প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
নজরুলকে ধূমকেতু বলা হলেও আসলে নজরুল স্বয়ং এক জ্যোতিষ্কের নদী যাঁর চলার ছন্দে জ্যোতির্ময় প্রলয়ের উত্থান ঘটেছে। আর তাতে যুগের আঁধার কেটে আলোর তীব্র বানের প্রাবল্যে তৈরি হয়েছে সুন্দর। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা তথা বৃহত্তর কুমিল্লার একটি মহকুমা চাঁদপুর আত্মীয়তার সূত্রে নজরুলকে নার্গিস ও আশালতা-এ দুই মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে একটি ভিন্নমাত্রিক সম্পর্কে ব্র্যাকেটাবদ্ধ ছিলো। এ আত্মীয়তার যোগসূত্র ঊনিশশো চুরাশি সালের চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ থাকলেও পনর ফেব্রুয়ারি তারিখ হতে চাঁদপুর স্বয়ং আলাদা জেলারূপে যাত্রা শুরু করায় তাতে ছেদ পড়ে। কিন্তু সে সম্পর্কের সূত্র ছিন্ন হলেও অনেকগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিকোণে নজরুলকে চাঁদপুরের সাথে সম্পর্কে জুড়িয়ে রাখা যায়। তরুণ নজরুল ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনের কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদারের পদে থেকে যুদ্ধের ময়দান হতে চাঁদপুরের কীর্তিমান সাংবাদিক ও ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের কাছে লেখা পাঠাতেন। তাঁর প্রথম মুদ্রিত লেখা ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ‘সওগাত’-এর প্রথম বর্ষ সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘সওগাত’-এ কাজী নজরুলের মোট আশিটি রচনা প্রকাশিত হয় এবং ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি ধারাবারিকভাবে তেরশ তেত্রিশ হতে তেরশ ছত্রিশ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত মোট আড়াই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘সওগাত’-এর সম্পাদক, চাঁদপুরের পাইকারদি গ্রামের নাসিরউদ্দীনই নজরুলকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ‘মৃত্যুক্ষুধা’-র মধ্য দিয়ে জন্মদান করেন। এমনকি, শিশু সওগাত-এর যাত্রা শুরু হয় নজরুলের আশীর্বচন দিয়েÑ
‘ওরে শিশু ঘরে তোর এল সওগাত
আলো পানে তুলে ধর ননী মাখা হাত।
তোর চোখে দেখিয়াছি নবীন প্রভাত
তোর তরে আজিকার নব সওগাত। ’
(‘শিশু সওগাত’-কাজী নজরুল ইসলাম)
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এসময় তাঁর সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ, যিনি পরবর্তীতে তাঁর নিবিড় বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হন। নজরুল তখনও ‘অগ্নিবীণা’ বা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জনক হননি। কিন্তু ‘লিচুচোর’ কবিতার বদৌলতে পুস্তক ব্যবসায়ী কুমিল্লার আলী আকবর খানের নজরে পড়ে যান। নৈকট্য গাঢ় হলে আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে নজরুল ঊনিশশো একুশ সালের মধ্য এপ্রিলে (তেরশ সাতাশ বঙ্গাব্দের চৈত্রশেষের দিকে) কুমিল্লা এসে বেড়িয়ে যান। কুমিল্লা হতে কোলকাতা ফেরার পথে আট জুলাই বন্ধু মুজফ্ফর আহমদসহ যাত্রার ভাড়ার সংকটে পড়ে চাঁদপুরে আটকে যান। সে সময় চাঁদপুর রেলস্টেশনের কর্মীরা চা-শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল যা প্রায় দুমাসাধিক সময় ধরে চলমান ছিলো। নজরুল সে সময় বর্তমান প্রধান ডাকঘরের উল্টোদিকে, যেখানে এখন লেডি প্রতিমা মিত্র বালিকা বিদ্যালয়, সে স্থানে স্ট্র্যান্ড রোডের পাশে অবস্থিত একতলাবিশিষ্ট ডাক বাংলোতে অবস্থান গ্রহণ করেন ও রাত্রিযাপন করেন। আর্থিক সংকট নিরসনে নজরুল আফজালুল হককে কোলকাতায় টেলিগ্রাম পাঠান এবং আফজালুল হক কুমিল্লায় আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরীকে অবহিত করেন। আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী সেই খবর চাঁদপুরের গান্ধীখ্যাত কংগ্রেসী হরদয়াল নাগকে জানালে তিনি তৎকালীন বারো টাকা শ্রী কূলচন্দ্র রায়কে দিয়ে নজরুলের নিকট পাঠান। এ টাকাতেই নয় তারিখ জুলাই মাসে নজরুল ও মুজফ্ফর স্টিমারযোগে জলপথে কোলকাতা প্রত্যাগমন করেন। মূলত এভাবেই চাঁদপুরের মাটির সাথে নজরুলের পদরেণু ও স্মৃতি সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। হরদয়াল নাগের এ সহায়তা পরবর্তী সময়ে নজরুল পরিশোধ করেছিলেন কি না তা জানা যায় না। পরবর্তীতে, দুহাজার আট সালের পঁচিশে মে নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনকালে চাঁদপুরের বরেণ্য সাংবাদিক কাজী শাহাদাত তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রথম নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম রচিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থের তথ্যসূত্র উল্লেখ করে চাঁদপুরে নজরুলের আগমন সংবাদ পরিবেশন করলে স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মী ও সাহিত্যজনদের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ সংবাদ তৎকালীন চাঁদপুর পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র নাছির উদ্দিন আহমদের নিকট পৌঁছালে তিনি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে তাঁর পরিষদের মধ্যে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে সংস্কৃতি কর্মী ও সাহিত্যকর্মীদের দাবিকে বাস্তবায়িত করেন এবং সাবেক স্ট্র্যান্ড রোডটিকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক নামে নামকরণ করেন। এ বিষয়টিকে বিধৃত করে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব চত্বরে রোটারীয়ান কাজী শাহাদাতের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালীন একটি বড় ফলকলিপি স্থাপন করা হয়েছে, যা আজো পর্যটকদের অনুসন্ধিৎসা মিটিয়ে যাচ্ছে।
নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও এ দেশে প্রথম নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চাঁদপুরের প্রাচীন ও বনেদী সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংগীত নিকেতনের আয়োজনে। চাঁদপুর জেলার শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে দু হাজার পাঁচ সালের জুন মাসে, আট তারিখ হতে দশ তারিখ পর্যন্ত তিনদিনব্যাপি অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনদিনে নয় সেশনে মোট তেরটি সমবেত নজরুল সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এর পরদিনই অর্থাৎ দু হাজার পাঁচ সালের জুন মাসের এগার তারিখে ঢাকায় আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এর ষোল বছর পরে, দু হাজার কুড়ি সালের তিন মার্চ হতে পাঁচ মার্চ পর্যন্ত তিনদিনব্যাপি নজরুল ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপি আয়োজনের অংশ হিসেবে চাঁদপুরেও নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি দুহাজার ঊনিশ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা অনিবার্য কারণে দুহাজার কুড়ি সালের মার্চ মাসের তিন তারিখে গিয়ে বাস্তবতার দেখা পায়। তিন তারিখ বুধবার দুপুরে উদ্বোধনী পর্বে চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে র্যালিশেষে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন চাঁদপুর তিন আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘কবি নজরুল তাঁর গানে কবিতায় ছাত্র সমাজ ও তরুণদের প্রতি প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানতেন তরুণরাই সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি। তিনি আমাদের জাতীয় জাগরণের তূর্যবাদক, জাতিসত্তার অন্যতম প্রাণ পুরুষ ছিলেন। একটি শিক্ষিত ও স্বনির্ভর জাতি গঠনে তিনি সব সময় লিখনি সচল রেখেছিলেন। সর্বহারা মেহনতি, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন সোচ্চার।’ শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-গান অনুপ্রাণিত করেছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের লেখা থেকেই নিয়েছেন আমাদের মুক্তির স্লোগান ‘জয় বাংলা’। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে জাতির পিতার ঐকান্তিক উদ্যোগে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে এনে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং জাতীয় কবি হিসেবে নাগরিকত্ব দিয়ে মর্যাদা দেয়া হয়। নজরুলের জীবনের শেষ শয়ানও হয় এই বাংলার শ্যামল মাটিতে।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী তাঁর বক্তব্য শেষে চাঁদপুরে নজরুল আগমনের স্মৃতিকে ধরে রেখে ম্যুরাল স্থাপন করে দেবেন বলে কথা দেন। তিনি বলেন, পঁচিশে মে তথা এগার জ্যৈষ্ঠের আগেই ম্যুরাল সম্পন্ন হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে স্মৃতি-বিজড়িত এলাকায় উপযুক্ত স্থানের অভাবে সে ম্যুরাল স্থাপন করা যায়নি।
উল্লেখ্য যে, চাঁদপুরের সোনার মেয়ে ডাঃ দীপু মনি ঊনিশশো বাহাত্তর সালে মে মাসের পঁচিশ তারিখ সকালে তাঁর বাবা ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদের সাথে কবি ভবনে গিয়ে বাকরুদ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে মালা পরিয়ে দেন। কবিও তাঁর ডাগর দুটো কাজল কালো দিঘির মতো চোখে খুকুরূপী দীপু মনির দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকেন।
তিনদিনব্যাপি এ নজরুল সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক বুলবুল মহলানবীশ, খায়রুল আনাম শাকিল, সালাহ্উদ্দিন আহমেদ, সুমন মজুমদার প্রমুখ। নৃত্য পরিবেশন করেন ওয়ার্দা রিহাবের দল। কবিতা পাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান, ফারুক হোসেন প্রমুখ। সম্মেলন উপলক্ষে একটি স্যুভেনির প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যকর্মী ম. নূরে আলম পাটওয়ারীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘উপমা’ সাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ স্মারক সংখ্যা প্রকাশিত হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একশ ছয়তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। চৌদ্দশ বারো বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে তথা দু হাজার পাঁচ সালের মে মাসে এককভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশিত স্মারক সংখ্যাটি ব্যাপকভাবে সুধী সমাজে প্রশংসিত হয়।
নজরুলের গবেষণায় নিজেকে প্রতিনিয়ত মগ্ন রেখেছেন চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামের কৃতী সন্তান, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বাংলা একাডেমির সভাপতি, বাংলাদেশের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম মহোদয়। তিনি নজরুল বিষয়ে বিভিন্ন বই রচনা করেন যার মধ্যে নজরুল নির্দেশিকা, নজরুল জীবনী, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও কবিতা, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য, কাজী নজরুল ইসলামের গীতি সাহিত্য, কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি, কিশোর কবি নজরুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মতলব উত্তরে নজরুল বিষয়ে চর্চাকে প্রসারিত করা এবং গবেষণা ও পঠন-পাঠনের জন্যে দু হাজার সাত সালে মেজবাহউদ্দিন মেজুকে আহ্বায়ক ও আশিক কবিরকে সদস্য সচিব করে সাংবাদিক শ্যামল চন্দ্র দাসের সভাপতিত্বে এক সভায় নজরুল একাডেমি গঠিত হয়। এতে মতলব উত্তরের ইউএনওকে প্রধান উপদেষ্টা, মতলবের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণপুরুষ মাকসুদুল হক বাবলুসহ বেশ কয়েকজনকে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্যে চাঁদপুর জেলা শহরে ৩৮০নং শের-ই বাংলা রোড, পনর নম্বর ওয়ার্ড, বিষ্ণুদীর অস্থায়ী কার্যালয়ে দু হাজার এক সালে ‘চাঁদপুর নজরুল গবেষণা পরিষদ’ গঠন করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মরহুম অ্যাডভোকেট লুৎফর রহমান খান। বর্তমান সভাপতি হিসেবে মতলব সরকারি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোশারফ হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সাংবাদিক জনাব আব্দুল গণি ও সহ-সভাপতি পদে নজরুল বিষয়ে চর্চাকারি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ উল বারী রাজা এই সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন।
বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও সপ্তসুর সংগীত একাডেমির অধ্যক্ষ রূপালী চম্পককে সভাপতি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নাট্যনির্দেশক শরীফ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ। ত্রিশে সেপ্টেম্বর দু হাজার ষোল তারিখে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগঠনের জেলা শাখার অভিষেক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কমিটি ঘোষণা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজিত মোস্তফা। কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ হলেন : সহ-সভাপতি প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেন, সুরজিৎ চক্রবর্তী, শাহানারা বেগম, সহ-সম্পাদক রুমা সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক মৃণাল সরকার, কোষাধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম, দপ্তর সম্পাদক পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক কেএম মাসুদ, প্রকাশনা সম্পাদক আশিক বিন রহিম, কার্যনির্বাহী সদস্য শংকর আচার্য, গৌরাঙ্গ সাহা, বৈশাখী ঘোষাল তুলি, খোকন চন্দ্র দাস, রিতা পাল, শাওন সাথী ও রানা দত্ত।
নজরুল সংগীতকে উপজীব্য করে চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সংগীত নিকেতন ‘অনন্ত তৃষা’ ও ‘শাল পিয়ালের বনে’ শীর্ষক দুটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছে যা নজরুল স্মরণে পরিবেশিত হয়।
সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর ছোটগল্পের নাট্যরূপ ‘রাক্ষুসী’ নাটকটি চাঁদপুরের স্বনামধন্য অনন্যা নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে।
শহীদ পাটোয়ারীর নির্দেশনায় মমতাজউদ্দীন আহমদের দেয়া নাট্যরূপ ‘রাক্ষুসী’ নাটকটি অনন্যা নাট্যগোষ্ঠীর ৩৪তম প্রযোজনায় ১৮তম প্রদর্শনী হিসেবে মঞ্চস্থ হয়।
সারাদেশের মতো চাঁদপুরেও নজরুলকে বিকৃতভাবে চর্চার অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রকৃত সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের ¯্রােতে তা টেকসই হতে পারেনি। স্বৈরাচারের আমলে পাঠ্যপুস্তকে ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’-এর স্থলে যেমন ‘সজীব করিব গোরস্থান’ শেখানোর চেষ্টা হয়েছিলো এবং তার মন্দ ঢেউ সারাদেশের ন্যায় নদীমাতৃক চাঁদপুরের উপকূলেও যেমন আঘাত করেছিলো, তেমনি আজও গ্রামে-গঞ্জের চায়ের দোকানে নজরুলকে নিয়ে সস্তা বিতর্কের ঝড় ওঠে। বিশেষত নজরুলকে ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে খ-িতকরণের অর্বাচীন প্রচেষ্টা আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে লক্ষ্যণীয়। রবীন্দ্রনাথকে খাটো করে কেউ যেমন নজরুলকে বড় করতে চান বিভিন্ন গেঁয়ো বিতর্কে, তেমনি অনেকে এখনও মনে করেন নজরুলকে স্লো পয়জনিং-এর মাধ্যমে নির্বাক করে তোলা হয়েছে। কেউ কেউ আবার নজরুল গবেষকের মেকি পরিচয় ধারণ করে নজরুলের জন্মতারিখ নিয়েও বিতর্কের অবতারণা করেন এবং তাতে অন্য সবকিছুর মতো রবীন্দ্র-নজরুলের তুলনার কু-মানসিকতারই প্রাধান্য থাকে। এসব কিছুকে ছাপিয়ে রোজার ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ঘরে ঘরে বেজে ওঠে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে নজরুলের লেখা কালজয়ী গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’। এর পাশাপাশি নজরুল তাঁর সুরের যাদু দেখান রামকৃষ্ণ আশ্রম, কালীবাড়ি কিংবা গোপাল জিউর আখড়ায় শ্যামা সঙ্গীতের মাধ্যমে ভক্তের কণ্ঠে মগ্ন হয়ে। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল জমে ওঠার পূর্বে শিশুকণ্ঠে নজরুলের লেখা হামদ-নাত চাঁদপুরের মাঠে-ময়দানে বেজে ওঠে সুললিত কণ্ঠে। বিজয়মেলার মঞ্চে যেমন বেজে ওঠে ‘একী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু বঙ্গ জননী’, তেমনি মাঝে মাঝে শহিদ মিনারের মঞ্চে নজরুলের ‘শেকল ভাঙার গান’ ও তার কোরিওগ্রাফি আমাদের শোণিতে জাগরণ আনে সকল অপসংস্কৃতি ও আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি নিয়ে। চাঁদপুরে নজরুল চর্চায় এখনও স্বতঃপ্রণোদনার জোয়ার আসেনি। প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় আয়োজন কিংবা কেবল জন্ম-মৃত্যুর উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে সরব হয়ে ওঠে ভক্তমন। আমজনতার মাঝে প্রকৃত নজরুল চর্চার জোয়ার একদিন চাঁদপুরে শ্রাবণ-প্লাবণ-বন্যার মতো চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সে আশায় আমরা দিনগুনি অধীরতায় তন্ময় হয়ে।
তথ্যঋণ
১. চাঁদপুর পরিক্রমা, সম্পাদনা : প্রিয়তোষ সাহা, প্রথম প্রকাশ : ২০১৩, আহমদ পাবলিশিং হাউজ
২. মতলবের ইতিবৃত্ত, প্রথম প্রকাশ : ২০১৩, প্রকাশনায় : উপজেলা প্রশাসন, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর
৩. কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য, অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, প্রথম প্রকাশ : ২০১২, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা
৪. জাতীয় নজরুল সম্মেলন, চাঁদপুর-এর প্রকাশনা, সম্পাদনা : আব্দুর রাজ্জাক ভূঁঞা, প্রকাশ : ২০২০, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা
৫. দৈনিক সুদীপ্ত চাঁদপুর, ২ অক্টোবর, ২০১৬
৬. চাঁদপুর টাইমস্, ২৫ মে, ২০১৬
৭. ফলকলিপি, চাঁদপুর রোটারী ক্লাব চত্বর
৮. স্বপন সেনগুপ্ত, অধ্যক্ষ, সংগীত নিকেতন, চাঁদপুর
৯. শহীদ পাটোয়ারী, নাট্যনির্দেশক, অনন্যা নাট্যগোষ্ঠী, চাঁদপুর