প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:৩২
সহজ স্বীকারোক্তি
মানুষ মূলত একা। যেমন আমি। মায়াবতী। নামটা বাবার দেওয়া। খুব শখ করেই তিনি এই নাম রেখেছিলেন। কোঁকড়ানো চুল, শ্যামবরন রং আর বড় বড় কাজল কালো দুটি চোখের মায়ায় পড়েই এই নাম রাখা। আমি খুব আদরের। অন্তত একটা বয়স পর্যন্ত তা-ই মনে হতো। ধীরে ধীরে যখন দুনিয়া চিনতে শিখলাম। আমার ভেতরের সরল ধারণাগুলো যেন মিলিয়ে যেতে লাগল। চোখের সামনে এক নতুন দুনিয়া ডানা ঝাপটাতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, আমার মস্তিষ্ক তখনই কাজ করা বন্ধ করে দিল, যখন দেখলাম মা পড়ার টেবিলে দুধের গ্লাস রাখার বদলে রাখলেন চন্দন আর কাঁচা হলুদ মেশানো একটি বাটি। বললেন, ‘মায়া এটা রাতে ঘুমানোর আগে লাগাবি। তারপর মুখ ধুয়ে একটা ভালো ক্রিম আনিয়েছি তোর বাবাকে দিয়ে, ওটা মুখে মেখে ঘুমাবি। কাল কিন্তু আমান সাহেব আর রিফাতরা তোকে দেখতে আসবে।’ কথাগুলো বলে মা দ্রুত পায়ে চলে গেল। এই প্রথম নিজের আপন মাকে অচেনা মনে হলো। এর আগে তো দুধের গ্লাস টেবিলে রেখে, স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখে মা বলত, ‘কিরে মাথাব্যথা করছে না তো? সেই সন্ধ্যা থেকে তো পড়ছিস, একটু বিশ্রাম নে। পরীক্ষা শেষ হলেই বাবার সঙ্গে কোথাও থেকে ঘুরে আসিস। মন ভালো হবে।’ আরও কত কথাই তো মা বলত। আর আমি শুনতাম। কই আজ তো তেমন কিছুই বললেন না! একবার ডাকতে গিয়েও কথা কেমন গলায় এসে আটকে গেল। এক অচেনা অনুভূতি। নীরবে মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বেশ কিছুদিন ধরেই আঁচ করতে পারছিলাম, বাড়িতে আমাকে নিয়ে কিছু একটা গবেষণা হচ্ছে। সেদিনই তো কলেজ থেকে ফিরে দেখলাম, ছোট মামা বসে আছেন সোফায়। আমাকে দেখেই চায়ের কাপটা নামিয়ে নিজের পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে একগাল হেসে বললেন, ‘কিরে মায়া কেমন আছিস?’ মৃদু হেসে সালাম দিলাম। বললাম, ‘এই তো ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো মামা?’ বলে রাখা ভালো, আমার এই মামা বংশে ঘটক নামে জনপ্রিয়।
বাথরুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের দেওয়া চন্দন আর কাঁচা হলুদের গোলা মুখের ডান পাশে লাগাতে শুরু করলাম। হঠাৎ নিজেকে যেন অন্য রকম লাগতে শুরু করল। আমি এত কালো! আগে তো খেয়াল করিনি। মনে পড়ল, আমার ক্লাসে সবচেয়ে কালো মেয়েটা আমিই! আমার তো এত দিন এটা মাথায় আসেনি। আজকে কেন এল! হঠাৎ মনে পড়ল বেস্ট ফ্রেন্ড নবনীতা আমাকে সম্বোধন করে শ্যামাকালী বলে। আর আমি এত দিন ভাবতাম, বাহ্! ওদের ঠাকুরের সঙ্গে আমার তুলনা করে! না জানি আমি কত সুন্দর। তাহলে আজ কেন এমন দম বন্ধ লাগছে কথাটা মনে পড়তেই! ক্লাসের অন্যদের চুল কেমন সুন্দর ঝলমলে আর ঘন কালো। আমার চুলগুলো এমন খড়ের গাদার মতো লাগছে কেন? আগে তো মনে হতো আমি শরৎ কিংবা রবিঠাকুরের গল্পের কোনো নায়িকা। ক্লাসে আমাকে সবার চেয়ে আলাদা করে চেনা যেত এই চুলের জন্যই। তবে আজ নিজেকে কেন এত কুৎসিত মনে হচ্ছে!
বেসিনের কলটা ছেড়ে মুখের এক পাশে লাগানো চন্দন, হলুদের গোলাটা ধুয়ে আয়নার দিকে তাকালাম। মেলানোর চেষ্টা করলাম যে মুখের ওপর পাশ থেকে এই সদ্য রূপচর্চা করা পাশটা বেশি ফরসা ও সুন্দর লাগছে কি না। কোনো অমিল খুঁজে পেলাম না। মনের অজান্তেই হাসি পেল। মা বোধ হয় ভেবেছিল, এটা কোনো জাদুমন্ত্র করা মিশ্রণ; লাগালেই এক ধোয়ায় তার মেয়ে পরির মতো হয়ে যাবে। মুখের ওপর পাশে আর কিছু না করেই বাটিতে থাকা বাকি মিশ্রণটা ফেলে দিয়ে, বাটি পরিষ্কার করে ঘরে ফিরে এলাম।
ঘড়িতে তখন রাত ১২টা বেজে ৫ মিনিট। আমার অভ্যাস তাহাজ্জদ পড়া। কিন্তু আজ কী হলো! কেন মনে হলো আমার কথা হয়তো খোদা শোনেন না আর। কী লাভ ডেকে! ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম চুল বাঁধার জন্য। কিন্তু ইচ্ছা করল না। মনে হলো ডায়েরিটা নিয়ে বসি। বসলামও...
ইন্সপেক্টর রিফাত মায়াবতীর ডায়েরিটা এতক্ষণ পড়ছিল। এরপর আর কিছু নেই। হয়তো এইটুকু লেখার পরেই...। হাবিলদার পাচুমিয়া রুমের দরজায় নক করলেন। রিফাত ডায়েরি থেকে মুখ না তুলেই তাকে ভেতরে আসতে বললেন। পাচুমিয়া একটা ফাইল রিফাতের হাতে দিল। রিফাত ফাইল খুলেই মৃদু হাসলেন। এই হাসি আনন্দের নয়; বরং তার মনে আশঙ্কা সত্যি হয়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ। মুখ তুলে তিনি বললেন, ‘মায়াবতীর লাশ কি তার বাড়ি পাঠানো হয়েছে?’
‘জি স্যার, ওনার আব্বা এসে নিয়ে গিয়েছে।’
রিফাত বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখেছ মায়াবতী, আল্লাহ তোমার কষ্ট ঠিকই শুনেছে। শুধু শুধুই অভিমান করেছিলে তার ওপর।’রিফাত ফাইলটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, চলো একবার শেষবারের মতো মায়াবতীর মায়াজড়ানো মুখটা দেখে আসা যাক। পাচুমিয়া কথার মানে বুঝল না। তবু রিফাতের কথামতো তার সঙ্গে রওনা দিল। গন্তব্য আজিমপুর কবরস্থান। রিপোর্টে লেখা ‘প্রবাবল কজ অব ডেথ: হার্ট অ্যাটাক’।
ভালো থাকুক সব মায়াবতী। শরীরের যন্ত্রণার মতো যদি মানুষ তার হৃদয়ে বহমান কষ্টটাও মন খুলে কাউকে বলতে পারত, তাহলে হয়তো এমন হাজারো মায়াবতীর হৃদয় অকালে তার ক্রিয়া বন্ধ করে পরপারে পাড়ি জমাত না।