প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
ঝিলের এক কোণায় গিয়ে গভীর ভাবছে তেলাপিয়া। রাঘব-বোয়াল শিং, পুঁটি, বাইঙ্গ, রুই-কাতল সবাই তো আমরা মাছ। তবে কেনো এতো ভেদাভেদ! সবার দেহেই একই পদার্থ দিয়ে তৈরি। এক মালিকের ঝিলেই আমরা বসবাস করি। একমাত্র তিনিই আমাদের খাদ্য দেন। তবে কেনো এতো অহঙ্কার বড় মাছের? বুঝতে পারে না তেলাপিয়া। তার আজ মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
সে ভাবছে, ইশ্, যদি আজ দাসেরা মাছ ধরতে আসতো, তবে আমি ইচ্ছে করেই নিজেকে ধরা দিতাম। যদি কোনো অভাবী হাত দিয়ে মাছ ধরতে আসতো, তবে আমি তার হাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম। যদি কোনো সৌখিন মানুষ বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে আসতো তাহলেও তার সুখের অংশী হতাম।
তেলাপিয়া এতোটা দুঃখিত হয়েছে যে, কি করবে, কি করছে, কি ভাবছে সে নিজেই জানে না। অধিকাংশ প্রাণিই রেগে গেলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তো তেলাপিয়াও দাসের জালে ধরা দিয়ে আত্মহত্যা করতে চায়। অথচ সে জানে এটা আরো বড় ভুল, আরো বড় পাপ। যে সামান্য কষ্টে পানির নিচে থাকাটা সে এখন যন্ত্রণা মনে করছে! অথচ সে ডাঙ্গায় উঠে আসলে আরো বড় কষ্ট। যেখানে কাটাকাটি থেকে শুরু করে আগুনে পোড়া, ভাজা আরো কত কিছু সহ্য করতে হবে। যার শুরু আছে শেষ নেই।
একটা পথিক এক টুকরা কারেন্ট জালের ফাঁদ ফেলেছে। তেলাপিয়া জানে এটায় লাগলেই মারা যাবে। ওর বিপরীত সরপুঁটি একদিন সব ধরনের জাল সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিলো।
ধীরে ধীরে তেলাপিয়া জালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ সে মরবেই। হঠাৎ করেই পাঙ্গাস এসে বাধা দেয় তেলাপিয়াকে।
-এই সামনে কারেন্ট জাল, যেও না। লাগলেই আটকে যাবে। মারা যাবে।
-জানি, আমি মরতেই চাই। এই ঝিলে বেঁচে থেকে কি হবে?
-কি হয়েছে বলতো।
-না, বলার ইচ্ছে নেই।
-আরে বললে হালকা লাগবে। যে কোনো কষ্টই অন্য কারো কাছে শেয়ার করলে হালকা লাগে, কষ্ট কমে যায়।
-তা ঠিক। কিন্তু অনেকেই তা অসহায়ের সুযোগ নেয়। কেউ কেউ বন্ধু সেজে গোপন কথা জানে। অতঃপর বিভিন্ন কারণে ফাঁস করে। ফলে আরো কষ্ট বেড়ে যায়। এর চেয়ে না বলাই ভালো।
-একদম ঠিক বলেছ। এজন্যেই আমি নিজের গর্তে লিখে রাখি। সেটা নিষ্প্রাণ। সে আমাকে কথা শোনায় না। বরং আমার কষ্ট তার বুকে ধারণ করে আমার দুঃখ উড়ায়। তুমিও লিখে রাখো।
-আমি লিখতে জানি না।
-তবে আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারো।
জানো কি তেলাপিয়া?
‘বিশ্বাসে স্বর্গবাস। অবিশ্বাসে নরকবাস’
-বুঝলাম। শোনো, তাহলে...
সরপুঁটির সাথে আমার গভীর প্রেম ছিলো। একদিন ওর ভাই সব জানতে পারে। আমাকে ডেকে নিয়ে বড় বড় মাছ দিয়ে মারধর করে। আমাকে গায়েব করে দেয়ার হুমকি দেয়। আমাকে নানা রকমের কথা শোনায়। অহঙ্কার করে বলে, আমরা ছোট জাত। তারা বড় জাত। বাজারে তাদের প্রচুর চাহিদা। আমি তার বোন থেকে সরে আসতাম। আমার বাজারে রূপ নেই, দাম নেই, তাছাড়া আমি আকারে ছোট। তাদের সাথে নাকি আমার যায় না।
-যারা জাত, বর্ণ, দাম নিয়ে অহংকার করে তারা বোকা ছাড়া কিছুই না। জানো কি তেলাপিয়া আমরা ছোট জাত হয়েই ভালো আছি। ওদের অর্ধদিন আগে আমরা মুক্তি পাবো। ঝিলের মালিক আমাদের দর্শন দিবেন। এই অর্ধদিন, কত সময় জানো? প্রায় পাঁচশত বছর।
-সত্যি বললে?
হ্যাঁ গো সই সত্যি। শুধু তাই নয়, আত্মহত্যা করলে তুমি মরেও শান্তি পাবে না। বরং আরো জ্বলতে হবে তোমাকে। তারচেয়ে বরং এ ঝিলেই শান্তি। মালিকের রহমত খুব কাছেই। ধৈর্য্য ধরলে তুমি অচিরেই সুসংবাদ পাবে, পাবেই।
আমাদের সবচেয়ে বড় রহমত হলো সেই সময়ে। যেই সময় এই পানিগুলো শুকিয়ে যাবে। তৃণলতাগুরো মরে যাবে। পানিতে থাকা সমস্ত পোকাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। রাঘব-বোয়ালগুলো সেদিন থাকবে না। শুধু মালিক থাকবে। আর ভালো মাছেরা।
-আজ থেকে তবে আমি নতুন করে বাঁচবো। আমি ছোট জাত বলে নিজেকে অবহেলা করবো না। নিজেকে খুব ভালোবাসবো।
-শুনে খুশি হলাম। সই, যদি কিছু না মনে করো, একটা কথা বলবো?
-তোমার যতো ইচ্ছা আমাকে কথা জিজ্ঞেস করতে পারো।
-তুমি কি তাকে জানাও নাই, তার ভাই, তোমার সাথে কি কি করেছে?
-তাকে সব বলে দেয়ার জন্যে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার কারণেই পারিনি। একটা সময়ে তার সাথে সব শেষ হয়ে যায়।
হঠাৎ করে আজই জানতে পারলাম ওর সবচেয়ে কাছের মাছের কাছে। ওর নাকি আমার সাথে কিছুই ছিলো না। শুধু পরিচিতই ছিলাম এবং আমি কোনোভাবেই ওর যোগ্য না। তাই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আরো জানতে পারলাম, সে শোল মাছের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাই আমি আজ মরতে চেয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা। এখন কি মরবে?
-না। আমার কাছে জরুরি, আমার মালিকের সাথে দেখা করা।
তোমাকে একটা কথা বলি, শোল মাছ খারাপ। তুমি সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করবা যাতে তোমার প্রিয়র সাথে খারাপ কিছু না হয়। শোল মাছ সুযোগ পেলেই ওর চাহিদা মিটাবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ওদের সম্পর্কটা বাদ দিতে পারলে। তুমি যাই কিছু করবে, দূর থেকে করবে। কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে।
-ঠিক আছে, সই।
-আর হ্যাঁ, তোমার উচিত অপেক্ষা করা। অপেক্ষা কঠিন হলেও ভালো। প্রকৃত মাছ হলে ফিরে আসবেই। আর না আসলেও ক্ষতি নেই, ক্ষমা করবে। ক্ষমার চেয়েও বড় প্রশান্তি আর কিছুতে নেই।
হঠাৎ করেই ঝিলের পানি কমে এসেছে। একেবারে কম। কাঁদা আর পানি এক সমান। সব মাছেরা লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। পাঙ্গাস বুঝতে পারে, আর আমাদের সময় নাই। মালিক হয়তো আমাদের প্রত্যাবর্তনের ডাক দিয়েছে। যেই মাছেরা একটু আগেও ঈমান এনেছে। তারাই সফলতা পেয়েছে। ঝিলের পানি ইতিমধ্যেই উদাও! অতঃপর পাঙ্গাস তেলাপিয়াকে বললো, কাতলা মাছ একদিন বলেছিলো, মাছেদের শেষ সময় যখন আসবে। সেদিন হঠাৎ করেই ঝিলের পানি শুকিয়ে যাবে। কিছু বোঝার আগেই আমরা বেহুঁশ হয়ে যাবো। তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে! জানি না সেই সময়ে চলে এসেছি কি না, তওবা করা জরুরি। এসো তওবা করি।