প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮
সহানুভূতির বাঁধন

ঢাকার এক পুরোনো গলিতে, যেখানে সকালে পাখিদের কলরব আর সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডা শোনা যায়, সেখানেই রনি আর মিতার ছোট্ট সংসার। তাদের দু কামরার বাসাটি ছিলো পরিচ্ছন্ন আর সাদামাটা। দেওয়ালে টাঙানো ছিলো দুজনের বিয়ের ছবি এবং কিছু পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন। রনি, বছর পঁয়ত্রিশের একজন মানুষ, একটি ছোট বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার বেতন খুব বেশি না হলেও, সৎ উপার্জনে সংসার চালানোর মতো ছিলো। তাদের ছেলে প্রীতম, বছর দশেকের একটি চঞ্চল শিশু, স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ে।
মিতা, রনির চেয়ে দুবছরের ছোট, তিনি পুরোপুরি গৃহিণী। নিজের সংসারের কাজ সামলানোর পরেও তার অনেক সময় ফুরসত মিলতো। সেই সময়টা তিনি ব্যয় করতেন স্থানীয় কমিউনিটির সেবামূলক কাজে। প্রতি শনিবারে তিনি পাড়ার প্রবীণ দু’জন মানুষের দেখাশোনা করতেন এবং স্থানীয় মহিলাদের একটি হস্তশিল্পের ক্লাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন। তার মুখখানি সবসময়ই হাসি দিয়ে উজ্জ্বল থাকতো, যেনো সরলতা আর দয়ালু হওয়াই তার জীবনের মূলমন্ত্র।
বিয়ের প্রথম পাঁচ বছর তাদের জীবন কেটেছিলো নিরুদ্বেগে। তাদের ভালোবাসা ছিলো শিশুর হাসির মতো সরল আর পবিত্র। প্রতি সন্ধ্যায় তারা দু’জনে একসঙ্গে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গল্প করতেন আর হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতের জন্যে পরিকল্পনা করতেন। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিলো একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং কৃতজ্ঞতা। রনি, তার সীমিত সামর্থের মধ্যে মিতা আর প্রীতমের সব প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতেন, আর মিতাও তা’ সানন্দে গ্রহণ করে স্বামীকে আরো উৎসাহিত করতেন। মিতা প্রায়শই বলতেন, "রনি, আমার কোনো কমতি নেই। আমরা একসঙ্গে আছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সুখ।"
কিন্তু সময়ের সাথে মিতার জীবনে একটু একটু করে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। তার এ পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিলো যখন তিনি পাড়ার অন্যান্য মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ত্রীদের সঙ্গে আরো বেশি মেশা শুরু করলেন। তাদের জমকালো শাড়ি, দামি গয়না, আর ছুটির দিনে ভ্রমণ কাহিনির গল্প মিতার সাদামাটা জীবনে এক নতুন চিন্তার বীজ বুনে দিলো।
বিশেষ করে প্রতিবেশী দীপার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর থেকেই এ পরিবর্তনটা আরো স্পষ্ট হলো। দীপার স্বামী, যিনি রনির চেয়েও কম বেতনের চাকরি করেন, তাকে নতুন নতুন জিনিস কিনে দেন। দীপার হাতে সবসময়ই থাকতো ঝলমলে নতুন ফোন, তার পরনে থাকতো দামি পোশাক। মিতা যখন দীপার সঙ্গে বাজারে যেতেন, তখন দেখতেন দীপা অবলীলায় দামি জিনিস কিনে নিচ্ছেন আর তার মুখে কোনো চিন্তার ছাপ নেই।
প্রথমদিকে মিতা এ তুলনাগুলোকে পাত্তা দেননি, কিন্তু ধীরে ধীরে সেগুলো তার মনের গভীরে বাসা বাঁধতে শুরু করলো। সন্ধ্যায় রনি যখন প্রীতমের সঙ্গে খেলা করতেন, মিতা তখন দীপার কাছে গিয়ে তার নতুন কেনা জিনিসগুলো দেখতেন। তার মনের ভেতরে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা শুরু হলোÑতিনি ভাবতেন, আমার ভাগ্য কেনো এতোটা খারাপ যে এতোটা কষ্ট নিয়ে আমাকে থাকতে হবে?
সেই সন্ধ্যার পর থেকেই তাদের সংসারে অশান্তির সূত্রপাত। ঘরোয়া কাজ শেষ করে মিতা রনির পাশে বসলেন। তার চোখে মুখে এক অস্বাভাবিক জেদ।
‘রনি’, মিতা একটু শক্ত গলায় বললেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী দীপার স্বামী তাকে একটা নতুন ল্যাপটপ কিনে দিয়েছে। জানো, সেটার কী সুন্দর ডিসপ্লে! আমার ফোনটা এখন পুরনো হয়ে গেছে, তুমি আমাকে একটা নতুন স্মার্টফোন কিনে দাও।’
রনি প্রীতমের খাতা থেকে চোখ সরিয়ে মিতার দিকে তাকালেন। তিনি জানতেন, এ মাসের বাজেট এমনিতেই খুব টানাটানির মধ্যে। বাড়ির ভাড়া, প্রীতমের স্কুলের বেতনÑএই দু’টি বড় খরচ সামলানোর পর সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় আছে। নতুন একটি স্মার্টফোন কেনার মতো সামর্থ তার নেই।
তবু তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘মিতা, এ মাসে আমাদের একটু সংযমী হতে হবে। তুমি তো জানো, এ মাসে প্রীতমের স্কুলের বই কেনার খরচটা একটু বেশি হয়েছে। পরের মাসে দেখি কী করা যায়।’
মিতার মুখটা সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেলো। ‘তুমি সবসময় এ কথা বলো! সবসময় পরের মাস! দীপার স্বামী তো তোমারচেয়েও কম রোজগার করে, তবু সে সব পারে। তুমি কেনো পারো না? আমরা কি সবসময় এভাবে কষ্ট করে থাকবো?’ তার গলায় স্পষ্ট অভিমানের সুর।
রনি চুপ করে রইলেন। মিতার এ তুলনা এবং অভিযোগ তার হৃদয়ে গভীরভাবে আঘাত করলো। তিনি তার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন, তবুও যেনো তা যথেষ্ট নয়। রনি মৃদুস্বরে কেবল বললেন, ‘মিতা, কারো সঙ্গে আমাদের তুলনা করা ঠিক না। আমাদের যতোটা আছে, তার জন্যে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’
মিতা উঠে দাঁড়ালেন। ‘এগুলো তোমার সান্ত্বনার কথা, রনি। আমার জীবন এভাবে আর চলবে না!’ বলেই তিনি দ্রুত অন্য ঘরে চলে গেলেন। রনি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন, যেনো তার ভেতরের সমস্ত শান্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। সেই রাতটা তাদের সংসারে এক নতুন শীতলতার আগমন ঘটালো। ভালোবাসার পুরোনো উষ্ণতা যেনো কোথাও হারিয়ে গেলো।
প্রথম সংঘাতের পর তাদের দাম্পত্য জীবনে আর আগের মতো সহজতা রইলো না। মিতার চাহিদা কেবল ফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। কয়েকদিন পর মিতা রনির কাছে নতুন ডিজাইনের গয়না চাইলেন, এরপর বললেন, ‘প্রীতমের স্কুলে সবাই ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছে, আমরা কেনো যাবো না?’
রনি প্রতিবারই ধৈর্য নিয়ে মিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। ‘মিতা, আমার বেতন সীমিত, তুমি তো জানো। আমরা একটা ছোট ট্রিপে যেতে পারি, যেমন ধরো, ঢাকার কাছে কোনো ভালো জায়গায় একদিনের জন্যে।’
কিন্তু মিতা তা শুনতে চাইতেন না। তিনি অন্য বন্ধুদের কথা বলতেন, তাদের বিলাসিতার গল্প বলতেন, আর প্রতিবারই রনির সীমাবদ্ধতাকে অপমান করতেন। ‘তুমি একটা ভালো চাকরি কেনো খুঁজে নাও না? অন্য সবাই পারে, তুমি কেনো পারো না? তোমার কারণে আমাদের জীবনের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।’
এ কথাগুলো রনির বুকে তীরের মতো বিঁধতো। তিনি বুঝতে পারতেন, মিতা আসলে তাকে ভালোবাসেন, কিন্তু এই ভালোবাসার ওপর এখন বিলাসিতা আর আকাক্সক্ষার এক পুরু স্তর জমে গেছে। তিনি শিক্ষকতা ভালোবাসেন, এটাই তার জীবন। কিন্তু মিতার অভিযোগ তার প্রিয় পেশাকেও তুচ্ছ করে তুলছিলো। তিনি প্রায়শই গভীর রাতে জেগে থাকতেন, নিজের জীবনের ব্যর্থতা নিয়ে ভাবতেন।
তিনি মনে মনে ভাবতেন, আমরা দু’জনই একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেছিলাম। তবে কেনো মিতা এখন এই পার্থিব জিনিসের প্রতি এতোটা ঝুঁকে গেছে?
রনির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো এক সন্ধ্যায়। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে রনি ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি সারাদিন দু’টো অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছিলেন শুধুমাত্র প্রীতমের জন্যে একটি ভালো অভিধান কেনার টাকা জোগাড় করার জন্যে। তিনি বাসায় ফিরে দেখেন মিতা বিষণ্ন মুখে বসে আছেন।
‘কী হয়েছে, মিতা?’ রনি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
মিতা মাথা তুলে রনির দিকে এক ঝলক তাকালেন। তার চোখে কোনো মমতা ছিলো না, ছিলো কেবল এক তীব্র অভিযোগের আগুন। ‘তুমি আমাকে সুখী করতে পারবে না, রনি। আমার জীবন এভাবে আর চলবে না!’
এ কথাটি রনির বুকে গভীরভাবে আঘাত করলো। তার মনে হলো, তার এতোদিনের সব চেষ্টা, ভালোবাসা আর পরিশ্রমÑসবই মিথ্যা। তিনি ব্যর্থ! তিনি তার স্ত্রীকে সুখী করতে পারেননি। তার চোখে জল এসে গেলো। তিনি কোনো কথা বললেন না। মিতার দিকে একটা নীরব দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিতা তখনও রাগ আর অভিমানে ফুঁসছিলেন। তিনি ভাবলেন, রনি হয়তো কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসবেন, যেমনটা সবসময় আসেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো, রাতের অন্ধকার গভীর হলো, কিন্তু রনি ফিরলেন না।
মিতা প্রথমে রাগ করে অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু রাত যখন গভীর হলো, তখন তার রাগ পাল্টে গিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা আর অভিমানে পরিণত হলো। তিনি বারবার ফোন করলেন, কিন্তু রনি ফোন ধরলেন না। তিনি ভাবলেন, রনি কি তাহলে কোনো বন্ধুর বাসায় গেছেন? এতো রাতে তিনি কোথায় গেলেন? মিতা কাঁদতে লাগলেন। এই প্রথম তিনি বুঝলেন, রনি তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বুঝতে পারলেন, তার কথাগুলো রনির হৃদয়ে কতোটা কষ্ট দিয়েছে। তার মনে হচ্ছিলো, তার কথাগুলোই হয়তো রনিকে তার জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি একাকী বসে রইলেন। অন্ধকারে তার মন কেবল সেই অনুচ্ছেদগুলো খুঁজছিলো যা’ তাকে শান্তি দিতে পারে। কিন্তু তার মনে কেবল ঘুরছিলোÑ‘তুমি আমাকে সুখী করতে পারবে না।’ তার নিজের কথায় তিনি নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলেন।
অন্যদিকে রনি তখন শহরের একটি নির্জন পার্কে বসে ছিলেন। তিনি পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, যার সঙ্গে তিনি মন খুলে কথা বলতে পারেন, কিন্তু এ গভীর রাতে কাউকে খুঁজে পেলেন না। রনি একা বসে রইলেন। চারদিকে নীরবতা, কেবল দূর থেকে ভেসে আসছিলো গাড়ির শব্দ। তিনি অনুভব করলেন এক অসহ্য ব্যর্থতা। তিনি কেবল এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইলেনÑআমাকে শক্তি দাও যেনো আমি এ পরিস্থিতি সহ্য করতে পারি। আমার মিতাকে বুঝিয়ে দাও যে সুখ পার্থিব জিনিসে নয়, এটা আমাদের হৃদয়ে আছে।
তিনি সারারাত সেখানেই কাটালেন, তার চোখে ছিলো না কোনো ঘুম, ছিলো কেবল উদ্বেগ আর আত্ম-জিজ্ঞাসা।
পরদিন সকালে রনি ক্লান্ত ও উদ্বেগ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তার চোখে ছিলো রাতের জাগরণের ক্লান্তি, মুখে ছিলো গভীর উদ্বেগের ছাপ। মিতা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রনি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মিতা ক্রোধে ফেটে পড়লেন।
‘কোথায় ছিলে তুমি? আমাকে না জানিয়ে চলে যাও কেনো?’ মিতার গলায় রাগ আর দুশ্চিন্তার মিশেল।
রনি শান্ত গলায় বললেন, ‘মিতা, আমি গতকাল রাতে আমার পুরোনো শিক্ষক, বিনোদ স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলেছি।’
‘আর কী কথা হয়েছে?’ মিতা জিজ্ঞেস করলেন।
রনি ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করে বসলেন। তার চোখজোড়া ছিলো শান্ত, কিন্তু তার কথার মধ্যে ছিলো এক দৃঢ় প্রত্যয়। ‘আমি আমার সাধ্যের মধ্যে তোমাকে সব দেয়ার চেষ্টা করি। তুমি তা জানো। কিন্তু তুমি যখন আমার সীমাবদ্ধতাকে বারবার অপমান করো, তখন আমার মনে হয় আমি ব্যর্থ। কাল রাতে আমার মনে হলো, আমি আর পারবো না।’
রনি একটু থামলেন। তারপর গভীর প্রত্যয় নিয়ে বললেন, ‘বিনোদ স্যার আমাকে মনে করিয়ে দিলেন যে, সম্পর্ক হলো দু’জন মানুষের সমান দায়িত্ব। তিনি বললেন, ‘প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব গ্রহণ করুক।’ আমাদের একে অপরের সঙ্গে ধৈর্য আর ভালোবাসায় থাকতে হবে। আমাদের সম্পর্কটা একটি বোঝা, যা দু’জন মিলে বহন করতে হবে। একজনকে আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দিলে তা ভেঙে যাবে।’
মিতা চুপ করে রইলেন। রনির শান্ত অথচ দৃঢ় কথাগুলো তার হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করলো। রনি কখনো এতোটা শান্ত কিন্তু এতোটা দৃঢ়ভাবে কথা বলেননি। মিতার মনে হলো, রনি যেনো হঠাৎ করেই অনেক দূরে চলে গেছেন, আর তার কাছে ফেরার একমাত্র পথ হলো ক্ষমা। তিনি ভাবলেন, তিনি কি সত্যিই রনির সামর্থের কথা না ভেবে অযথা চাপ দিয়েছেন? তিনি কি রনির ভালোবাসাকে তুচ্ছ করেছেন?
সেদিন সন্ধ্যায় মিতা একাকী বসে গভীর চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তার এই চাহিদাগুলো আসলে তার নিজের নয়, বরং সমাজের আরোপিত ধারণা। দীপার বিলাসিতা তাকে এমন এক পথে ঠেলে দিচ্ছিলো, যা তার পরিবারকে ভেঙে দিতে পারতো। তার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছিলো। তিনি অনুভব করলেন এক তীব্র অনুশোচনা। তিনি কেবল নিজের সুখের কথা ভেবেছেন, কিন্তু রনির কষ্টটা একবারও বোঝেননি।
তিনি তার এক পুরোনো বান্ধবী, যে কিনা একজন সমাজকর্মী, তার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। তার বান্ধবী বললেন, ‘মিতা, জীবনে শান্তি আসে ভালোবাসায় আর কৃতজ্ঞতায়, দামে নয়। তোমরা দু’জনে মিলে একটা সুন্দর সংসার গড়েছো, এটাই তো তোমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তোমার স্বামীর প্রতি তোমার শ্রদ্ধা, সহানুভুতি এবং ভালোবাসা থাকা উচিত।’
বান্ধবীর কথাগুলো মিতার হৃদয়ে এক গভীর বোধের জন্ম দিলো। তিনি বুঝলেন, তার সুখ কখনোই দীপার নতুন ল্যাপটপ বা দামি পোশাকে লুকিয়ে নেই। তার সুখ লুকিয়ে আছে রনির ভালোবাসায়, প্রীতমের হাসিতে, আর তাদের সাধারণ কিন্তু পবিত্র জীবনযাপনে। তিনি আরো বুঝলেন, এই আকাক্সক্ষার সঙ্গে তিনি কেবল নিজের শান্তিই নষ্ট করেননি, রনির হৃদয়েও আঘাত করেছেন।
মিতা বাড়ি ফিরে আসলেন। রনি তখন টেবিলে বসে প্রীতমের স্কুলের বই দেখছিলেন। মিতা ধীরে ধীরে রনির পাশে বসলেন। রনি মাথা তুললেন।
‘রনি,’ মিতার গলায় ছিলো অশ্রুসিক্ত বিনয়। ‘আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি তোমার সাথে আর কারো তুলনা করবো না। আমি তোমাকে যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলোর জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমরা একসঙ্গে আমাদের সাধ্যের মধ্যে সুখী হবো।’
রনি মিতার হাত ধরলেন। তার চোখে কোনো অভিযোগ ছিলো না, ছিলো কেবল অকৃত্রিম ভালোবাসা। ‘মিতা, আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু পার্থিব জিনিসের প্রতি আকর্ষণ মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। আমিও তোমাকে সুখী দেখতে চাই, কিন্তু আমার সামর্থও সীমিত।’
তিনি মিতাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মিতা, আমরা একসঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করবো। আমরা একসঙ্গে এই সংসারকে আবার হাসি আর ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবো।’
তারপর থেকে রনি আর মিতা তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসায় জীবনযাপন শুরু করলেন। তারা বুঝলেন, সংসারের শান্তি কখনোই বিলাসিতার জিনিসে আসে না; তা আসে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর ভালোবাসার মধ্যদিয়ে। মিতা আর কখনো তার স্বামীর সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তারা দু’জন মিলে নিজেদের সম্পর্কের প্রতি আরো বেশি সময় দিতে লাগলেন, আর তাদের হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ হলো সহানুভুতি, সেবায় এবং ভালোবাসায়। তারা শিখতে পারলো যে, সংসারে শান্তি বজায় রাখতে হলে একে অপরের সামর্থ বোঝা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবযাপন করা জরুরি। অযথা চাহিদা আর তুলনা সংসারে অশান্তি ডেকে আনে। তাদের ছোট্ট সংসার আবার হাসি আর প্রার্থনায় ভরে উঠলো, ভালোবাসার বাঁধনে তাদের জীবন হলো সরল, শান্তিময় আর সুন্দর।
রনি আর মিতা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এই চিরন্তন সত্যটি উপলব্ধি করতে পারলো যে, মানুষের জীবনের প্রকৃত সুখ তার প্রাপ্তির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে তার উপলব্ধির গভীরতা আর কৃতজ্ঞতার মনোভাবের ওপর। তাদের দু’জনের সম্পর্কের সেতুটি এখন আরো মজবুত, যা তৈরি হয়েছে ধৈর্য, ক্ষমা আর অকৃত্রিম ভালোবাসার ইটের পরতে। তারা এখন জানে যে, কেবল একে অপরের প্রতি আস্থা ও সহানুভূতিই একটি পরিবারকে সুখী করতে পারে।







