প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২১, ০৫:১২
এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ২০০৫ সালের আগে ম্যানেজিং কমিটির হাতে ছিল। নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিটির পক্ষপাত এবং সেলামি গ্রহণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আসার সুযোগ করে দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও ব্যবসায় শিক্ষা) শিক্ষক নিয়োগের জন্য জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রতিষ্ঠা করে। এ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ভেতর দিয়ে শিক্ষক নির্বাচন এবং শূন্যপদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করার দায়িত্ব পায়। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে বাধ্য। এনটিআরসিএ’র নিবন্ধন পরীক্ষা এখন বিসিএসের অনুরূপ। প্রার্থীদের প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবে নানাবিধ জটিলতায় প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।এনটিআরসিএ’র প্রথম দিককার ব্যর্থতা হলো, জাল সনদের নিয়োগ আটকাতে পারেনি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ
|আরো খবর
থেকে সনদ গ্রহণের নিয়ম করা হলে, একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রার্থী জাল সনদ নিয়ে চাকরিতে ঢুকে পড়ে। নিয়োগ বোর্ডে অন্যদের সঙ্গে ডিজির প্রতিনিধিও ছিলেন। তিনিও অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সনদ আসল না নকল তা যাচাই করতে পারেননি। অভিযোগ আছে, জাল সনদধারীদের কেউ কেউ এখনো শিক্ষকতায় আছেন। শুরুতেই এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত শিক্ষকদের তালিকা প্রদর্শিত হলে নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরের সঙ্গে সনদ মিলিয়ে নিলে এ অঘটন ঘটত না।যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হলো, শূন্য কিংবা সৃষ্ট পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। চাকরিপ্রত্যাশীরা সেই বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মেধা তালিকার ওপর দিক থেকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচিত হন। এভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু এনটিআরসিএ’র নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্যরকম। এ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় না, শিক্ষক হওয়ার সনদ দেয় এবং নিয়োগের সুপারিশ করে। কেউ একবার নিয়োগ না পেলেও পরবর্তী সময়ে নিয়োগের আশায় থাকেন। দীর্ঘ যাচাই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সনদ লাভ করায় নিবন্ধন সনদধারীদের ভেতর চাকরিপ্রাপ্তির প্রতীতি জন্মে গেছে। এ পর্যন্ত নিবন্ধন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে আঠারবার আর শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি (গণবিজ্ঞপ্তি) হয়েছে তিনবার। এতে প্রতীয়মান হয়, নিবন্ধন পরীক্ষার আগ্রহের সিকিভাগও এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগে দেখায়নি। অথচ একজন নিবন্ধনধারী সনদ অর্জনের পর শিক্ষক হওয়ার প্রত্যাশায় থাকেন।
গত ৩০ মার্চ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। শূন্যপদের সংখ্যা ৫৪,৩০৪। এর ভেতর এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্যপদ ৪৮,১৯৯টি আর নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্যপদ ৬,১০৫টি। এ বিজ্ঞপ্তির ভেতরই জটিলতার বীজ দৃশ্যমান ছিল। গণবিজ্ঞপ্তির ২নং পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়, মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সিভিল লিভ টু আপিল ৩৪৩/২০১৯নং মামলায় প্রদত্ত রায় বাস্তবায়নের স্বার্থে ২২০৭টি পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সংরক্ষিত পদাধিকারীরা কেবল একটি আবেদনে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের পদ নিশ্চিত করতে পারবেন। তারা ১৩তম ব্যাচের প্রার্থী। বিজ্ঞপ্তিতে এরকম রায় দেখে আদালতের শরণাপন্ন হলে চাকরির নিশ্চয়তা মেলার আশায় নিবন্ধনধারীরা বিভিন্ন গ্রুপে রিট করতে আইনজীবীদের দ্বারস্থ হতে থাকেন। পূর্বের রায়ের অনুসরণে ১-১২তম নিবন্ধনকারীদের ২,৫০০ জন ৩১ মে আদালত থেকে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশের আদেশ বের করে আনেন। যদিও অপিল বিভাগ ২৮ জুন সেই আদেশ বাতিল করে দেন। এতে করে একই যাত্রায় ভিন্ন ফল মিললো। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ৮৯ লাখের অধিক আবেদন পড়ে। কোনো একটি বিজ্ঞপ্তিতে চাকরির জন্য এত বিপুলসংখ্যক আবেদন সম্ভবত একটি রেকর্ড। যদিও নিবন্ধনধারী প্রার্থীর সংখ্যা সম্ভবত ২ লাখের বেশি নয়।
এনটিআরসিএ অদ্ভুত ধরনের নিয়োগ আবেদনের পদ্ধতি হলো- প্রার্থীকে নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টার্গেট করে আবেদন করতে হয়। ওই প্রতিষ্ঠানে আরও কতজন আবেদন করেছে এবং তাদের নিবন্ধন সনদের নম্বর কত তা জানা যায় না। প্রার্থীদের ভেতর নিবন্ধন সনদে যার নম্বর সবচেয়ে বেশি তিনিই ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ্য হিসাবে বিবেচিত হন। কোনো কোনো প্রার্থী শতাধিক এমনকি হাজারের ওপর আবেদন করেছেন। এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। একজন প্রার্থী একের পর এক ঢিল ছুড়ছেন; কিন্তু কোনো ঢিল আদৌ লক্ষ্যভেদ করতে পারবে কিনা তা তার জানা নেই। অথচ প্রতিটি ঢিলের জন্য শতাধিক টাকা গুনতে হয়েছে। একজন প্রার্থী আবেদনের পর তার নিবন্ধন সনদের নম্বর প্রদর্শিত হলে তার চেয়ে কম নম্বরের সনদধারী ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদে আবেদন করতেন না। এত ঝক্কি পেরিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি হলে বেতন মিললেও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি হলে বেতন হবে না।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আবেদন ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে ১২০ টাকা। এ হিসাবে একটি বড়সংখ্যক প্রার্থী আবেদনে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করেছেন। এরপর অনেকে রিটে জড়িয়ে অর্থব্যয় করেছেন। এনটিআরসিএ এ আবেদন থেকে প্রায় শতকোটি আয় করেছে। এ টাকার একটা অংশ প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দিয়ে বদান্যতা দেখিয়েছে। অথচ এ করোনাকালে অধিকাংশ প্রার্থী অনেক কষ্টে আবেদনের টাকা জুগিয়েছেন।
১-১৫তম নিবন্ধনধারীদের নিয়ে সমন্বিত মেধাক্রম করা হয়েছে। এ মেধাক্রমে সনদে অধিক নম্বরপ্রাপ্তরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবেন। এক্ষেত্রে ১-১২তম নিবন্ধনকারীদের অভিযোগ হলো, তাদের সময় ১০০-র ভেতর ৬০ পাওয়াও সহজ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রশ্নের ধরন বদল ও সহজ মূল্যায়নের দরুন অনেকেই ৮০-র ওপর নম্বর পেয়েছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিবন্ধনধারীদের সঙ্গে পূর্বের নিবন্ধনধারীরা প্রতিযোগিতায় এটে উঠতে পারবেন না।
আরেকটি জটিলতা তৈরি হয়েছে বয়স নিয়ে। ১-১২তমদের পরীক্ষা ছিল সনদ প্রদানের। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, সনদের মেয়াদ আজীবনকাল। প্রার্থী বেশি হওয়ায় সনদ দিয়ে চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না, সনদের সঙ্গে নম্বরও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীর বয়স ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ৩৫ বছর বা তার কম নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম দিককার নিবন্ধনধারীদের অনেকের বয়স ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সনদ অর্জনকালে তাদের বয়স ৩৫ বছরের কম ছিল। এনটিআরসিএ তাদের যথাসময়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারেনি। এ অভিযোগে প্রার্থিতার দাবি নিয়ে ১৬৬টি মামলা হয়েছে। রায় বাদীদের পক্ষে গেছে। বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া রায়ের অংশ হলো- তবে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ইনডেক্সধারী প্রার্থী এবং মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯নং মামলার রায় অনুযায়ী ১২.০৬.২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের পূর্বে যারা শিক্ষক নিবন্ধন সনদ লাভ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা শিথিলযোগ্য।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলির ব্যবস্থা নেই। ৫ম নিবন্ধনের পরের সনদধারী শিক্ষকদের আবারও আবেদনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ পযায়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি অংশ নিজ প্রতিষ্ঠানে সন্তুষ্ট নন। তারা অন্য কোথাও সুবিধাজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আবার আবেদন করেছেন। নিবন্ধন সনদে অধিক নম্বর থাকায় এসব শিক্ষকের ভেতর থেকে একটি অংশ আবার নিয়োগ পাবেন। তখন একদিকে এখনকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পদশূন্য হয়ে শিক্ষক সংকটে পড়বে, অন্যদিকে নিয়োগপ্রত্যাশীরা নিয়োগবঞ্চিত থেকে যাবেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা এড়ানো যেত।
নিবন্ধন সনদধারীদের ফেসবুকে অনেক গ্রুপ রয়েছে। এতে নানা ধরনের পোস্ট এবং প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এগুলো মনোযোগের দাবি রাখে। সনদে কম নম্বরধারী একজনের প্রশ্ন- আমাদের নম্বর কম, তবু গণবিজ্ঞপ্তিতে রাখলেন কেন? ক্যাসিনো খেলার জন্য কি? একজনের অভিযোগ- সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শূন্যপদে চাহিদা দিচ্ছে না। নিয়োগ আবার ম্যানেজিং কমিটির হাতে ফিরে আসতে পারে সেই আশায় কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস পরিচালনা করছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে শূন্যপদের চাহিদা দেয় সেই ব্যবস্থা থাকা দরকার। (১-১২)তম নিবন্ধন নন-রিটকারী জোটের প্রস্তাব- আবেদনকারী সবার টাকা ফেরত দেওয়া হোক। রিটকারীদের মামলা ডিসমিস করা হোক। নিবন্ধন পরীক্ষা বন্ধ রেখে বয়স ও নম্বরের ওপর মার্ক নির্ধারণ করে প্যানেলভিত্তিক সব নিবন্ধনকারীর নিয়োগ সম্পন্ন করা হোক। এটাই ন্যায়বিচার ও সহজ সমাধান। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভুল তালিকা পাঠানোয় গতবার সুপারিশপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগ না পাওয়ার ভিডিও নেটে দেখা গেল। কর্তৃপক্ষ এ ভুলের সুরাহা করতে পারেনি।
আমি মফস্বল এলাকার একটি নন-এমপিও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুলে শিক্ষক আছে মাত্র ছয়জন। অন্যরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। আরও দুইজনের যায় যায় অবস্থা। শূন্যপদে পাঁচজনের চাহিদা দিয়েছি। চাকরিপ্রত্যাশী বেশ কয়েকজন ফোনে স্কুলের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। তারা এ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করবেন কী করবেন না তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। অধিকাংশই অন্য জেলার প্রার্থী। স্কুলের সর্বশেষ এমপিও নীতিমালার শর্ত পূরণ করার বিষয়টি জানিয়ে তাদের আশ্বস্ত করেছি। সাধারণত মেধাক্রমের নিচের দিককার প্রার্থী নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করে থাকেন। এতে করে একটি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সঙ্গে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের মানের কিছুটা হলেও পার্থক্য ঘটে। বাজেটে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। চলতি অর্থবছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা না হলে বিনাবেতনে দূরাগত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের ধরে রাখা সম্ভব হবে না। প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষকের অভাবে স্কুলটির মান পড়ে যাবে। তখন স্কুলটি এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণের যোগ্যতাও হারাবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ম্যানেজিং কমিটির হাতে থাকলে তবুও একভাবে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে নেওয়া যেত। এখন প্রশ্ন হলো, এনটিসিআর তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, নাকি কেবল দায়িত্বহীন কর্তৃত্ব করে যাবে?
লেখক : আহ্বায়ক, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী পরিষদ