প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আমি যে স্কুলে পড়ি সে স্কুলটা বেসরকারি স্কুল। একদিন স্কুলে হঠাৎ করেই শিক্ষামন্ত্রী আসলেন পরিদর্শনে। কাউকে কিছু না জানিয়ে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ি এই এলাকাতেই। তাঁকে দেখে আমাদের প্রিন্সিপ্যাল স্যারের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে আর সমীহে অন্য স্যার-ম্যামরাও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যখন আমাদের ক্যাম্পাসে আসলেন তখন আমরা সকালের সমাবেশে দাঁড়িয়েছি। একটু পরেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হবে সমস্বরে সবাই মিলে। মন্ত্রী মহোদয় দাঁড়িয়ে সবার সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন মাইকে, এই গান কে রচনা করেছেন? আমরা সবাই একসাথে বললাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত করেছেন? আমরা সবাই বললাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের উত্তরে খুব খুশি হয়েছেন মনে হলো। তাঁর হাসি দেখে আমাদের সবার মনের ভয় কেটে গেল। বিশেষ করে আমাদের প্রিন্সিপ্যাল স্যারের। মন্ত্রী মহোদয়ের কথাগুলো খুব নরম আর শুনতে ভালো লাগলো। মনে হলো এমন করে যদি সবাই আমাদের জন্যে কথা বলতো! তাঁর বাবা নাকি বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলন করেছিলেন। তাই তাঁকে ভাষাবীর বলা হয়। একজন ভাষাবীরের মেয়ে হিসেবে তিনি খুব সুন্দর করে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাঁকে দেখে আমার কেন জানি বুক ভরা সাহস হলো। তিনি যেন আমাদের খুব আপন। মন্ত্রী মহোদয় সেদিন যাওয়ার সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বলেছিলেন, আমাদের স্কুলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এনে একদিন ক্লাস নেওয়ানোর জন্য। এই ক্লাসে স্কুলের সবাই উপস্থিত থাকতে হবে। আজকের শিশুদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্ম কীভাবে হলো তা যেন শেখানো হয়। পাশাপাশি স্কুলের পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে কথা লেখা আছে তা-ও আলোচনা হয়ে যাবে। মন্ত্রী মহোদয়ের এ কথায় সবাই হাতে তালি দিয়ে একমত পোষণ করলো।
আমাদের স্কুলের কাছেই স্টেডিয়াম রোডে একজন ডাক্তার নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তিনি বয়োবৃদ্ধ। অনেকটা দাদীর মতো দেখতে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'স্বাধীনতা পদক' এ ভূষিত হয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এমবিবিএস পাশ করে শিক্ষানবীশ চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেছেন মাত্র। এমবিবিএস হলো ডাক্তারী পাশের ডিগ্রি। আমাদের স্কুলের তরফ থেকে তাঁকে একদিন ক্লাস নেওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি সানন্দে রাজী হলেন। তাঁর একটা নাতনী ছিলো। ছেলের মেয়ে। তাকে নিয়েই তিনি অনেক অনুষ্ঠানে যান। নাতনী যেন তাঁর হাতের লাঠি। তিনি সকাল দশটায় আমাদের স্কুলে ক্লাস নিতে আসলেন। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল স্যার তাঁকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি একজন নামকরা ডাক্তার, মহিলা ও মায়েদের জন্যে। তাঁর হাতে নাকি অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে। আবার বাংলাদেশের জন্মেও তাঁর অংশগ্রহণ আছে। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি সরাসরি বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছেন? তিনি আমাদের প্রশ্ন শুনে হেসে দিলেন। বললেন, না না, আমি সরাসরি কোন বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করিনি। আমি নিজ হাতে কোন শত্রুসেনা মারিনি। তবে মারতে পারলে ভালো লাগতো অনেক। আমি আসলে যুদ্ধে যারা আহত হত তাদের চিকিৎসা দিতাম। বিশেষ করে হানাদার সৈন্যরা এদেশীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় যে সব মা-বোনদের ধরে নিয়ে অত্যাচার করতো, নির্যাতন করতো আমি তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দিতাম। তিনি এবার বলতে শুরু করলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তিনি বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আমরা একদিনে শুরু করিনি। আমরা রাতারাতি স্বাধীন হইনি। আমাদের মহান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যাদুকরী নেতৃত্বেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি এবং এদেশ স্বাধীন করি। ওরা অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্থানীরা আমাদের ঠকিয়েছে। তারা আমাদের ন্যায্য পাওনা দেয়নি। আমাদের নেতা শেখ মুজিব নির্বাচনে জয়ী হলেও তারা বাঙালিকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। ঊনিশ্শো একাত্তরের সাত মার্চ বিকেলে রেসকোর্সের সেই ঐতিহাসিক ময়দানে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের সেরা ভাষণটি দিয়েছিলেন। সেই ভাষণেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতার রূপরেখা দিয়েছিলেন। তারই আলোকে বাঙালি এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্থানীরা গোল টেবিল বৈঠকের নাম দিয়ে এদেশে বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আসে। আর রাতের গভীরেই তারা সেই সৈন্য বাহিনী দিয়ে হামলা চালায় বাংলাদেশের উপর। অনেক নিরীহ লোক মারা যায়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু টের পেয়েছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি আরও বুঝেছিলেন, তিনি যদি গ্রেপ্তার না হন, যদি নিজেকে আাড়াল করেন পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর আটক প্রক্রিয়া হতে তবে তাঁর প্রিয় বাঙালি জনগণের উপর আরো কঠিন নির্যাতন নেমে আসবে। আরো অনেক নিরীহ লোক মারা যাবে। তিনি তাই তাঁর বাসভবনে অর্থাৎ ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়িতেই রইলেন। রাতের মধ্যেই তিনি ওয়ারলেসে বার্তা পাঠিয়ে ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। তাঁর সেই ঘোষণায় বাঙালি নেমে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে। আমি এবং আমার মতো আরো অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি মহান নেতার ঘোষণায় ও নেতৃত্বে।
এটুকুন বলেই তিনি পানি পান করে নিলেন এক চুমুক। বয়স তো তাঁর হয়েছে। তাই মাঝখানে একটু জিরিয়ে নিতে হোল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম তাঁকে, মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহিদ হয়েছেন? তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখের মতো বাঙালি শহিদ হয়েছে। এক লাখ ঊননব্বই হাজার বা প্রায় দুলাখ নারীদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। আরো এককোটি লোক পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাঁকে বললাম, আচ্ছা, শিশুরা কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অনেক সাহসী কিশোর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। সবচেয়ে ছোট মুক্তিযোদ্ধার নাম হচ্ছে পলাশ আলম। আরেক জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়তো সে। তার নাম মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক। নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলো মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল, জহিরুল এরা। আবার অনেক বাঙালি নারী পাকিস্থানী আর্মির অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে শিশুসন্তান কোলে নিয়ে ঘুরেছে। এসব শিশুরা ঐসব মায়েদের জন্যে হানাদারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় ছিল। যদিও সবাই রেহাই পায়নি, কেউ কেউ পেয়েছিলো। এরকম করে শিশুরাও বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাদের জানিয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের এগারটা সেক্টরের কথা, মুজিব নগর সরকারের কথা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা। আমরা তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প থেকে অনেক না জানা কথা জেনেছি। তিনি মুজিব নগরে কীভাবে শপথ হলো আর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্থানের কোন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল সবই বললেন। তাঁর ক্লাস শেষে তিনি আমাদের তাৎক্ষণিক ক্যুইজের মতো পরীক্ষা নিলেন। তাঁর পরীক্ষায় আমরা সবাই পাশ করলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যার ওনাকে স্কুলের তরফ থেকে একটা স্মারক উপহার দিলেন। তাঁকে আমরা আরেকদিন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবার জন্যে আসতে বললাম। আমাদের প্রশ্ন করতে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন, তোমাদের জানার আগ্রহ আছে। তোমরা মনোযোগী ছিলে। তাই আমি আবার আসবো তোমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমাদের গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। তিনি আমাদের নিয়ে গান গাইলেন, শহিদ স্মৃতির উদ্দেশ্যে, ' সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহিদ স্মরণে; আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে।' গান গাইতে গাইতে তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের চকলেট দেওয়া হলো। প্রতিজন দুটো করে চকলেট পেলাম। যাওয়ার আগে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, জান তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান কী ছিল? আমরা সবাই একসাথে বললাম, 'জয় বাংলা'। তিনি বললেন, আবার বলো সবাই। আমরা প্রিন্সিপ্যাল স্যারসহ সবাই বললাম, 'জয় বাংলা।' ’জয় বাংলা’ বলতে বলতে আমাদের সবার চোখ ভিজে উঠল শিহরণে। তাঁর মুখের ওপর ক্রমশ যেন ফুটে উঠল বাংলাদেশের মানচিত্র।