প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২১, ০০:০০
পুকুরপাড়ের শানবাঁধানো সিঁড়িতে নিশ্চুপ বসে আছি। শব্দের মাঝে চেনা অচেনা পাখির সরব কলকাকলি আর পাতা ঝরার ঘোরলাগা আওয়াজ।
আজ ছয় বছর পর গ্রামে আসা। সোনাপুর, সোনায় ঢাকা না হলেও এর সোনারঙা ফসল আর সোনালি ঐতিহ্য শত্রুও স্বীকার করতে বাধ্য। শহরতলী থেকে খুব দূরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম না যে সময়ের অভাবে আসা হয়নি, বরং বলা যায় বেশ কাছেই। হেমন্ত ঋতুতে তো বাড়ির উঠোনে পর্যন্ত গাড়ি যায় আর সময় লাগে ঘড়ি ধরে মাত্র বিশ মিনিট। তবু কেন আসিনি?
কি জানি প্রচ্ছন্ন অভিমানে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে।
আপনাতে নিমগ্ন সময়টায় কত ছবি, দৃশ্যপট সবেগে পরিবর্তিত হচ্ছিল তার কোনো লেখাজোখা নেই। নিবিড় অনুভবের সঙ্গী অনেকেই ছিল, শিমুল গাছ ছিল যেখানে এখন কেবল তার সোঁদা মাটি, পাতালেবুর ছায়াঘন উঠোনের একপাশ শূন্য।
কে যেন কেটে ফেলেছে শিমুলগাছ, সেই শূন্যস্থানে কিছু দেখা যাচ্ছে, হ্যাঁ এইতো সৌম্য, সুন্দর মাঝবয়সী একজন মানুষ লম্বা বাঁশ দিয়ে শিমুলগাছে নাড়া দিতেই কেমন তুষারপাতের মতো উড়ে উড়ে আসছে তুলা। পেটমোটা কলার মতো কালো রঙের খোসা ফেটে ভেতরের সাদা তুলতুলে তুলা উড়ছে আর তার পেছনে আনন্দে ঝলমল করে উড়ছে ছোট্ট একটা মেয়ে। উঠোনের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে মনের সুখে উড়ে যাওয়া তুলা জড়ো করছে। তারপর? আর কিছু নেই ঝাপসা।
ঠিক সামনে পাতাবাহার আর উঁচু সারি সারি নারিকেল, সুপারি গাছের বাগান। কী একটা গাছ জড়িয়ে বেয়ে বেয়ে মগডাল থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি বেতফল সাজিয়েছে তার পরগাছা সৌষ্ঠব। বাড়ির উত্তর দিকের ‘খলা’। যে সিঁড়িটায় বসে আছি সোজা হাতের ডানে অসংখ্য চেনা অচেনা গাছের বাগান ওখানটায় আকাশ ছুঁই ছুঁই করা দুটো সুপারি গাছে রশি বেঁধে মাঝখানটায় কাঠের খাট দিয়ে বানানো দোলনায় রশি যতদূর যায় ততদূর জোরে জোরে দোল খাচ্ছে চার বছর বয়সী পিচ্চি এক মেয়ে। দুলছে অবিরাম দুলছে, মেয়েটার ছবি ঝাপসা অস্পষ্ট কেন, কোন হাসির শব্দ শোনা গেল কি?
আর এই যে পুকুর, সাঁতার শিখতে নেমে পড়েছে কলাগাছ নিয়ে। মাঝপুকুরে ডুবতে বসেছিল প্রায়, সাঁতার না শিখেই পানিতে নামলে যা হয়; ছোট্ট হাত থেকে কলাগাছ ছুটে যাবেই তো। তারপর ছোট চাচা ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে আনায় বড় ফাঁড়া থেকে বাঁচা গেল।
বাড়ির উত্তর দিকটায় বিশাল আম গাছ, ঝড়ের দিনে কত আম কুড়িয়েছি, তার সংখ্যা আজ নিজেও বলতে পারব না। সেই মাটির ঘরটা আজ পাকা। ‘ফটিক’ এ বৃষ্টি বাদলার দিন কী সাবধানে পা টিপে টিপে যাওয়া লাগতো। এই বাঁশ ঝাড়ের পাশে টাকার গাছগুলো তো তাকে সাথে নিয়েই লাগিয়েছিলেন আব্বু ঐ ধারটায়। টাকার আবার গাছ হয় নাকি, এটা আব্বুর মজা করে বলা আমাকে চমকে দেয়ার জন্য। আসলে তো লাগিয়েছেন সুপারি গাছ, সে গাছগুলি গা ভর্তি সুপারি নিয়ে কী সুন্দর আকাশ ছুঁইছুঁই করছে।
আর গাঁয়ের মসজিদ একদম আগের মতো আছে, কোন পরিবর্তন নেই। আর হলেও বা সূক্ষ্ম পরিবর্তন, এতো জেনে কাজ নেই। আব্বুর স্পেশাল দাওয়াত ছিল মসজিদে একবার, শিরনি আছে যেতেই হবে শুনে সুযোগ বুঝে আমিও ঝুলে পড়লাম আব্বুর কাঁধে আমাকেও নিতে হবে। কলাপাতায় অল্প একটু ভাত আর গরুর গোশতের সাথে আস্ত আলুর মাঝখানে কাটা বড় টুকরা আর অল্প একটু ঝোল অমৃত, এখনো যেন স্বাদ মুখে লেগে আছে। আচ্ছা এখনো কি আগের মতো শিরনি হয়? না কালের বিবর্তনে সেও বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কে জানে!
কুসুম বুর কথা মনে পড়লো চা খেতে বসে। আহারে বেচারি, একবার আমাকে দুধ চা খাইয়েছিলেন আর বলেছিলেন তুইও তো লন্ডন চলে যাবি তাই না রে বোনের মত?
সহজ সরল মানুষের কেমন সরল কথাবার্তা। বুর জন্য যেন উপহার নিয়ে আসি!
উনার পরিচয়ই দেইনি দেখো, দাদাজান ছিলেন কুসুম বুবুর আম্মু আঞ্জু ফুফুর পালকপিতা। নোয়াখালীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আঞ্জু ফুফুর ফুফু তাকে দাদাজানের কাছে দিয়ে যান। তারপর তিনি এখানেই বড় হলেন, বিয়ে হল, মেয়ে হল এই কুসুম’বু। বাবা রগচটা, বোকাসোকা মানুষ কুসুম’বু ছোট থাকা অবস্থায়ই তাদের ছেড়ে চলে যায়। অতঃপর মা-মেয়ের সংসার।
সেই মাও মারা গেলেন, আর কুসুম’বু একবারে একা হয়ে বিকারগ্রস্তের মতো হয়ে গেলেন।
একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় পাশের লুণ্ঠন থেকে আগুন ধরে পুড়ে মারা গেলেন।
আমার আর উপহার দেয়া হলো না।
বাড়ির পেছনেই সুরমা নদী, এখন চর জেগে ভরাট, এরও ইতিহাস আছে কিন্তু আজকের দিনে বিশ্বাস করবে কেবল আদ্দিকালের বুড়ো কেউ যারা তখন বেঁচে ছিল তারাই।
সে যাকগে এই পলিমাটির জমিনে শসার ক্ষেত ছিল এইতো সেদিন, কচিশসা খেয়েছিলাম দিব্যি মনে আছে। ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে দ্রুত সাইকেল নিয়ে আসছিল, আর কোত্থেকে আসা ‘আমাকে’ অবাক দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে আমার ওড়না সাইকেলের চাকায় জড়িয়ে ফেললো। আর অপরাধী অনুভূতি চোখমুখে ফুটিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। ওড়না ছাড়িয়ে একটু প্রশ্রয়ের হাসি দিতেই ভোঁ দৌড়। শূন্যতা হাহাকার করা বাড়িটায় এখন কেবল ছোট চাচা থাকেন, কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকায় বিয়ে-শাদির দিকে নজর ছিল না। আজ নতুন চাচীকে দেখতে আসা।
মোকামের ইতিহাস বিশাল, অল্পকথায় বিভ্রান্তি বাড়বে বৈ কমবে না। তাই কথা বাড়াবো না, দাদাজানের কবরের ওপর কী টকটকে জবাফুল ফুটে আছে।
এ বাড়ির পূর্বপুরুষ নজাবত আলী খান, দাদাজান আব্দুল আজিজ খান আরো অনেক নাম না জানা শুয়ে থাকা ব্যক্তিরা, কবরের ওপরেই হরেক গাছের ফিসফিসানি, ডাহুকের ডাক কি তারা শুনেন? কিংবা এক অশ্রুস্নাত বালিকার বারবার প্রতিধ্বনিরত সালাম।