শনিবার, ০১ মার্চ, ২০২৫  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৬

স্বপ্নের সিলেট : পাহাড়, নদী আর সাদা পাথরের রূপকথা

রিয়াজ শাওন
স্বপ্নের সিলেট : পাহাড়, নদী আর সাদা পাথরের রূপকথা

অনেকদিন ধরেই সিলেট ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছিলাম, কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তবে হঠাৎ করেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি আমার চার বন্ধুÑমশিউর, হাছানাত, রায়হান, সানভীর এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আর দেরি নয়! এবার সিলেট যাবই। আমাদের আরেক বন্ধু সবুজ আগে থেকেই সিলেটে চাকরি করত, তাই তার সঙ্গেও দেখা হবে। ৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটায় বাবুরহাট থেকে আমরা একতা বাসে উঠে রওনা দিলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ যাত্রার চিন্তায় কিছুটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, কারণ বাসে উঠলে আমার মাথা ব্যথা হয়। তবে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে রাত ২টার দিকে হবিগঞ্জের মাধবপুরে একটি রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি নিল বাস। বাস থেকে নামতেই কনকনে ঠাণ্ডা অনুভব করলাম। চাঁদপুরে এত ঠাণ্ডা না থাকলেও, এখানে ঠাণ্ডা বেশ ভালোই লাগছিল। ভাগ্যিস, আমরা শীতের পোশাক সঙ্গে নিয়েছিলাম! দ্রুত গিয়ে গরম কাপড় পরে নিলাম, তারপর খাবার খেয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম। ভোর ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে অবশেষে আমরা সিলেটের মাটিতে পা রাখলামÑহুমায়ূন চত্বরে। প্রথমবারের মতো সিলেটে এসে মনে হচ্ছিল, যেন কোনো নতুন জগতে প্রবেশ করেছি। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হলো! সেখান থেকে সিএনজিতে করে আমরা বন্ধুর বাসায় রওনা দিলাম। প্রায় ২০ মিনিট পর পৌঁছালাম শহরের শাহী ঈদগাহ এলাকায়। সবুজের বাসাটি ছিল একটি মেসে, পাঁচতলার চাঁদের কোণে ছোট্ট একটি রুমে। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, কারণ সামনে ছিল দারুণ একটি দিন!

সকাল ৯টার দিকে ঘুম থেকে উঠে রেডি হলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যের জন্যÑভোলাগঞ্জের সাদা পাথর! প্রথমেই গেলাম বিখ্যাত পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে। সেখানে খিচুড়ি খেতে হলো, যদিও অনেকে খেতে চাইছিল না। তবে আমি বললাম, দীর্ঘ পথের যাত্রা, তাই সকালে একটু ভারী খাবার খাওয়াই ভালো। খিচুড়ি, ডিম ভাজা, গরুর মাংস দিয়ে দারুণ নাস্তা করলাম। এরপর রওনা দিলাম শহরের জিন্দাবাজার এলাকায়।

সেখান থেকে বিআরটিসির দোতলা বাস ধরে আমরা ভোলাগঞ্জের পথে রওনা দিলাম। প্রথম বাসে সামনের সিট পাইনি, তাই অপেক্ষা করলাম দ্বিতীয় বাসের জন্য। বাস এলে দ্রুত উঠে সামনের সিট দখল করলাম। আমাদের সঙ্গেই একদল সিলেটি ভাষায় কথা বলা মেয়েও ছিল, যারা একই গন্তব্যে যাচ্ছিল। সিট নিয়ে একটু তর্ক-বিতর্ক হলেও, শেষমেশ আমরা সামনের সিটেই বসতে পারলাম, আর তারা গেল পেছনে।

বাস ছাড়ার পর প্রথমে কংক্রিটের শহর দেখতে পেলেও, মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রকৃতির স্পর্শ অনুভব করলাম। রাস্তার দু'পাশে বিস্তৃত চা-বাগান, পাহাড়ের কোলঘেঁষে সবুজ বন আর মাঝেমধ্যে ছোট ছোট বাজার। সামনে যতই যাচ্ছিলাম, ততই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

দেখতে পেলাম বিশাল হাওরÑতবে শীতকাল হওয়ায় পানি কম ছিল, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর চারণভূমি দেখা যাচ্ছিল। কৃষকরা মাঠে কাজ করছে, কেউ গরু চরাচ্ছে, জেলেরা মাছ ধরছেÑএক স্বপ্নময় দৃশ্য! এমন অপূর্ব সৌন্দর্য আর মানুষের জীবনযাত্রা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, আমি বাস্তবের পৃথিবীতে নেই, কোনো স্বপ্নরাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। প্রায় দেড় ঘণ্টার যাত্রার পর পৌঁছালাম সিলেটের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। বাস থেকে নেমেই বিশাল এক সাইনবোর্ড দেখলাম, যেখানে লেখাÑ‘সামনে ভারত’। সীমান্তের কাঁটাতার আর পিলারগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি।

এরপর চলে গেলাম ঘাটে। ছয়জন মিলে ৮০০ টাকা দিয়ে একটি নৌকা রিজার্ভ করলাম। এখানকার নৌকাগুলো অনেকটা কাশ্মীরি শিকারার মতো। চিকন লম্বা কাঠের নৌকা, উপরে ছাউনিÑদেখতে দারুণ! নৌকা ছোট্ট একটি নদীর মাঝখান দিয়ে চলতে থাকল। দুই পাশে শুধু পাথর আর পাথর! বাংলাদেশের অংশে বিস্তীর্ণ সাদা পাথরের সমারোহ, আর ভারতের অংশে বিশাল বিশাল পাহাড়। ভারতের দিকটা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কোনো চিত্রশিল্পীর আঁকা নিখুঁত দৃশ্য। তবে সবাই বলছিল, ভারত সব সম্পদ তারা নিয়ে গেছে—আমাদের কেবল শুষ্ক নদী আর পাথরের মরুভূমি দিয়েছে।

সাদা পাথরের জলে নেমে হাঁটতে গিয়েই বুঝতে পারলামÑএখানে একটা বড় সমস্যা আছে! পাথরগুলো খুবই পিছল, কারণ এর উপর শেওলা জমে থাকে। তবুও, যতটুকু সম্ভব সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানি যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য! যদিও শীতের কারণে আমরা গোসল করিনি, তবে গ্রীষ্মে এলে এখানে পানিতে নেমে গোসলের মজাই আলাদা!

সেখানে দেখলাম নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করা শ্রমিকদের। কী কঠিন পরিশ্রম করে তারা পাথর সংগ্রহ করছে! কাছেই হাজার হাজার কারখানা, যেখানে পাথর ভেঙে টুকরো করা হয়। এটি এখানকার অন্যতম বড় শিল্প। প্রায় দুই ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম সিলেট শহরের পথে। ফেরার পথে বিআরটিসির দোতলা বাসের সামনের সিটে বসে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও একবার উপভোগ করলাম। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যেতে হলে অবশ্যই বিআরটিসির দোতলা বাসে ভ্রমণ করুন। এর জন্য মাত্র ৭৫ টাকা ভাড়া লাগে। দোতলা বাসের সামনের সিটে বসে যাওয়ার মজাই আলাদা!

এই ভ্রমণ শুধু সিলেট দর্শন ছিল না, ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নতুন করে প্রেমে পড়ার অভিজ্ঞতা! দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল সিলেট ভ্রমণ করার, আর সেটি এবার সত্যি হলো। নতুন স্থান, নতুন সংস্কৃতি, পাহাড়, নদী, পাথরÑসব মিলিয়ে স্মৃতিতে অমলিন এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে এই সফর।

যারা এখনো সিলেট যাননি, তাদের বলবো, একবার হলেও সিলেটের সাদা পাথরে ঘুরে আসুন। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য হয়তো কোথাও পাবেন না!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়