বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিতর্কের অ আ ক খ
ইসমাইল হোসেন সিরাজী

প্রবাদ আছে ‘কথার গুণে বিশ্বজয়, কথার গুণে বিশ্বলয়’। গোছানো কথার জয়জয়কার সবখানেই, গণমাধ্যম প্রভাবিত আজকের যুগে যৌক্তিকভাবে গুছিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারাটা অতি জরুরি। প্রকৃতপক্ষে, বিতর্ক একটি নান্দনিক বাচিকশিল্প। বিতর্ক হচ্ছে প্রাচীনতম শাস্ত্র, যার জনক ডেমস্থেনীস। আজ সনাতনী বিতর্কের কিছু মৌলিক ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করবো।

সনাতনী বিতর্কে বক্তাদের ভূমিকা

* পক্ষ দল

১ম বক্তা : প্রস্তাবনা উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করবেন।

২য় বক্তা : উপস্থাপিত প্রস্তাবনাকে শক্ত প্রপঞ্চে যুক্তি দিয়ে সংস্থাপিত করবেন।

দলনেতা : সংস্থাপিত প্রস্তাবকে প্রসারিত করে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

* বিপক্ষ দল

১ম বক্তা : উপস্থাপিত প্রস্তাবনা ও ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন।

২য় বক্তা : পক্ষ দলের সকল যুক্তি সংহার করে সপক্ষীয় দলনেতার পথ সুগম করবেন।

দলনেতা : বিতর্কের সারমর্ম আলোচনায় পক্ষ দলের ত্রুটি সংশোধন করে দিবেন।

মোটের উপর, সনাতনী বিতর্কে উভয় পক্ষের ২য় বক্তার ভূমিকা কিছুটা আক্রমণাত্মক।

বিতর্কের স্ক্রিপ্ট তৈরি

বিতর্কের স্ক্রিপ্ট সাধারণত ৩ প্রকার।

প্রাথমিক স্ক্রিপ্ট : বিতার্কিক কেবলমাত্র তার মেধা ও চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে যে স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করেন, তা-ই প্রাথমিক স্ক্রিপ্ট।

চূড়ান্ত স্ক্রিপ্ট : পত্র-পত্রিকা বা রেফারেন্স বইয়ের সাহায্যে তত্ত্ব, তথ্য ও যুক্তিনির্ভর যে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে তা-ই চূড়ান্ত স্ক্রিপ্ট।

সংক্ষিপ্ত স্ক্রিপ্ট : চূড়ান্ত স্ক্রিপ্টের যুক্তির শিরোনামকে একটি স্ক্রিপ্টে তুলে নিয়ে মঞ্চে আসেন তাই সংক্ষিপ্ত স্ক্রিপ্ট।

* স্ক্রিপ্ট ডায়াসে রাখুন, হাতে নয়। স্ক্রিপ্ট দেখুন একপলকে, নুয়ে নয়।

* যে যুক্তি আপনি দিতে পারেননি তা পরবর্তী বক্তাকে সরবরাহ করুন।

বিতর্কে বিরোধিতা

বিতর্কের বিরোধিতা নিছক কোনো বিরোধিতা নয়। এটি একটি শিল্প। কোনো বক্তার বিরোধিতা বিভিন্নভাবে করা যায়। তবে বিতার্কিকের বিরোধিতা হতে হয় দূরদর্শী চিন্তাপ্রসূত। এই বিরোধিতায় আবেগ নয়, যুক্তির প্রাধান্য থাকা জরুরি।

বিতার্কিকের বিরোধিতা মূলত কী? বিতর্কে বিরোধিতা হলো প্রতিপক্ষের কোনো মত বা সমাধান অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান দ্বারা প্রতিস্থাপন করা। এক্ষেত্রে কেবল বিরোধিতা করলেই হয় না, তার একটি সমাধানও দিতে হয়।

বিতর্ক তখনই খুব উপভোগ্য হয়ে উঠে যখন উভয়পক্ষ খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। অর্থাৎ তারা যখন উভয়েই বিরোধিতার জায়গাটাকে ছোট করে আনে তখনই বিতর্ক হয়ে উঠে প্রাণবন্ত এবং চিত্তাকর্ষক। একটি প্রস্তাবনার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে বিতর্কে জয়ী হওয়া কঠিন। সম্পূর্ণ প্রস্তাবনা নয়, বরং প্রস্তাবনার অংশবিশেষের সাথে বিরোধিতা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ধরা যাক, কোনো বিতর্কে একটা প্রস্তাবনা ছিলো ‘হরতাল বন্ধে কঠোর আইন নয় জনসচেতনতা দরকার’। এই বিতর্কে বেশ কয়েকভাবে বিরোধিতা করা যায়। যেমন :

ক) হরতাল আদৌ বন্ধ করারই দরকার নেই। হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার ও নির্যাতিতের প্রতিবাদের ভাষা।

খ) হরতাল বন্ধে কঠোর আইন দরকার। এটাই সহজ। জনসচেতনতা তৈরি করা কষ্টসাধ্য।

গ) হরতাল বন্ধে কঠোর আইনের দরকার নেই। বিদ্যমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই যথেষ্ট।

ঘ) জনসচেতনতা দ্বারা হরতাল বন্ধ করা যায় না, কমানো যায়। কমানো আর বন্ধ করা সমার্থক নয়। কঠোর আইন ছাড়া হরতাল বন্ধ করা সম্ভব নয়।

ঙ) হরতাল বন্ধে জনসচেতনতার পাশাপাশি কঠোর আইনও দরকার।

উপরোক্ত উদাহরণে দেখা যায়, শেষ উপায়টিতে পক্ষ এবং বিপক্ষ দলের দূরত্ব সবচেয়ে কম। এখানে বিরোধিতাকারী ও পক্ষদলের মধ্যে হরতাল বন্ধ করার পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে। জনচেতনতার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকৃত হয়েছে। কেবল কঠোর আইনের বিষয়ে দ্বিমত রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বিপক্ষকে বুঝতে হবে, বিদ্যমান যে আইন তাতে ফাঁক আছে অনেক। তাই ফাঁক গলে পার পেয়ে যায় হরতালের তাণ্ডবকারীরা। এই আইনের দীর্ঘসূত্রিতাও লক্ষণীয়। এই কারণে বিদ্যমান আইন হরতাল বন্ধে যথেষ্ট নয়। এমন কঠোর আইন দরকার যাতে হরতালকারীর শাস্তি অল্পসময়েও দৃষ্টান্তমূলক হয়। এর ফলে অন্যদের মধ্যে হরতালের বিষয়ে ভীতি ও সমীহ তৈরি হবে এবং এক সময় হরতাল বন্ধ হয়ে যাবে।

বিরোধিতা মানেই একটা ভিন্ন সমাধান। বিরোধিতা মানেই অন্যের চিন্তনের বাতায়ন খুলে দেওয়া। বিরোধিতা মানেই সহজ ও সঠিক পন্থা অবলম্বন। কাজেই বিতর্কে বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে বক্তাকে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলিত ব্যবহার করতে হবে। বুদ্ধিমান বিতার্কিক সর্বদা বিরোধিতার ক্ষুদ্রতম ও স্বচ্ছ পথটিই বেছে নেন।

সনাতনী বিতর্কের কিছু মৌলিক নিয়ম

১) বিতর্কের শুরুতে বাহুল্য বর্জিত সম্বোধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সম্মানিত সভাপতি বা মডারেটর বলেই বিতর্ক শুরু করুন।

২) বিতর্কের সব থেকে শক্তিশালী যুক্তিগুলো শুরুতে দিন। তবে যুক্তিখণ্ডনের মাধ্যমে বিতর্ক শুরু হলে তা হেলায় হারাবেন না। কারণ আক্রমণ বিপক্ষ দলকে নাস্তানুবাদ করার শ্রেষ্ঠ পন্থা।

৩) বিতর্কের মাঝে সম্মানিত প্রতিপক্ষ, মাননীয় প্রতিপক্ষ, বিজ্ঞ প্রতিপক্ষ ইত্যাদি শব্দ বর্জন করুন।

৪) বাংলা বিতর্কে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার পরিহার করুন।

৫) স্ত্রিপ্ট লিখে নিতে ছোট ছোট কাগজ ব্যবহার করুন, যা হাতের তালুতে রাখা যায়।

৬) মনে রাখবেন, বিতর্ক যাতে পড়া না হয়, সেটি যাতে করা হয়।

৭) বিতর্কে অবশ্যই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার পরিহার করতে হবে।

৮) ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথা থেকে বিরত থাকবেন।

৯) সময় সম্পর্কে সচেতন থাকবেন।

১০) যুক্তিখণ্ডন পর্বে কোনো নতুন যুক্তি উপস্থাপন করবেন না।

১১) দাঁড়াতে হবে ভদ্রতার সাথে, রাজনৈতিক নেতাদের মতো করে নয়। বিতর্ক করার সময় আঙুল না নাচিয়ে হাতের কিছু সাবধানি ও শালীন ব্যবহার করা যাবে।

১২) প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে বিতর্কে হালকা রম্যরসের অবতারণা করা যেতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেনো কোনোভাবেই ভাঁড়ামির পর্যায়ে না যায়।

১৩) যে যুক্তির পেছনে কোনো প্রমাণ বা উদাহরণ নেই তা উপস্থাপন করা উচিত নয়।

১৪) বিতর্ক করতে হলে জানতে হবে, জানতে হলে পড়তে হবে, পড়তে হলে জ্ঞানপিপাসু হতে হবে।

১৫) সুন্দর উপস্থাপনের জন্যে চোখের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বক্তব্য অনুযায়ী কখনো মডারেটরের দিকে কখনো বিচারকদের দিকে কখনো প্রতিপক্ষদের দিকে কখনো দর্শকদের দিকে তাকাতে হবে।

বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের খেলা। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনার সময় স্বাভাবিকভাবেই ভিন্নমতের কারণে দুই বা ততোধিক পক্ষ তৈরি হয়ে যায়। নিজের মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যুক্তি প্রদান করে তা প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পারাই একজন বিতার্কিকের প্রধান কাজ। এর জন্যে প্রয়োজন কিছু কৌশল, শ্রম আর অনুশীলন।

বিতর্ক একই সাথে পড়া, লেখা, শোনা ও বলার সংমিশ্রণ। এই একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আরো অনেক বিষয়ে (যেমন : পাবলিক স্পিকিং, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি) দক্ষ হয়ে ওঠা যায়। বিতর্কের কারণে যে আত্মবিশ্বাস জন্মে তা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক কাজে লাগে। তাই সব পেশার সকল মানুষের জন্যে বিতর্কে দক্ষতা থাকা উচিত।

একজন বিতার্কিক কখনোই শুধুমাত্র বিতর্কের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেন না। ছড়িয়ে পড়েন উপস্থাপনা, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতাসহ বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে। ফলে খুব দ্রুতই তার ঘর ক্রেস্ট-ট্রফিতে ভরে ওঠে! এজন্যে হলেও বিতর্ক শেখা উচিত। একুশ শতকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবহেলা না করে এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।

ইসমাইল হোসেন সিরাজী : খণ্ডকালীন প্রভাষক (ইংরেজি), চেড়িয়ারা স্কুল এন্ড কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়