বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৫, ১১:০২

নুরুল হক নূরের রাজনৈতিক উত্থান

আব্দুর রাজ্জাক
নুরুল হক নূরের রাজনৈতিক উত্থান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ইতিহাস যদি সংগ্রামের হয়, তবে স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাসটি অধিকাংশ সময়েই নতুন পরাধীনতার প্রতিচ্ছবি। যে রাষ্ট্রটি জনগণের মুক্তির স্বপ্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রে আজও এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিকভাবে অনুপস্থিত। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এই শ্রেণির মানুষজন শিক্ষা, পরিশ্রম ও আত্মনির্ভরতায় পারদর্শী হলেও, তাদের কণ্ঠস্বর কখনোই শাসনযন্ত্রে প্রতিফলিত হয়নি। ঠিক এই পটভূমিতে আবির্ভূত হন নুরুল হক নূর। এক গ্রামীণ কৃষক পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী নাম মধ্যবিত্তের চাপা কণ্ঠস্বরের এক উচ্চারিত প্রতিবাদ। তার রাজনৈতিক যাত্রা এক ব্যক্তির নয়, বরং এটি একটি শ্রেণির দীর্ঘ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপক।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমাজতাত্ত্বিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি হচ্ছে এমন একটি গোষ্ঠী, যারা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর, কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির কেন্দ্রে প্রবেশে বঞ্চিত। এই শ্রেণির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : ১. আত্মমর্যাদাবোধ, ২. শিক্ষানির্ভরতা, ৩. রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি সীমিত আস্থা, ৪. সংস্কৃতিমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা। তবে এরা কখনোই ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়নি।

গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ১২-১৫% এসেছিলেন মধ্যবিত্ত পেশাজীবী বা শিক্ষাপ্রধান পটভূমি থেকে। বাকিরা ছিলেন রাজনীতিবিদ পরিবারের সন্তান, সামরিক পটভূমি থেকে আসা, কিংবা অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শ্রেণির অংশ। বাংলাদেশে এই শ্রেণির উত্থান ঘটেছে পাকিস্তান আমলের শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি নগরকেন্দ্রিক উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তারা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, প্রশাসন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রবেশ করতে পারেনি।

নুরুল হক নূরের জন্ম ও সামাজিক পটভূমি

নূর পটুয়াখালীর এক গ্রামীণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিচ্ছবিÑআত্মসম্মানবোধ, কঠোর পরিশ্রম, এবং স্বপ্নপূরণের চেষ্টা। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করে, কিন্তু তাদের মাত্র ৮-১০% সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এই প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতায় নূরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ এবং পরে ডাকসুতে নির্বাচিত হওয়া এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন : এক শ্রেণিসচেতন রাজনীতির সূচনা

২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন, মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি জাগরণে রূপ নেয়। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নেতৃত্বে থাকা নূরের বক্তৃতাগুলো হয়ে ওঠে এই শ্রেণির জীবনের প্রতিফলন : ‘আমরা কোনো বিশেষ শ্রেণির বিপক্ষে না, আমরা মেধাভিত্তিক সুযোগের পক্ষে’।

তৎকালীন সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা ছিল নিম্নরূপ : ৩০% মুক্তিযোদ্ধার কোটা, ১০% নারী কোটা, ১০% উপজাতি ও অনগ্রসর কোটা, ১% প্রতিবন্ধী, ১০% জেলা কোটা। ফলে মাত্র ৪৪% আসনে মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা হতো। এটি শহরের মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য এক সুস্পষ্ট বৈষম্য ছিল। ফলে দেশের ৫০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। ক্ষমতার ভীতির বহিঃপ্রকাশ শুরু হলো, সরকার প্রথমে উদাসীনতা দেখালেও পরে চরম দমননীতিতে নামে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর দমন চালায়। নূর নিজেই মারধরের শিকার হন, তাকে বহুবার রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘ষড়যন্ত্রকারী’, কিন্তু বাস্তবে তিনি যে দাবি জানাচ্ছিলেন তা ছিল সংবিধানসম্মত ন্যায়পরায়ণতা। এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্ন প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়ায়। নূরের সংগ্রাম হয়ে ওঠে একটি শ্রেণির মর্যাদার লড়াই।

ডাকসু নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতীকী বিজয়

২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে নূর ভিপি পদে জয়লাভ করেন। এটি ছিল ছাত্রলীগবিরোধী প্রথম বড় বিজয়। এই নির্বাচন রাষ্ট্রের ছাত্র রাজনীতির গতিপথ বদলে দেয়। কিন্তু বিজয়ের পরপরই তাকে নানা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়।

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে নূরের নামে ১০টিরও বেশি মামলা হয়, যার মধ্যে অনেকগুলো ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় উসকানি, এবং জননিরাপত্তা আইনে। এর অধিকাংশ মামলাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের নজরে আসে

গণঅধিকার পরিষদ : বিকেন্দ্রীকৃত গণতন্ত্রের এক বিকল্প ধারা

নূর ২০২১ সালে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ গঠন করেন, যার মূলনীতি ছিল : গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষিত যুবকদের নেতৃত্বে আনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। এই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটি শহর ও গ্রাম উভয় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে গঠিত। এরা ছাত্র, পেশাজীবী, নারী এবং কর্মজীবী যুবকদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল : ইভিএমবিরোধিতা, গুম-খুনের প্রতিবাদ, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা দাবি।

মধ্যবিত্ত বনাম অভিজাত শ্রেণির রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধান দলগুলোর নেতৃত্ব এসেছে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর রাজনৈতিক পরিবার (যেমন-শেখ পরিবার), সামরিক বাহিনী থেকে (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ), ব্যবসায়ী শ্রেণি (বর্তমান সরকারে বহু মন্ত্রী ব্যবসায়ী পরিবার থেকে)। তাদের সাথে নূরের প্রোফাইল একেবারেই আলাদা। তিনি ছিলেন না রাজনৈতিক বংশের উত্তরসূরি, না অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তার রাজনীতি অভিজাত শ্রেণির ঘনিষ্ঠ নয়, বরং একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে আসা। এ কারণে তাকে টার্গেট করা হয়েছে। কারণ তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন রাজনীতি করার জন্য রাজবংশীয় পরিচয় নয়, বিবেক ও স্পষ্ট অবস্থান যথেষ্ট।

রাজনৈতিক তত্ত্বে নূরের স্থান

Subaltern থেকে Resistance Politics Subaltern Studies মতে, ক্ষমতাহীন শ্রেণির কণ্ঠস্বর ‘মূলধারার ভাষায়’ প্রতিফলিত হয় না। গায়ত্রী স্পিভাক বলেন, ‘Subaltern cannot speak.’ তবে নূর সেই ব্যতিক্রম তিনি ‘speak’ করতে পেরেছেন, কারণ তিনি রাষ্ট্রের ভাষায় নয়, জনগণের ভাষায় কথা বলেন। তার রাজনীতি একটি ‘Bottom-up Model of Participation’ যেখানে জনগণই নেতাকে সৃষ্টি করে। এই ধারার সাথে তুলনা করা যায় দক্ষিণ আমেরিকার কিছু বিকল্প রাজনীতিকদের সঙ্গে যেমন বলিভিয়ার ইভো মোরালেস।

মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও করণীয়

নূরের উত্থান দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে এখনো রাজনীতিতে নবজাগরণ সম্ভব। তবে তা সম্ভব হবে কিছু শর্ত পূরণে : ১. নির্বাচনী ব্যয় কমানো মধ্যবিত্তদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ২. শিক্ষিত শ্রেণির রাজনৈতিক অনীহার অবসান ঘটাতে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, ৩. গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা, ৪. তথ্যপ্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে রাজনীতিতে বিকল্প আলোচনার স্থান তৈরি।

নুরুল হক নূর একজন ব্যক্তি মাত্র নন তিনি একটি প্রতীক। তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একটি শ্রেণির ইতিহাসের অংশ। তার ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা ও সামাজিক বয়কট প্রমাণ করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো মধ্যবিত্তের নেতৃত্বকে ভয় পায়। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম বলে, কণ্ঠস্বর চেপে রাখা যায়, নিঃশেষ করা যায় না। নূর হয়তো একা, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আজ হাজারো নূরের জন্ম দিচ্ছে। তাদের হাতে যদি রাজনীতির হাল তুলে দেওয়া যায়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সত্যিই গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়