প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৭
রহস্যে ভরা জীবন

জীবন এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসীম গভীরতা, বিস্ময় ও প্রশ্ন। মানুষ জন্ম নেয়, বড় হয়, স্বপ্ন দেখে, সংগ্রাম করে এবং একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এই জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টাই কি কেবল জীবন? নাকি জীবনের ভেতরে রয়েছে আরও অজানা রহস্য, যার উত্তর মানুষ আজও খুঁজে চলেছে? জীবন রহস্য আসলে মানুষের অস্তিত্ব, উদ্দেশ্য, অনুভূতি, বিশ্বাস, সাফল্য-ব্যর্থতা ও মৃত্যুচিন্তার সমষ্টি।
|আরো খবর
জীবনের সূচনা কোথা থেকে এই প্রশ্নটি মানবসভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষকে ভাবিয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, সৃষ্টিকর্তাই মানুষের জীবন দান করেছেন। আবার বিজ্ঞান বলে, দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই ভিন্ন ব্যাখ্যার মাঝেও একটি মিল রয়েছে জীবন একটি অনন্য ও মূল্যবান উপহার।
মানুষ কেন জন্ম নেয়? তার জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী? কেউ মনে করে, সুখ অর্জনই জীবনের লক্ষ্য। কেউ মনে করে, মানবসেবা ও নৈতিক জীবনযাপনই জীবনের প্রকৃত অর্থ। আবার কেউ বিশ্বাস করে, জীবন একটি পরীক্ষা, যার ফলাফল নির্ধারিত হবে মৃত্যুর পর।
জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর একটি হলো এর অর্থ কী? ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, খ্যাতি কি জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য? নাকি শান্তি, ভালোবাসা ও আত্মতৃপ্তিই জীবনের আসল সার্থকতা?
অনেক মানুষ সারাজীবন অর্থের পেছনে ছুটে শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করেÑঅর্থ থাকলেও শান্তি নেই। আবার কেউ অল্পতেই সন্তুষ্ট থেকে সুখী জীবন যাপন করে। এখানেই জীবনের রহস্য সুখ বাহ্যিক নয়, এটি মানুষের অন্তরের বিষয়।
জীবনের উদ্দেশ্য ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন। একজন শিক্ষকের কাছে জীবন মানে জ্ঞান বিতরণ, একজন চিকিৎসকের কাছে জীবন মানে মানুষের প্রাণ রক্ষা, একজন শিল্পীর কাছে জীবন মানে সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। অর্থাৎ, জীবন একরৈখিক নয়; এটি বহুমাত্রিক।
দুঃখ না থাকলে সুখের মূল্য বোঝা যায় না। মানুষ যখন কষ্টে থাকে, তখন সে প্রশ্ন করে “আমার সাথেই কেন এমন হলো?” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই কষ্টই মানুষকে পরিণত করে, শক্তিশালী করে।
জীবনের রহস্য এখানেই দুঃখ মানুষকে ভেঙে দেয় না, বরং গড়ে তোলে। ব্যর্থতা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে সাহায্য করে। অনেক সফল মানুষই একসময় চরম ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে গেছে।
মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সম্পর্ক। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু, জীবনসঙ্গী এই সম্পর্কগুলোই জীবনে অর্থ যোগ করে। ভালোবাসা ছাড়া জীবন শূন্য ও নিরস হয়ে যায়।
কিন্তু ভালোবাসাও রহস্যময়। কখনো এটি মানুষকে সবচেয়ে সুখী করে তোলে, আবার কখনো গভীর কষ্টের কারণ হয়। বিশ্বাস, ত্যাগ ও বোঝাপড়ার অভাবে সম্পর্ক ভেঙে যায়। তবু মানুষ বারবার সম্পর্ক গড়তে চায়, ভালোবাসতে চায় কারণ মানুষ সামাজিক জীব।
সময় জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতা। সময় কখনো থেমে থাকে না। আজ যে তরুণ, কাল সে বৃদ্ধ। এই ক্ষণস্থায়িত্বই জীবনের বড় রহস্য ও শিক্ষা। মানুষ জানে জীবন ক্ষণস্থায়ী, তবু সে অহংকার করে, হিংসা করে, অন্যায় করে।
যদি মানুষ বুঝতে পারতÑসময় একদিন সব কেড়ে নেবে তাহলে হয়তো সে আরও মানবিক হতো, আরও সহানুভূতিশীল হতো। জীবনের সৌন্দর্য আসলে এর অস্থায়িত্বেই।
জীবনের রহস্য অনুধাবনের জন্য নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ শুধু বেঁচে থাকলেই জীবন সার্থক হয় না; কীভাবে বাঁচে, সেটিই মুখ্য। সততা, ন্যায়বোধ, সহমর্মিতা এই গুণগুলো মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে।
আজকের ভোগবাদী সমাজে মানুষ অনেক সময় নৈতিকতা ভুলে যায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নৈতিকতাহীন সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রকৃত শান্তি আসে নৈতিক ও মানবিক জীবনযাপন থেকে।
মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য এবং সবচেয়ে বড় রহস্য। মৃত্যু মানেই কি সবকিছুর শেষ? নাকি এটি অন্য কোনো জীবনের সূচনা? ধর্ম বলে, মৃত্যু পরবর্তী জীবন আছে। বিজ্ঞান বলে, মৃত্যু হলো শারীরিক কার্যকলাপের সমাপ্তি।
এই অনিশ্চয়তাই মৃত্যুকে রহস্যময় করে তোলে। কিন্তু মৃত্যু মানুষকে শেখায়Ñজীবনকে গুরুত্ব দিতে। মৃত্যুর ভয় না থাকলে মানুষ হয়তো জীবনের মূল্য বুঝত না।
জীবনের রহস্য বুঝতে হলে আত্মঅনুসন্ধান জরুরি। আমি কে? আমি কী চাই? আমি কীভাবে বাঁচতে চাই? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাই জীবনের প্রকৃত যাত্রা।
অনেকে সারাজীবন অন্যের প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। জীবনের রহস্য উন্মোচিত হয় তখনই, যখন মানুষ নিজের সত্যকে চিনতে শেখে।
জীবন কোনো সরল অঙ্ক নয়, যার একটিমাত্র উত্তর আছে। জীবন একটি জটিল, বহুমাত্রিক রহস্য যেখানে আনন্দ ও বেদনা, আশা ও হতাশা, জন্ম ও মৃত্যু একসাথে অবস্থান করে। জীবনের রহস্য পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব নয়, কিন্তু তা অনুভব করা, উপলব্ধি করা সম্ভব।
জীবন তখনই সুন্দর হয়, যখন মানুষ ভালোবাসতে শেখে, ক্ষমা করতে শেখে, অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে শেখে এবং প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্য দিতে শেখে। জীবন রহস্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো জীবন ছোট, কিন্তু অর্থবহ করে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই।








