প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসৃত হয় এটিকে বলা হয় ওয়েস্টমিনিস্টার টাইপ অব ডেমোক্র্যাসি। এ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটি যুক্তরাজ্যে তথা বৃটেনে প্রবর্তিত এবং অনেকটা ভারতে। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে অবস্থিত ওয়েস্টমিনিস্টার রাজপ্রসাদ থেকে ওয়েস্টমিনিস্টার শব্দটি উদ্ভুত, বর্তমানে যা বৃটিশ পার্লামেন্ট হিসেবে কার্যকর হচ্ছে। পার্লামেন্ট শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ সংসদ। আমাদের দেশের পার্লামেন্ট জাতীয় সংসদ নামে অভিহিত। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্যরা দেশটির একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের দেশের সংসদ সদস্যরাও একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত। যদিও আমাদের দেশে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনের সদস্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের দল ভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রতিফলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্ত দল একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। আমাদের দেশে জনমতের প্রতিফলন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নয় অর্থাৎ পরিসংখ্যান মতে, মোট ভোট সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। ভোট প্রার্থীর মধ্যে আপেক্ষিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ-ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হন। আর তারাই সরকার গঠন করে। গণতন্ত্রের যেরূপ পদ্ধতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন প্রবর্তিত হোক না কেন, এরূপ শাসনব্যবস্থায় যে কোন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হওয়া কাক্সিক্ষত। অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হলে সে সরকারের পক্ষে স্বচ্ছতার সাথে জবাবদিহিতামূলকভাবে সরকার পরচালনা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া অস্বচ্ছ ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে কোনো দল বিজয়ী হলে দেখা যায়, যাদের সহায়তায় বিধিবদ্ধ নির্বাচনি আইন বহির্ভূত তথা অন্যায়ভাবে নির্বাচনে বিজয় হাসিল করা হয় তাদের দ্বারা দুর্নীতিমুক্তভাবে প্রজাতন্ত্রের কাজ সুষ্ঠুভাবে চালানো দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
যে কোনো দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র পূর্বশর্ত। সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হলে সে নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। অপ্রিয় সত্য, আমাদের দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনসহ অপরাপর ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অনেক নির্বাচন কাক্সিক্ষত মাত্রায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমন কি যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ‘পলিটিকো’র খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ১০০ দেশের সম্মেলন হবে চলতি ডিসেম্বর মাসে। সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এটি হতাশার ও উদ্বেগের। নির্বাচন বিষয়ে দীর্ঘকাল এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা-গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা শতাধিক হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে সংসদে আসন লাভ করবে এরূপ দলের সংখ্যা গুটি কয়েক। স্বাধীনতোত্তর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এ তিনটি রাজনৈতিক দল একক বা জোটবদ্ধভাবে সরকারের শাসনক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। উক্ত দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলের নেতৃত্ব একই গোষ্ঠী থেকে আগত ব্যক্তির ওপর ন্যাস্ত এবং দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একই ব্যক্তি এককভাবে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশ শাসন করেছে বা করে চলেছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের যিনি দলীয় প্রধান তিনি সরকারেরও প্রধান। দীর্ঘ ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি দলটির প্রধানেরও দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে দল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া পরবর্তী প্রতিবারই সরকার-প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে পরিবারের মধ্য থেকে কাউকে না কাউকে যে বিবেচনা করছেন না তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। এটি দল সংশ্লিষ্টদের অভিমত। তাঁর মতো তাঁর পিতাও দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি সরকারপ্রধান ও দলীয়প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন দলের প্রধান অঙ্গ-সংগঠন ও সহযোগী সংগঠন (যুবলীগ, ছাত্রলীগ) এ দু’টি প্রধানের দায়িত্ব তার একান্ত আপনজন (ভগ্নিপুত্রদ্বয়) প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বর্তমান বিএনপি প্রধান ১৯৮৪ সালে দলটির চেয়ারপারসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি বিএনপির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন তিনবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন এবং প্রতিবারই তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার স্বামী জিয়াউর রহমান। তিনিও দলটির প্রধান থাকাকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দল ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যার উভয় দায়িত্ব পালনকালীন দল বা সরকার বা দলের অঙ্গসংগঠনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে তার ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়ের পদ লাভ বিরল ঘটনা ছিল। বিএনপির বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক জিয়া। বেগম খালেদা জিয়াও দলের প্রধান বা সরকারপ্রধান হিসেবে তার অবর্তমানে তারেক জিয়া অথবা তার পরিবারবহির্ভূত অপর কাউকে বিবেচনা করছেন না (এটি দলীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে আভাস)।
সেনাপ্রধান এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল পরবর্তী জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন এবং তার শাসনকালে অনুষ্ঠিত ৩য় ও ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এ দুটি নির্বাচন কতটুকু অবাধ, স্বাধীন-নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক ছিল আলোচনার প্রেক্ষিত ভিন্নতায় সে আলোচনা এখানে না-ই বা করা হলো। এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় তিনি একদিকে রাষ্ট্রপ্রধান অপরদিকে সরকারপ্রধান অন্যদিকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলে মামলা সংশ্লেষে তার জেল-জরিমানা হলেও তিনি আমৃত্যু দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যুর পর প্রথমত তার স্ত্রী রওশন এরশাদ ও পরে ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলীয়প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। যদিও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব রওশন এরশাদই পালন করছেন। এ দুজনই এরশাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আপনজন। এদিকে এরশাদের অপর স্ত্রী এরিকের মা বিদিশা নিজেকে দলের প্রধান হিসেবে দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
বর্তমান সময়ের জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনসহ সংসদ সদস্যের নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাদের আকাক্সক্ষার বাইরে অপর কারো নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। প্রায় ১২ বছরের অধিক সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি ক্ষমতাসীন দল হিসেবে সরকার পরিচালনর দায়িত্বে রয়েছে। এ সময়ে সংসদ সদস্যদের মৃত্যুজনিত কারণে যেসব পদ শূন্য হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীর পরিবর্তে মনোনয়ন লাভের ক্ষেত্রে মৃত সংসদ সদস্যের স্ত্রী, ভাই বা পুত্র বা কন্যা বিবেচিত হয়েছেন এবং ক্ষমতাসীনরা তাদের বিজয়ও নিশ্চিত করেছেন। আরো উল্লেখ্য, যা না বলা উচিত হবে না, তা হলো, অনেক সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী মহোদয় তাদের আপনজনকে দলীয় পদ-পদবী দিচ্ছেন, এমনকি লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন লাভে অন্যতম ভূমিকা রাখছেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বাইরে যেসব দল সংসদ নির্বাচনে আসন লাভ করেছে তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রভৃতি। এসব দলের ক্ষেত্রে, দলের প্রধান নির্বাচনে ও সংসদ সদস্যের মনোনয়নে কদাচিৎ পরিবারের সদস্য বিবেচনায় স্থান পেয়েছেন।
আমাদের দেশের প্রধান যে তিনটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে একক বা জোটগতভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলীয় ও সরকারপ্রধান হিসেবে পরিবারের বাইরে দলের অপর কারো উপর দলের বা সরকারপ্রধানের দায়িত্ব অর্পণের ধারণা তাদের কাছে এখনো অচিন্তনীয়। উক্ত তিনটি রাজনৈতিক দল দলীয়প্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে পরিবারবহির্ভূত ব্যক্তিকে বিবেচনায় না নেয়ার কারণে উত্তরাধিকার নির্বাচনে তাদের মনোবৃত্তির যে বহিঃপ্রকাশ বিকশিত তা গোষ্ঠীতন্ত্র (ঙষরমধৎপযু) বৈ কি। আর এ ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র গণতন্ত্রের আড়ালে বিকশিত হচ্ছে। বোধ করি এ উপলব্ধি থেকে সচেতন দেশবাসী বিচ্যুত নয়। গোষ্ঠীতন্ত্রে শাসকরা সাধারণতঃ স্বৈরাচারী হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী না হলেও স্বেচ্ছাচারীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করে, যার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও দুর্নীতি কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যতিরেকেই কার্যকর হয়। যা থেকে বাংলাদেশ আদৌ মুক্ত হতে পারেনি বরং দিন দিন এর বিকাশ ও প্রভাব বেড়েই চলছে। এর ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎই বলে দিবে।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ও রাজনীতিবিশ্লেষক।