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা। দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কবিরাও লিখতে থাকেন তাদের অমর পঙ্ক্তিমালা-
‘ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা
নাম দিয়েছি ভাষা, কত নামেই ‘তাকে’ ডাকি
মেটে না পিপাসা।’
[আসাদ চৌধুরী]
বস্তুত ইংরেজ শাসনামল থেকেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি হয়ে পড়ে। বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা পরনির্ভরশীলতার ফাঁদে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় গোটা উপমহাদেশে ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলন তীব্রতর হয়। এ দেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের পর বলতে গেলে ‘মানচিত্রে পেন্সিলের রেখা টেনে ভারত ভাগ হয়’। তখন সেই অলীক রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গ নামের বাংলাদেশকে একটি পরমুখাপেক্ষী অঞ্চলে পরিণত করা হয়। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয় গণতন্ত্রের মূলভিত্তিকে। উপরন্তু বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি। ফলে ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মানসলোকে সবল, স্বতঃস্ফূর্ততা ও সত্য নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আর এই ভাষিক আন্দোলনে গণমানুষকে উজ্জীবিত করা-সাহসী করার শুদ্ধ উচ্চারণ এভাবেই উঠে আসে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে-
‘ওরা আমার মুখের কথা
কাইরা নিতে চায়।
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়।’
[আব্দুল লতিফ]
দেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে ভাষিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে রচিত হতে থাকে গান। গান একটি শ্রুতি মাধ্যম। গান দিয়ে অতি সহজে মানুষের মননের কোষে ঝংকার তোলা যায়, চেতনা জাগানো সম্ভব হয়। যে কারণে বাঙালির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নিয়েও রচিত হয়েছে অনেক গান। গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা। যশোরের কবি শামসুদ্দীন আহমদ রচিত ‘ভুলব না ভুলব না, ভুলব না আর একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গানটি ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের ওপর প্রথম রচিত গান। তবে আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কালের বিবর্তনে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।’
[আব্দুল গাফফার চৌধুরী]
এই কবিতার বজ্রশাব্দিক দাবি সেদিন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। কবিতার মাধ্যমেই আছড়ে পড়ল ক্ষোভ, দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইল সকল অন্যায় অবিচার। সময়, চিত্রকল্প, ভাষাশৈলীর বিচারে কেউ কেউ এই কবিতাকে বলেছেন ‘একুশের সেরা প্রতিবাদী কবিতা’। কারণ, তখনকার বিরূপ সময়ে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণসম এমন কবিতা লেখার সাহস কম প্রশংসাযোগ্য হতে পারে না। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে কবিতাটি গান হয়ে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই গানটির সুর বারবার আমাদের জানান দেয় একুশের মাহাত্ম্য আর বাংলা ভাষাপ্রীতির কথা।
মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। অঞ্চলভেদে মাতৃভাষার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তন হয় না। ভাষা হিসাবে ইংরেজির গুরুত্ব থাকলেও আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়েছে তাও বিবেচনায় নেয়ার মতো একটি বিষয়।
তবে এটুকু বলা বাহুল্য হয় না যে, বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের আত্মপরিচয়ের ডামাডোল চির জাগরুক-সত্য অনিবার্যভাবেই একুশে নিহিত। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই আমরা অকুতোভয়ে বলতে পারি, এর একমাত্র দাবিদার বাঙালি। যে কারণে বাংলা ভাষা আজ সর্বজনীন ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ বাঙালির জন্মের অহঙ্কার। আর বাংলাভাষা বেঁচে থাকার অলঙ্কার। জাতির ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যে আত্মমুক্তির যে ঋদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল, বুদ্ধিবৃত্তিক যে চেতনা সম্প্রসারিত হয়েছিল কাব্যচেতনায়, তা এখনো প্রবহমান।
একুশ নিয়ে পরাবাস্তবতার কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটি সমৃদ্ধ। কবিতাটি একটু ব্যতিক্রমও বটে।
‘পাড়ায় পাড়ায় নাটক- ব্রতচারী নাচ-
মুকুলের মাহফিল-কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুল
আর সবুজের স্বরগ্রাম:
কলাপাতা-সবুজ, ফিরোজা, গাঢ় সবুজ, নীল,
তারই মধ্যে বছরের একটি দিনে
রাস্তায় রাস্তায় উঠে আসে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই!’
আবার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় কবি এক দুখিনী মায়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন। ‘...চিঠিটা তার পকেটে ছিলো/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা/ মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে/ তাই কি হয়?/ তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।/ তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ি ফিরবো...।’ ঘরে প্রতীক্ষায় কাতর মা ছেলের জন্য শখের উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে, নারকেলের চিড়ে কোটে। একসময় কুমড়ো ফুল শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে, কিন্তু খোকা ছুটি পায় না। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এই কবিতায় অত্যন্ত কোমল হাতে, ঝাপসা চোখে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ছেলের জন্য মায়ের প্রতীক্ষা যে কত তীব্র, কত কষ্টের তা বিবৃত করেছেন।
শামসুর রাহমানের ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে’ কবিতায় প্রগাঢ় মানবজীবনের নিখুঁত সুশোভিত প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন-
‘...বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে/ কত চেনা ছবি; মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন ঘুম পাড়ানিয়া ছড়া.../ নানী বিষাদ সিন্ধু স্পন্দে দুলে দুলে রমজানি সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া/ আর একুশের প্রথম প্রভাত ফেরি, অলৌকিক ভোর।’
এ ছাড়া একুশের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতার মধ্যে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘একুশের গান’, সুফিয়া কামালের ‘এমন আশ্চর্য দিন’, মাজহারুল ইসলামের ‘স্বাগত ভাষা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’, কায়সুল হকের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘স্মৃতির মিনার’, আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’, ওমর আলীর ‘বেদখল হয়ে যাচ্ছে’, শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘বর্ণমালা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’ উল্লেখযোগ্য।
’৫২ পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় জীবনে, সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় কর্মকা-ে, চলচ্চিত্রে, নাটকে, সাহিত্যে, সামগ্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। একুশের উদ্বেলিত উদ্দীপনা স্বমহিমায় বাংলা সাহিত্যেও বারবার উচ্চকিত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই এক নব উদ্ভাসিত নবারুণ শক্তি নিয়ে সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় প্রেক্ষাপট হিসেবে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতার কাব্যিক চোখে, শব্দ চয়ন, কবিতা ও সাহিত্যের নান্দনিক উপস্থাপনায়, গল্পের শাব্দিক ভাঁজে, গবেষণার আগ্রহী বিষয় হিসেবে, নাটকের উদ্দীপক সংলাপ বর্ষণে বায়ান্নের একুশ তারিখ এখনও হিমালয়ের শরদিন্দুর মত অনড় পলকহীন, চেতনাদীপ্ত; এতটুকুও পুরানো হয়ে উঠেনি। ফলে এমন পদ্য অথবা গদ্যশিল্পী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি এ প্রেক্ষাপটে অনুরণিত হয়ে গল্প-কবিতা রচনা করেননি। তবে সব সময়ের মতোই, সব প্রেক্ষাপটের পুনঃসঞ্চায়নে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই অজর-অজস্র লেখা হয়েছে। ‘একুশের প্রভাব : বাংলাদেশের কাব্যভাষার বিবর্তন’ প্রবন্ধে কবিতায় ভাষা-আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে আহমেদ মাওলার মূল্যায়ন- ‘একুশের পর বাঙালির যেন নতুন জন্ম ঘটে, চেতনায় ও সৃজনশীলতায় নতুন এক দিগন্তের সাক্ষাৎ পায় বাঙালি। সাহিত্যের অন্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে বাঙালির সৃজন-বেদনার প্রিয় ক্ষেত্র। ওই দশকে, একসঙ্গে এত কবির আবির্ভাব, এত কবিতা, সম্ভবত আর কখনও লেখা হয়নি। ভাষা-আন্দোলনের অভিঘাতই বাংলাদেশের কবিতার সাহিত্যের বাঁকবদল ঘটিয়েছে, অমেয় রূপান্তর ঘটেছে বাংলাদেশের কাব্যভাষার।’ সুতরাং সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রভাবের বিষয়টি অস্বীকারও করা যাবে না। এটি একটি প্রজ্জ্বলিত শিখা। এর আগে সাহিত্যে ব্যাপকভাবে আরবী, ফারসী, ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হলেও ভাষা আন্দোলন পরবর্তী লেখক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, আধুনিক যুগের কবি ও সাহিত্যিকরা বাংলা শব্দভা-ার যথাযথ ব্যবহার করে প্রদ্যোত সফলতাও পেয়েছেন।
সবশেষে, বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের নাম যেমন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তেমনি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকেও জাগ্রত রাখতে সকলের সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা যাতে করে বিদেশি ভাষার মায়াজালে হারিয়ে না যায়। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষা থাকবে কথার মালায়, নাটকে, সংলাপে, যুক্তিতর্কে থাকবে চিরায়ত অবিনশ্বর ও অম্লান।
লেখক : ৩১তম বিসিএস ক্যাডার (সাধারণ শিক্ষা)।