প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে প্রজন্ম বিনির্মাণ। সঠিকভাবে পরবর্তী প্রজন্ম যদি তৈরি করা না যায় তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অন্ধকার। প্রজন্ম বিনির্মাণে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে বিতর্ক শিল্পের চর্চা ও প্রসার। বিতর্ক নিয়ে আজকের প্রজন্মের ভাবনা সৃজনশীল ও সুসংহত। আজকাল বিতর্ককে এক চমৎকার বিনোদন মাধ্যম হিসেবে বিকশিত করে তোলা হচ্ছে। আজকের বিতর্কে সিরিয়াস জ্ঞানের চর্চা যেমন আছে, তেমনি আছে চটুল বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক মজা তৈরির প্রয়াস। সকল কিছুকে ছাপিয়ে আজকের প্রজন্ম বিতর্ক চর্চার মধ্যে দিয়ে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে চায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে আজকের প্রজন্ম নিজের প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে বিতর্ক চর্চায় নিবেদিত হয়ে উঠেছে।
প্রজন্মের বিতর্ক ভাবনায় আজকাল প্রমিত ভাষার চর্চার চেয়ে তাৎক্ষণিক লোকপ্রিয় শব্দমালায় প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রবণতা অধিক লক্ষণীয়। অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমা এই যুগে আজকের প্রজন্ম নিজেকে তৈরি করার আগেই প্রচারের আলোয় আসতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠেছে। ফলে অপরিণত শিল্প-ফসলে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বিতর্ক-মঞ্চ। আজকাল বিতর্ককে শিল্প হিসেবে না দেখে বরং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে কেউ কেউ ব্যবহার করছেন। অনেকটাই কতিপয় বাবা-মা যেমন পারুক না পারুক ইংরেজি মিডিয়ামে বাচ্চাকে ভর্তি করিয়ে তাদের মুখে ইকিরি-মিকিরি বোল ফুটাতে চায়, সেরকমই। মাত্র তিন মাসের বিতর্ক প্রশিক্ষণ দিয়ে কেউ কেউ নিজেদের বিতর্কে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার তৃপ্তি ও প্রশান্তি পেতে চায়। এক্ষেত্রে বলা ভালো, শিল্পের সকল ক্ষেত্রে অর্থের মহাযজ্ঞ যেমন সমর্থিত নয় তেমনি অর্থের অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগে শিল্পের প্রকৃত অর্থে কোনো উপকার হয় না। শিল্পের সকল ক্ষেত্রেই নতুনত্ব সন্ধানী যারা, তারা শিল্পের ধ্রুপদীয়ানাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাশ্চাত্য-ঘরানার রিমিক্স বা ফিউশন আমদানি করার কারণে শিল্পের বনেদীয়ানা হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক পুঁজিবাদের দাস। অথচ বিতর্ক শিল্পের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পুঁজিবাদের দাস হিসেবে শিল্পের মুখে চুনকালি মাখানো নয় বরং শিল্পের বনেদীয়ানা রক্ষায় যুক্তিশিল্পের বিকাশ ও বিস্তার।
বিতর্কের প্রমিত রূপকে সুরক্ষা দিতে না পারলে ভবিষ্যতে বিতর্ক হয়ে যাবে কর্পোরেট মাফিয়াদের হাতের পুতুল। তারা স্পন্সরের নামে বিতর্ককে নামিয়ে আনবে টি-২০ খেলার স্তরে, যেখানে মনে হবে, বিতর্ক মানেই চটুল বিনোদন। অথচ বিতর্ক বিনোদন মাত্র নয়। বিতর্ক হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির উদ্ভাসন। যেখানে চিন্তার গভীরতা থাকবে এবং জ্ঞানের স্ফূরণ হবে। বিতর্ক কেবল মঞ্চ মাতানো যেমন নয়, তেমনি বিতর্ক মানে রম্যতাও নয়। বিতর্কের প্রমিত রূপকে হানি না করেই এ শিল্পের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। বিতর্কের বিনোদন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের বিনোদনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে না। বিতর্কের বিনোদন হবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিনোদন। দাবা খেলায় একটি ভালো চাল উদ্ভাবনের আনন্দের মতোই বিতর্কে একটা ভালো যুক্তি প্রয়োগের স্বস্তি মেলে। মুক্তচিন্তার মাধ্যমে বিতর্কের জ্ঞানকে প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করাই হলো বিতর্কের মুখ্য উদ্দেশ্য। সে জায়গায় মাত্র তিনমাসে কাউকে বিতর্কে স্নাতক তকমা লাগিয়ে দিলে তা শিল্পের জন্যে ক্ষতিকর বৈকি। এজন্যে বিতর্ক শিল্পের পরিচর্যা দরকার। সনাতনী বিতর্ক হলো বিতার্কিকের বীজতলা তৈরির ক্ষেত্র। ভালো বীজ না হলে যেমন ভালো চারা হয় না, তেমনি ভালো বীজতলা না হলে ভালো ফসলও উৎপন্ন হয় না। কাজেই বিতর্কের ভালো ফসল গোলায় ভরতে গেলে সনাতনী বিতর্ক চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সনাতনী বিতর্ক চর্চায় ফাঁকিবাজি তৈরি হলে তা দিয়ে চটকদার বিতার্কিকই শুধু তৈরি হবে, জাতির সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হবে না।
রিয়েলিটি শো’র মতই ধীরে ধীরে যুগের অস্থিরতা বিতর্ককে গিলে খাচ্ছে। সঙ্গীত প্রতিভা অন্বেষণের নাম দিয়ে মিডিয়া মোগলরা যেমন নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করে চলেছে, ঠিক তেমনিভাবে আজকাল কতিপয় সংগঠন নিজেদের সামাজিক মূল্য নিরূপণে এরকম চটকদার নাম দিয়ে বিতর্কের আয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। সেখানে বিতর্কের চেয়ে তারকামুখের প্রাধান্য দেখা যায়৷ বিতর্ক থাকে অন্দর মহলে গোপনে-গহীনে। আর গৌণ বিষয়গুলো মাতিয়ে তোলে মঞ্চ। বিতর্কে রম্য বিষয়টা ঢুকিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে ফুটপাতের ক্যানভাসারের ক্যারিকেচারে পরিণত করে তোলা হয়েছে। সনাতনী বিতর্কের গুরুত্বকে হাল্কা করে দিয়ে আজকাল যা করা হচ্ছে তাকে আর যাই হোক বিতর্ক বলা যায় না, বরং বলা ভালো, এসব চটুল কবির লড়াইয়ের মতো।
আসলে বিতর্ক বিষয়টাই এমন, যাতে একটা দূরদর্শী পরিণাম বা ফলশ্রুতি তৈরি হয়। সুতরাং এটি তাৎক্ষণিক কোন বিষয় নয়। একদিনে আটদলের একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্যে তাৎক্ষণিক উপস্থিত বক্তৃতার আদলে যা করা হয় তা মূলত বিতর্ক নয়। তা হয়ে যায় অনেকটাই স্টান্টবাজির নামান্তর। একটা বিতর্কে প্রস্তাবনায় বর্ণিত সমস্যার কারণ, চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা উত্তরণে সমাধান নির্দেশ করা জরুরি। এসব করতে হলে গভীর ও নিবিড় অধ্যয়ন এবং পঠন-পাঠন আবশ্যক। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিষয় দেওয়া হলে তাতে বাকশিল্পী তৈরি করা গেলেও সত্যিকারের বিতার্কিক তৈরি হবে না। একটি উপযুক্ত ও মানসম্পন্ন বিতর্ক মঞ্চায়ন করতে গেলে বিতর্কশিল্পীদের যথাযথ প্রস্তুতি দরকার। এটি ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা নয় যে খেলা শুরুর পনর-বিশ মিনিট আগে টস করে খেলা শুরু করে দেওয়া যায়। এখানে বিতর্কের উদ্দেশ্যই হলো সঠিক সমাধান বের করা। কাজেই তার জন্যে যথাযথ প্রস্তুতি দরকার, যা কেবলমাত্র পনের মিনিটে সম্ভব নয়।
তাই আজকের প্রজন্মের বিতর্ক ভাবনায় বিতর্ককে সাধনা ও অধ্যয়নের কার্যকর পন্থা হিসেবে ধারণ করা জরুরি। বিতর্ক মানুষের চিন্তাকে বিকশিত করে এবং প্রকাশিত করে। এই চিন্তাকে আজ যারা জলো এবং খেলো করার প্রবণতায় পাড়ার টেপ টেনিস ক্রিকেটের মতো প্রতিযোগিতার আয়োজন করছেন, তারা এই নান্দনিক ও গভীর শিল্পটাকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন।
আজকের প্রজন্মকে এই ভুল ধারণা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাদেরকে প্রকৃত বিতার্কিক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে সবাইকে আত্মনিবেদন করতে হবে। তবেই বিতর্কের প্রকৃত জয় হবে।
লেখক : উপদেষ্টা, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ও চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন; অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি।