রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

কবিতায় শীত, কবিতায় হিমের কাঁপন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

শীত বাংলা কবিতাকে কেবল কাঁপিয়েই ছাড়েনি, বরং শীতকে আশ্রয় করেছে কবিতা। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রধান তিন কবিই কবিতায় শীতকে জায়গা দিয়েছেন। শীত বাঙালি জীবনে ঋতুর চেয়ে মিথের স্থান দখল করেছে অধিক। বামধারার অকাল প্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত সূর্যের প্রতীক্ষায় থেকে ঠা-াকে মোকাবেলা করেন। রোদের ওমে শীতের কাঁপন তাড়াবার পথ ছাড়া আর কোনো পথ জানা নেই তার। তিনি অকপটে সূর্যকে অনুনয় করে বলেন, ‘হে সূর্য, তুমি তো জানো আমাদের গরম কাপড়ের কতো অভাব!’ এতো অনুনয় কেবল বিনামূল্যে রোদ পোহানোর জন্যে। রবীন্দ্রনাথ শীতের হাওয়ায় আমলকির ডালে ডালে নাচনের মুদ্রা আবিষ্কার করেন। এ নৃত্য আদৌ আনন্দের কি না তা বলা যায় না। তবে মাঘের শীতে বাঘে কাঁপার প্রবাদের সত্যতার সাথে তাল মিলিয়ে আমলকি শাঁখে কাঁপন ধরতেও পারে। নির্জনতার কবি জীবনানন্দের কাছে হেমন্তের প্রতি আকর্ষণ বেশি হলেও শীতরাত নিয়েও তাঁর পর্যবেক্ষণ চমৎকার। তিনি মনে করেন শীতের রাতে সিংহের গর্জন আসলে গর্জন নয়, বরং শীতের বেদনার প্রতিক্রিয়া। তিনি শীতরাত সম্পর্কে নিজের অভিমত তুলে ধরে বলেন,

‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,

কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’

(শীতরাত, জীবনানন্দ দাশ)

প্রকৃত অর্থেই শীতের রাত মৃত্যুর মতো শীতলতা নিয়ে আসে জনজীবনে। ইংরেজ কবি এস টি কোলেরিজ তার ‘বলাড’-এ মৃত্যুকে হিমশীতল করেই কল্পনা করেছেন। তার কল্পনার সাথে ‘শীতরাত’-এর কবি জীবনানন্দের কল্পনাও যেনো সমাপতিত হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে প্যাঁচা যেমন নিশুতি রাতের অশুভ শক্তির মিথ হিসেবে পরিগণিত হয়, তেমনি কবি জীবনানন্দ দাশও প্যাঁচাকে বিশেষভাবে শীতরাতের ভয়বাহী মিথরূপে নির্মাণ করে তুলেছেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দে যখন সন্ধ্যা নামে তখন নেমে আসে ভয়ের মিথ, শীতলতার মিথ নিশিজাগা প্যাঁচা-পাখি।

শীতকে তপস্যাব্রত মৌন সাধকের চিত্রকল্পে তুলে ধরেছেন অধিকাংশ কবিই। জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল শীতকে মাঘ-সন্ন্যাসী বলে উল্লেখ করেছেন। ফাগুনের আগমনে মাঘের বিদায়ে কবি ব্যথিত হন। মাঘ-মুনিবর যেনো আপন অধিকার হারিয়ে প্রকৃতি-প্রপঞ্চ ছেড়ে যেতে গিয়ে বেদনা-নিমগ্ন হয়ে ওঠেন। ‘শীত’ কবিতায় কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শবাসনে প্রলয়-সাধনে মগ্ন সন্ন্যাসীর চিত্রকল্প এঁকে বলেন,

‘কে তুমি সন্ন্যাসী!

বর্ণ-গন্ধ-গীত-বিচিত্রিত জগতের নিত্য প্রাণস্পন্দ,

কি স্বতন্ত্র মায়ামন্ত্র বলে পলে পলে হয়ে আসে বন্ধ

মরণের আবাহন তরে কেন এই তীব্র আরাধন-চেষ্টা

সর্বনাশী

বর্ষপরে বিশ্বজুড়ে বসিলে আবার, হে রুদ্র সন্ন্যাসী।’

(যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত/‘শীত’)

জসীমউদ্দীন তাঁর ‘কাল সে আসিবে’ কবিতায় শীতকে তাপসীরূপে বিবেচনা করে রিক্তদেহে মৌনব্রতে মগ্ন থাকতে দেখে বলেন,

‘শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?/হয়তো দেখিবে, হয় দেখিবে না, কাল সে আসিবে চরে,/এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।’ (জসীমউদ্দীন/‘কাল সে আসিবে’)।

মধ্যযুগের ‘মঙ্গলকাব্য’-তেও শীতের কাঁপন লেগেছে ভালোভাবে। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘চ-ীমঙ্গল কাব্য’-তে নায়িকা ফুল্লুরার মুখ দিয়ে শীতঋতুকে স্মরণ করেছেন। শীত এখানে ঋতু নয়, বরং দুঃখের মিথ, দুর্দশার চিত্রকল্পরূপেই এসেছে। শীতের পাতাঝরা শীতল দিনের মতোই দুখিনী নায়িকার দিন কাটানো বুঝাতে গিয়ে কবি শীতের রূপক টেনে এনেছেন তার মঙ্গলকাব্যে। কবির ভাষ্যে আমরা তাই ফুল্লুরার বিলাপ ধ্বনি শুনতে পাই,

‘শুন দুঃখের কাহিনী শুন দুঃখের কাহিনী।

পুরান দোপাটা গায়ে দিতে করে পানি

পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন

তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ।’

তিরিশের পঞ্চপা-বের তারকা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শীতকে কবিতায় কুয়াশা-মোড়ানো দেখতে পাই। খেয়াঘাট থেকে প্রণয়-প্রহর অব্দি সবখানে শীতের মিথ হয়ে ওঠে তার কাছে কুয়াশাবৃতা প্রকৃতি। তার ‘অনিকেত’ কবিতায় আমরা তাই দেখতে পাই, তিনি বলছেন,

‘ঘোচে না সংশয়

তোমারে নেহারি কি না প্রসারিত মাঠে

প্রত্যুষের কুয়াশায় ঢাকা খেয়াঘাটে

গৃহগামী কৃষকেরা যাবে সন্ধ্যাবেলা

জটলা পাকায়’। (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ‘অনিকেত’)

তিরিশের অন্যতম কবি-পা-ব ‘প্রতিভাপতি’ বুদ্ধদেব বসু শীতকে মাতৃগর্ভের মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে করেন। তিনি সৃষ্টিশীলতার অন্তহীন আহ্বান জানিয়ে বলেন,

‘কোথাও আলো নেই,

তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য

প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।

(বুদ্ধদেব বসু/‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’)

এই শীতে বরং কবি বুদ্ধদেব বসু নিজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আকাক্সক্ষা করে বলেন,

‘আমি যদি মরে যেতে পারতুম

এই শীতে,

গাছ যেমন মরে যায়,

সাপ যেমন মরে থাকে

সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে।’

শীত মানেই কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। কেউ খায় পিঠা-পুলি, কেউ মরে উত্তরী বায়ের চাবুকাঘাতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় এ সত্যকে পরিস্ফুটিত করেছেন অনন্য বাস্তবতায়। রাজার মহিষী নিজের শীতবিলাসের জন্যে প্রজার কুঁড়েঘর জ্বালিয়ে আগুন পোহান যখন মাঘের প্রবল শীতে প্রচ- ঠা-ায় কাঁপতে থাকে অনিকেত প্রজারা। কবিগুরুই আবার ‘উদ্বোধন’ কবিতায় শীতে প্রণয়াভিসারের প্রয়াসে আবেগাক্রান্ত হয়ে বলেছেন,

‘ডেকেছো আজি, এসেছি সাজি, হে মোর লীলাগুরু-

শীতের রাতে তোমার সাথে কী খেলা হবে শুরু!

ভাবিয়াছিনু গতিবিহীন

গোধূলিছায়ে হল বিলীন

পরান মম, হিমে মলিন আড়ালে তারে হেরি?

উত্তরবায় কারে জাগায়, কে বুঝে তার বাণী-

অন্ধকারে কুঞ্জদ্বারে বেড়ায় কর খানি।’

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/‘উদ্বোধন’)

শীতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও কবিতায় কাঁপন তোলেন। তিনি দেহতাত্ত্বিক কবিতার তনুতে সাইবেরিয়ার অতিথি পাখিদের এঁকে দেখিয়ে শব্দবিন্যাসে বলেন,

‘শীতের সমূহ পাখি ক্ষিপ্ত লাফ

দিয়েছে তোমারই অমল যোনির পানে।

একটি স্বর্ণপাত পুড়ে উত্তরোত্তর ঘন-ধোঁয়া

ঠামহীন নিঃস্ব স্বর্গচূড়ে যায়

নীলিম বরফে বন্ধ অনাদিকালের সাইবেরিয়া-

পায়ের উপর থেকে ক্রমে শাল উড্ডীন মরালসম।

তোমার উজ্জ্বল ঊরু দেখে মনে হয় মরে যাবো।’

(শক্তি চট্টোপাধ্যায়/‘বৃক্ষের প্রতিটি গ্রন্থে’)

‘বিরাশির কবিতা’ নিয়ে কবি সানাউল হক মনে করিয়ে দেন শীতের খেজুর রসের কথা। তিনি ‘দুটি গাছ’ কবিতায় বলেছেন,

‘পাশেই খেজুরগাছ

সতেরটি শীতাতঙ্কের

সতেরটি অস্ত্রোপচারের

ক্ষতচিহ্ন-ইতিহাস

কালো-কালো দীর্ঘশ্বাস

বুকে-পিঠে নিয়ে নিরালে ঝিমায়

তার দিকে কে তাকায়?’

শীত কবি কাজী নজরুলকে করে দিয়েছে উন্মনা। বাঁধনহারা কবি উন্মনা হয়ে বলেছেন কবিতায়,

‘ঘর-দুয়ার আজ বাউল যেন শীতের উদাস মাঠের মতো,

ঝরছে গাছে সবুজ পাতা আমার মনের-বনের যত।’ উন্মনা শীতে কবি পউষের জয়গানে মুখরিত হয়ে ওঠেন। পউষ যেনো কুজ্ঝটিকার ঘোমটা পরা রহস্যাবৃত রমণীবিশেষ। পউষের আগমনে আনন্দিত কবি দুখু গানের সুরে নেচে নেচে বলেন,

‘পউষ এলো গো!

পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে

ঐ যে এলো গো-

কুজঝটিকার ঘোম্টা-পরা দিগন্তরে দাঁড়ায়ে।।

সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়

বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,

অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়

পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।’

কবিতায় শীত মিথের ঋতু, শীত বেদনার ঋতু। শীত মানেই কবিতার মৌনব্রত, শীত মানেই কবিতার তপস্যামগ্নতা। শীতের হাওয়ার কবিতা যেমন কেঁপে ওঠে তেমনি কবিও আন্দোলিত হয় শীতের কুয়াশায়-শিশিরে। শীত নিয়ে কবির যেমন উচ্ছ্বাস নেই তেমনি নীরবতাও নেই। শীতকে কবিরা ধারণ করেন প্রকৃতির রোদন-রিক্ততায়, মৃত্যুময় বিমূর্ততায়। শীত কোনো কবিরই একক ঋতু নয়, শীত সবারই কিঞ্চিৎ করে হলেও মনোযোগ পেয়েছে। এই স্বল্প মনোযোগ পেয়েই কবিতাকে শীত কাঁপিয়ে দিয়েছে শীতের হাওয়ায়, কুয়াশার কুজ্ঝটিকায়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়