প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
শিশু হলো মানব-কুসুম। গাছের যেমন ফুল হয়, তেমনি মানুষেরও ফুল হয়। গাছের ফুলগুলো কোনটা জবা, কোনটা গোলাপ, কোনটা চাঁপা। মানুষের ফুলগুলোর এ রকম কোনো নাম নেই। শিশুরাই হলো মানুষের ফুল। ফুল যেমন নিষ্পাপ, দেখতে সুন্দর, সৌরভ-সম্পন্ন, মানুষের শিশুরাও তাই। তারা আছে বলেই মানুষের জীবনে স্বপ্ন আছে, আশা আছে। মানুষ তাদের দিকে চেয়েই জীবনের পথ চলে। শিশুরাই মানুষের ভবিষ্যৎ। তারাই জাতির আগামীদিনের কর্ণধার। কর্ণধার মানে হলো, যারা ভবিষ্যতে জাতির দায়িত্ব নিবে। এজন্যেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। যে আজকে শিশু, সে-ই মনে মনে স্বপ্ন দেখে, একদিন সে তার বাবার মতো বড় হবে।
পৃথিবীর বুকে বাঙালি একটি মহান জাতির নাম। আমরা সেই জাতির সন্তান। আমাদের এই জাতির পিতার নাম হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন বলেই বাঙালি পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পরাধীনতা হলো অন্যের শাসনের অধীনে থাকা। আগস্ট হলো আমাদের জাতীয় জীবনে শোকের মাস। শোক হলো কারো জন্যে মনের ভেতর দুঃখ তৈরি হওয়া। আমরা এই আগস্ট মাসেই আমাদের জাতির পিতাকে হারিয়েছি। তিনিও এক সময় শিশু ছিলেন। তাঁর শৈশবকালে তিনিও তাঁর বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতেন। তাঁর ডাকনাম ছিলো খোকা। তিনি ছোটবেলায় খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। দীন-দুখিকে ডেকে এনে নিজের কাপড়-চোপড় দিয়ে দিতেন। তিনি তাঁর মায়ের হাতে আতপ চাল দিয়ে রান্না করা পায়েস খেতে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় তাঁর বেরিবেরি ও গ্লুকোমা রোগ হয়েছিলো।
শৈশবে যিনি লিকলিকে স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, বড় হয়েই তিনি হয়ে যান পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকের আতঙ্ক। তাঁর নাম শুনলেই পাকিস্তানিরা ভয় পেতো। তিনি রাজপথের আন্দোলন দিয়েই জনগণের অধিকার আদায় করতেন। তিনি ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সদা প্রতিবাদে মুখর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে যেমন ছোটবেলায় বাবার আদর উপভোগ করতেন, তেমনি তিনিও বড় হয়ে শিশুদের অত্যন্ত আদর ও স্নেহের চোখে দেখতেন। শিশুরা ছিলো তাঁর কাছে বন্ধুর মতো। নয়া চীনে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি চীনা শিশুদের দেখে খুশি হন। তাদের সাথে তিনি মিশে যান শিশুর মতো। তাঁর জন্মদিনে শিশুদের ছিলো অবাধ যাতায়াত। শিশুরা তাঁর জন্মদিনে বঙ্গভবনে গিয়ে আনন্দে মেতে উঠতো। শিশুদের জন্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। শিশুদের সুরক্ষা দেয়ার জন্যে তিনি ১৯৭৪ সালের ২২ জুন প্রণয়ন করেন শিশু সুরক্ষা আইন। একবার ১৯৬৩ সালে ঢাকা প্রেসক্লাবে দশ দিনব্যাপী শিশুমেলার আয়োজন করা হয়। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’ তিনি শিশুদের ফেরেশ্তার মতোই জানতেন। ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাওয়ার সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি নিয়ে যান। এই ছবিগুলো বাছাই করার জন্যে তিনি গণভবন ‘সুগন্ধায়’ যান। মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা বিষয়ক শিশুদের আঁকা ছবিগুলো দেখে বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না’। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটুখানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে তাঁর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। তিনি শেখ রাসেলকে জাপানে রাষ্ট্রীয় সফরেও নিয়ে যান। শেখ রাসেল ছিলো যেনো বাংলাদেশের সকল শিশুর প্রতীক। বঙ্গবন্ধু একবার কারাগারে থাকাকালীন ছোট্ট রাসেল তার মায়ের সাথে বাবাকে দেখতে যায়। রাসেল তখন মাত্রই আধো আধো বোল শিখতে শুরু করেছে। বাবাকে দেখেই রাসেল বলতে থাকে, ‘আব্বা বালি চল’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, রাসেল মনে করতো, জেলখানা ছিল বাবার বাড়ি আর নিজেদের বাড়ি ছিল মায়ের বাড়ি।
কচি-কাঁচার শিশু ও খেলাঘরের শিশু বন্ধুদের সাথে বঙ্গবন্ধুর মজার মজার স্মৃতি আছে। আজকের মস্তবড় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন যখন শিশু হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন তাকে বঙ্গবন্ধু খুব আদর করেছিলেন। আজকে যিনি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী, অর্থাৎ চাঁদপুরের সোনার মেয়ে ডাঃ দীপু মনিও তাঁর বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিলেন। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ও! তুইও এসেছিস্!’ এই বলে তিনি সেই ছোট্ট খুকুটাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আসলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন এক বিরাট শিশু। তিনি ঘরে থাকলে তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান রাসেল ও দুই নাতি-নাতনী জয়-পুতুলকে সাথে নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর এই শিশু প্রীতির কারণেই তাঁর জন্মদিনকে আমরা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পেয়েছি। আজকের আগস্ট মাস আমাদের সেই শিশুবান্ধব জাতির পিতার শাহাদত বরণের মাস। তাঁর ছোট্ট রাসেলও তাঁর সাথে মরণকে বরণ করেছে এই মাসে। আমরা তাঁদের আত্মার পারলৌকিক শান্তি কামনা করি।